৭ই মে ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
পরিবর্তনশীল আগামীর দক্ষতায় বই

আফরোজা নাইচ রিমা : চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রযুক্তিভিত্তিক দক্ষতা এবং বই একে অন্যের পরিপূরক। আগামীর পরিবর্তনশীল বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বই ও দক্ষতাভিত্তিক জ্ঞান নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা, দর্শনের অবতারণা হবে এবং ইতিমধ্যে সেটি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এ শিক্ষার মাধ্যমে জাতিকে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার বৈশিষ্ট্য ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করানোর ওপর একদিকে জোর দেওয়া হয়েছে , অন্যদিকে পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তনশীল দুয়ারে পৌঁছানোর জন্য সুনিদির্ষ্ট ,সুপরিকল্পিত এবং পরিপূর্ণ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

বর্তমান ডিজটালনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় যেমন-ই -লার্নিং ও অনলাইন শিক্ষার কথা বলা হচ্ছে । ভাবতে হচ্ছে ট্রেড কোর্স কিংবা প্রফেশনাল কোর্স বা বিকল্প কোর্সের ব্যবস্থা নিয়ে। একদিকে,পরিকল্পনায় থাকছে সাধারণ শিক্ষার সাথে কারিগরি শিক্ষার সমন্বয়,অন্যদিকে শুধু প্রযুক্তির ওপরেই নয়,ই-বুক কিংবা শিল্প সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে বই -ই একমাত্র বিকল্প এবং গ্রহণযোগ্য সমাধান। কেননা, মানবসভ্যতা সৃষ্টির শুরু থেকে অদ্যাবধি যা কিছু ঘটেছে সবকিছুই লিখিত আকারে রয়েছে বইয়ে। উদাহরণস্বরূপ, আইন এবং ধর্মগ্রন্থের কথা উল্লেখযোগ্য।

<<আরও পড়তে পারেন>> ভালবাসা দিবসে সৌরভ ছড়াতে প্রস্তুত কালীগঞ্জের ফুলচাষীরা

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে মানুষের চিন্তা-চেতনা, সুখ-দু:খের চাহিদা বা প্রত্যাশিত অনেক কিছূই ঘটবে ভার্চুয়াল জগতে, প্রযুক্তির মাধ্যমে আর এই ভার্চুয়াল বাস্তবায়নে বই উৎকর্ষ সাধনের এক এবং অন্যতম অনুষঙ্গ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার উপর জোর দিয়েছিলেন। সময়োপযোগীতার সাথে সাথে বই পড়া যেন বর্তমান প্রজন্মের জন্য খুবই অনুধাবনযোগ্য।

ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এতটাই আসক্ত হয়ে পড়ছে যে ,সে কারণে বই পড়ার প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে। এজন্য বর্তমান সরকার ২০২৪ এর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনী ইশতেহারে শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য নিয়েছে বেশ কিছু পদক্ষেপ । উল্লেখযোগ্যগুলো হলোবই উত্সব। বই উত্সব মাধ্যমে বছরের প্রথম দিনে ১০ম শ্রেণি বা সমমান পর্যন্ত বিনামূল্যে নতুন পাঠ্যবই বিতরণেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোল মডেল ।

বই বিতরণের ফলে ভর্তির হার বেড়েছে এবং ঝরে পড়া কমে আসছে।২০১০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, ইবতেদিয়া, দাখিল, দাখিল (ভোকেশনাল), এসএসসি (ভোকেশনাল) ও কারিগরি স্তরের শিক্ষার্থীর মাঝে ২৬০ কোটির বেশি কপি পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্রেইল বই বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে।একইসাথে স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ভাষা,উচ্চতর গণিত ও বিজ্ঞান শিক্ষাকে গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে। বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য উপযুক্ত ল্যাবরেটরি গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হচ্ছে।মেধাবী বিজ্ঞানও গণিতের শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ বৃত্তি প্রদানের অঙ্গিকারও করা হয়েছে।

