* যশোরে ১২ দিনে ৫ খুন, ২১ জন ছুরিকাহত
বিশেষ প্রতিনিধি: যশোরে চাকুবাজ সন্ত্রাসীদের কোনভাবেই থামানো যাচ্ছে না। আইন—শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার মধ্যেও ঘটে যাচ্ছে একের পর এক খুন। এরবাইরে প্রতিদিনই দুই তিনটি ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটেছে। বেশিরভাগ ঘটনার সাথে উততি সন্ত্রাসী ও চাকুবাজ কিশোরগ্যাংয়ের সংশ্লিষ্টতা মিলছে। অবশ্য পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এসব ঘটনার কোনটিই পূর্ব পরিকল্পিত নয় বরং তাৎক্ষণিক রাগের বসবর্তি হয়ে খুনের ঘটনা ঘটছে।
পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত খবর মতে, যশোরে চলতি মাসের ১২ দিনে ৫জন খুন, ২১জন ছুরিকাহত, কয়েকজনকে পিটিয়ে মারাত্মক আহত করা, ২টি ইজিবাইক ছিনতাই ঘটেছে। একই সাথে বেড়েছে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম, মাদককারবারিদের দৌরাত্ম। জোড়া আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। মামা—ভাগ্নের আত্মহত্যা, চৌগাছায় মেয়েকে বিষ পান করিয়ে ও মায়ের আত্মহত্যা, মণিরামপুরে শালিসের নামে প্রবাসীর স্ত্রীকে নির্যাতন ও শ্লীলতাহানি, দেয়াল কেটে সোনার দোকানে চুরিসহ প্রায় প্রতিনিয়তই শহরের বিভিন্ন স্থানে চুরির মত অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। তাছাড়া বেশ কয়েকজন মাদককারবারি আটক, মাদক উদ্ধার, ছুরিসহ যুবক আটকের সাফল্য দেখিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী।
সর্বশেষ খুন হয় অভয়নগরে গত রোববার রাতে। নিহত হয়েছেন মুরাদ হোসেন (২৮)। তিনি ওয়ার্ড যুবলীগের নেতা। উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের মধ্য তরফদপাড়া এলাকায় স্বপ্ন ভিলার সামনে এ ঘটনা ঘটে। নিহত মুরাদ হোসেন ওই এলাকার সাহাবুল ইসলামের ছেলে ও নওয়াপাড়া পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে ছিলেন।
ঘটনাকে কেন্দ্র করে রোববার মধ্যরাতে নওয়াপাড়া পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ আব্দুস সালামের অস্থায়ী কার্যালয় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
নিহতের বাবা সাহাবুল ইসলাম বলেন, মুরাদ বাজার থেকে বাড়ি ফেরার সময় ওঁৎ পেতে থাকা একদল সন্ত্রাসী তাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে পালিয়ে যায়। পরে পুলিশের সহযোগিতায় গুরুতর আহত মুরাদকে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হয়। পরে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করেন। খুলনায় পেঁৗছালে চিকিৎসকরা তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
এর আগে, রোববার ১১ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টার দিকে রাজারহাট রামনগরের সুতিঘাটা এলাকায় গণপিটুনিতে ফয়েজুল গাজী (২৭) নিহত হন। রাতভর নির্যাতনের পর তাকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। চোর সন্দেহে তাকে মারপিট করে অজ্ঞাতরা। তিনি যশোর সদর উপজেলার গোলদার পাড়া সুতিঘাটা গ্রামের জালাল উদ্দিন গাজীর ছেলে। নিহতের ভাতিজা বাদল জানান, তার চাচা একটি ইট ভাটায় কাজ করেন। ভাটা থেকে কাজ করে বাড়ি ফেরার পথে তাকে ধরে নিয়ে এক কারখানার মধ্যে দড়ি দিয়ে বেঁধে হাতুড়ি ও রড দিয়ে মারপিট করে।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় যশোর রেলস্টেশনে খুন হন জুম্মান সরদার (৩৮) নামে বহু মামলার এক আসামী। নিহত জুম্মান শহরের শংকরপুর রেলগেট মোড়ের পকেটমার মুরাদ হোসেনের ছেলে। পূর্বশত্রুতার জের ধরে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে জুম্মান খুন হয়। নিহত জুম্মানের নামে কোতয়ালি থানায় ডজন খানেক মামলা রয়েছে।
এদিন(শনিবার) সন্ধ্যায় জুম্মানকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে আসে ভাইপো রাকিব, প্রিন্স, ট্যাটু সুমন, আসিফ ভোলাসহ কয়েকজন। এরপর তাকে তাড়া করে নিয়ে যায়। জুম্মান দৌড়ে রেলস্টেশন এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতির অফিসের সামনে পেঁৗছুলে পেছন থেকে ছুরিকাঘাত করে তারা। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে সন্ধ্যা ৬ টা ৪০ মিনিটে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। সূত্রটি আরো জানায়, অস্ত্র ও মাদকের টাকা ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে জুম্মানের সাথে ভাইপো রাকিব, প্রিন্স, রনি, ভোলা, ট্যাটো সুমন, আসিফ ও খোলাডাঙ্গার আকিবুরসহ বেশ কয়েকজনের বিরোধ ছিলো। এ কারণে জুম্মান দীর্ঘ দিন মাগুরয়া পালিয়ে ছিলেন। স¤প্রতি জুম্মান যশোর আসলে খুনের শিকার হন।