নির্বাচনী ইশতেহারে আরো উল্লেখ করা হয়-দেশের সকল লাইব্রেরিতে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার ,খুলনায় ১৯৭১: গণহত্যা নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের জন্য নতুন ভবন নির্মাণ, চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স, শৈলজারঞ্জন সংস্কৃতি কেন্দ্র, উকিল মুন্সিী স্মৃতিকেন্দ্র, মণিপুরী ললিতকলা একাডেমি এবং ৮ টি জেলায় নতুন শিল্পকলা একাডেমি নির্মাণ করা হয়েছে।দেশব্যাপী ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি প্রকল্পের আওতায় ৬৪টি জেলার ৩২০০টি নির্ধারিত এলাকায় জনসাধারণের দোরগোড়ায় লাইব্রেরিসেবা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এছাড়া, অমর একুশে গ্রন্থমেলাসহ দেশের ভেতর জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নিয়মিত বইমেলার আয়োজন হচেছ । এছাড়াও ফ্রাঙ্কফুট ও কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় অংশগ্রহণ এবং আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেন, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের বইমেলার আয়োজন হচ্ছে।

স্মার্ট বাংলাদেশ হবে স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার এবং স্মার্ট সোসাইটির ওপর ভিত্তি করে। আর জ্ঞানই একমাত্র সফলতার চাবিকাঠি। কারণ জ্ঞান সফলতার পথকে প্রশস্ত করে। বইয়ের মাধ্যমেই নাগরিক হবে স্মার্ট এবং জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারবে।জ্ঞানকে সমৃদ্ধিশালী করতে, একাগ্রতা বৃদ্ধি করতে বিশেষ করে বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তির যুগে সবাই এখন ব্যস্ত স্মার্ট ফোন নিয়ে। অথচ যদি নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস থাকে, তাহলে কাজের একাগ্রতা বৃদ্ধি পাবে। একইসাথে শব্দ ভান্ডার বাড়াতে ,স্মৃতিশক্তি উন্নত করতেবই পাঠকের মানসিক উত্তেজনা বৃদ্ধি করে।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, অধ্যয়ন চিত্তভ্রংশ (ডিমেন্সিয়া )ও আলজেহিমা নামের এই রোগ দুটিকে হ্রাস, এমনকি প্রতিরোধ করতেও সাহায্য করে। মানসিক চাপ কমাতে বই এর মাধ্যমে গল্পের বিভিন্ন প্লট পাঠককে চিন্তার ভিন্ন জগতে নিয়ে যাবে। এক্ষেত্রে পাঠক সহজেই দুশ্চিন্তা মুক্ত হতে সক্ষম হবে। বই পড়ার সময় প্রত্যেকটি মানুষের একদিকে কল্পনা শক্তি বৃদ্ধি পায় , অন্যদিকে মানুষের মনে নতুন নতুন ধারণা সৃষ্টি করে। যার কারণে পাঠকের মনে কৌতূহল বাড়ে। এককথায়, নিজের কল্পনা শক্তি ও কৌতূহল বৃদ্ধি করার জন্য বই পড়া অপরিহার্য।

বিভিন্ন উৎস থেকে জানা যায়,একাকীত্ব দূর করার জন্য বই সব থেকে ভালো উপায়। সম্প্রতি, মোবাইল ফোনকে সবাই সঙ্গী করে নিয়েছে। কিন্তু যদি ব্যক্তি মোবাইলের মধ্যে বই পড়া শুরু করেন, তাহলে তাঁর জীবনের একঘেয়েমি চলে যাবে এবং ব্যক্তি একজন ভালো বন্ধু খুঁজে পাবে। নিজের মনকে শান্ত করতে এবং মনের মধ্যে নতুন শক্তি যোগাতে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। জীবনে ভিন্ন কিছু বা বড় কিছু করতে চাইলে একমাত্র বই-ই সেই অনুপ্রেরণা দিতে পারে। যেকোনো কিছু ইতিবাচক চিন্তা করা এবং নতুন কিছু চেষ্টা করার জন্য বই অত্যন্ত উপকারী। লেখার দক্ষতা বৃদ্ধি করতে যখন বিভিন্ন লেখকের বিভিন্ন বিষয়ের উপর বই পড়া হয়, তখন ভাষাতত্ত্বের বিকাশ হয়।