গত ৯ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার সুদের টাকা আদায় নিয়ে বিবাদের জের ধরে প্রাণ দিতে হয়েছে মহাসিনকে। এদিন সকালে যশোর শহরতলীর বালিয়াডাঙ্গা মানদিয়া জামে মসজিদের পেছন থেকে নুরপুর গ্রামের মছি মন্ডলের ছেলে নিহত মহাসিনের (৪২) অগ্নিদগ্ধ বিকৃত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তাকে হত্যার বর্ণণা খুনি নিজেই দিয়েছেন। এ ‘হত্যাকাণ্ডে’ জড়িত মেহেদী হাসান লিখনকে গ্রেফতারের পর হত্যারহস্য উদ্ঘাটন করেছে যশোর ডিবি পুলিশ। গ্রেফতার লিখন যশোর সদর উপজেলার নূরপুর গ্রামের মৃত আকবর হোসেনের ছেলে। শনিবার রাতে তাকে আটকের পর উদ্ধার করা হয়েছে হত্যায় ব্যবহৃত ট্যাঙ্ক বাক্স, মহাসিনের মোবাইল ফোন ও জুতা। ডিবি পুলিশের ওসি রুপন কুমার সরকার জানান, চড়া সুদের টাকা দিতে না পারায় গালিগালাজ করেছিলো মহাসিন। সেই রাগে অফিসের মধ্যেই ল্যাপটপের চার্জারের তার দিয়ে প্রথমে শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করে মেহেদী হাসান লিখন। এরপর মরদেহ ভরা হয় একটি ট্যাঙ্ক বাক্সে। সেই বাক্সভর্তি লাশ নুরপুর থেকে প্রথমে ইজিবাইকে ও পরে ভ্যানে নিয়ে যাওয়া হয় ফতেপুরের মান্দিয়া গ্রামে। যাওয়ার পথে তেলপাম্প থেকে কেনা হয় ডিজেল। আর সেখানে নিয়ে ডিজেল ঢেলে পুড়িয়ে দেয়া হয় মহাসিনের মরদেহ।
এছাড়া গত ৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় উপশহরে স্বামী পরিতোষ কুমার পিটিয়ে হত্যা করেন তার স্ত্রী রমা রানীকে।
গত ৩ ফেব্রুয়ারি রাত ও ৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৯ জন ছুরিকাহত হয়। এরা হলেন, আল আমিন, জাহিদুল ইসলাম, শেখ নাবির উদ্দিন, সাব্বির হোসেন, সাকিল হোসেন, সাফিকুর রহমান,নাজিম উদ্দিন, মিজানুর রহমান ও রেজাইল ইসলাম।
এর আগে গত ৬ ফেব্রুয়ারি ২০ ঘণ্টার মধ্যে আরো ৯ জন ছুরিকাহত হন। এ সময় ছুরিকাঘাত করে ২টি ইজি বাইক ছিনতাইও হয়েছে। ছুরিকাহত ৪ জন হলেন, রফিকুল ইসলাম, টিপু সুলতান, সুধাংশু শেখর। অন্য ৫ জন বিভিন্ন স্থান থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। তবে যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, প্রায় প্রতিদিনই হাসপাতালে ছুরিকাঘাতের রোগী আসছে চিকিৎসা নিচ্ছে। গত ১০ ফেব্রুয়ারিতে অটো রিকশা চালক টগর ছুরিকাহত হন। দুই দফায় ছুরিকাহতের ১৮ জনের মধ্যে বেশ কয়েকজন কিশোর রয়েছে। এদিকে, ১১ তারিখে চাঁদাবাজ ও ছিনতাইকারীদের হাতে জখম হন শেখ মোহাম্মদ রিপন ও অহিদুল ইসলাম। ৮ ফেব্রুয়ারিতে চাকুসহ পুলিশের হাতে আটক হয় ২ কিশোর। উপশহরে মা—মেয়ের মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে এলাকাবাসী ঝাড়– মিছিল করে । ২ ফেব্রুয়ারিতে খড়কির তরিকুল ইসলাম আহত হন। এর আগে ৩১ জানুয়ারি চাঁচড়ায় গ্রাম পুলিশ জয়নাল সন্ত্রাসী হামলা ও ছুরিকাঘাতের শিকার হন।
এই ১২ দিনে পুলিশ বেশ কয়েকজন মাদক কারবারিকেও আটক করেছে। গ্রেফতার করেছে হত্যা মামলার বেশ কয়েকজন আসামিকেও।
যশোরের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো বলে মত প্রকাশ করেছেন, জেলা পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ারদার। গত রোববার জেলা আইন শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির মাসিক সভায় তিনি জানান, কিছু সমস্যা হয়েছে তারপরও অনেকটাই ভালো রয়েছে পরিস্থিতি। জাতীয় নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশ বিভাগকে বিগত সময় অনেক কাজ করতে হয়েছে—বাড়তি দায়িত্বও পালন করতে হয়েছে । এ কারণে এ দিকে কিছুটা দৃষ্টি কম দেয়া হয়েছে। তবে এখন থেকে শক্ত হাতে এ সমস্যা প্রতিহত করা হবে।
এই ১২ দিনের বাইরে পুলিশের তথ্য মতে, গত জানুয়ারি মাসে ৬টি খুনের ঘটনা ঘটেছে এবং ৩৮টি চুরির ঘটনাও আছে।