সে কারণে উন্নত শব্দ এবং সুন্দর করে ভাষা প্রয়োগ্ও সহজে সম্ভব হয়। যা বাস্তব জীবনে,শিক্ষাক্ষেত্রে, কর্মস্থলে বা কোথাও বক্তৃতা দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তির উপস্থাপনকে অনেক চৌকষ করে তুলতে সক্ষম হবে। এতে করে উন্নয়ন যোগাযোগের ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ হবে। ফরাসি দার্শনিক র্নে দেকার্ত লিখেছেন, ‘ভালো বই পড়া মানে গত শতাব্দীর সেরা মানুষদের সঙ্গে কথা বলা।’

বই যুগের সাথে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তিগত জ্ঞান বৃদ্ধি করে। বই হলো জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির আধার। প্রযুক্তিনির্ভর জ্ঞানচর্চা করতে বইয়ের বিকল্প নেই। ইরানের কবি ওমর খৈয়ামের বিখ্যাত উক্তিটি বইয়ের গুরুত্ব বোঝার জন্য অসাধারণ; তিনি বলেছেন, বই অনন্ত যৌবনা, যদি তেমন বই হয়।’ সুতরাং, বই হোক প্রত্যেক মানুষের উত্তম বন্ধু।

মার্কিন সাহিত্যিক আর্নেস্ট মিলার হেমিংওয়ের মতে, বইয়ের মত এত বিশ্বস্ত বন্ধু আর নেই।“ আলো যেমন অন্ধকার দূর করে সব কিছু স্পষ্ট করে তোলে, তেমনি বই মানুষের জ্ঞানের আলো এনে সব অন্ধকারকে দূর করে চেতনার আলোকে উদ্ভাসিত করে । বই অতীত থেকে ভবিষ্যৎ, নিকট থেকে দূরে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে, এমনকি যুগ থেকে যুগান্তরে জ্ঞানের আলোকে পৌঁছে দিতে পারে ।

তাই দেশ কালের সীমানা অতিক্রম করে জ্ঞানের আলোকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারে একমাত্র বই। মার্ক টোয়েন এর মতে ভাল বন্ধু, ভাল বই এবং একটি শান্ত বিবেক: এটি আদর্শ জীবন।“এককথায়, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, তথ্য বিপ্লব, তথ্য মুক্তি, প্রাযুক্তিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য ই-বুক, অডিও বুক, পিডিএফ, অন-লাইন রিডিং প্ল্যাটফরম, বিভিন্ন অ্যাপ হতে পারে বইয়ের নতুন প্ল্যাটফরম।

অমর একুশে বইমেলা-২০২৪ এ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এখন প্রকাশকদের শুধু কাগুজে প্রকাশক হলে চলবে না, ডিজিটাল প্রকাশক হতে হবে। তাহলে আমরা বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারব। বিদেশেও পৌঁছাতে পারব। লেখার পাশাপাশি অডিও থাকবে, এমনটাই করা উচিত।

বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির রয়েছে বিভিন্ন ধারা। উল্লেখযোগ্য হলো - কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, গবেষণা অনুবাদ, চারু ও কারুশিল্প, স্থাপত্য, আবৃত্তি, সংগীত, চলচ্চিত্র, যাত্রা, নাটক, ম্যাগাজিন, জার্নাল, সৃজনশীল প্রকাশনাসহ শিল্পের সব শাখার ক্রমাগত উৎকর্ষ সাধন ও চর্চার ক্ষেত্রে বই হোক অন্যতম অবলম্বন।

তাই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে প্রত্যেক নাগরিক বই কিনব, পড়ব, বুঝব,লিখব এবং অপরকে বই পড়তে উৎসাহিত করব।পরিবর্তনশীল আগামীর দক্ষতায় বই হয়ে উঠুক নিত্যসঙ্গী।-পিআইডি ফিচার
লেখক: উপ-প্রকল্প পরিচালক, তথ্য অধিদফতর, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা।

সম্পাদক ও প্রকাশক : শাহীন চাকলাদার  |  ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আমিনুর রহমান মামুন।
১৩৬, গোহাটা রোড, লোহাপট্টি, যশোর।
ফোন : বার্তা বিভাগ : ০১৭১১-১৮২০২১, ০২৪৭৭৭৬৬৪২৭, ০১৭১২-৬১১৭০৭, বিজ্ঞাপন : ০১৭১১-১৮৬৫৪৩
Email : samajerkatha@gmail.com
পুরাতন খবর
FriSatSunMonTueWedThu
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31 
স্বত্ব © samajerkatha :- ২০২০-২০২২
crossmenu linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram