তহীদ মনি : এ বছর পাচারকারীদের কাছ থেকে যতটা সোনা উদ্ধার হয়েছে অতীতে অতটা আর ধরা পড়েনি। তবে সোনা ধরা পড়লেও কখনই আটক হয়নি নেপথ্যের হোতারা। বাহক যারা আটক হচ্ছে তারাও মামলার দুর্বলতার সুযোগে বের হয়ে যাচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে পাচারকারীরা একটি চালান ‘ধরিয়ে দিয়ে’ অন্য পাশ দিয়ে বিপুল পরিমাণ সোনা পাচার করে থাকে। কারো কারো দাবি, ধরা পড়া সোনা ‘আসল সোনা’ নয়। কিছু খাঁটি সোনা আর কিছু প্রলেপ দেওয়া সোনারবার ধরিয়ে দিয়ে হোতারা পার করে নিচ্ছে বিপুল পরিমাণ আসল সোনা। যদিও বিজিবির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘নকল নয়, যেসব সোনা ধরা হয়েছে তার সবগুলোই আসল।’
৪৯ বিজিবির সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১৪ টি অভিযানে ৮০ কেজি ৫২৩ গ্রাম সোনা আটক ও জব্দ করা হয়েছে। এ সময় ১৬ জনকে আটকও করা হয়। পালিয়ে যায় ৪ জন। আটক ও জব্দকৃত সোনার মূল্য দেখানো হয়েছে, ৬৭ কোটি ৮৫ লাখ ৫৪ হাজার ২শ টাকা। ডিসেম্বরে পৃথক ৩ টি অভিযানে আরও ৪ কেজির অধিক সোনা আটক হয়েছে। এর আগে গত ২০২১ সালে ৪৯ বিজিবি ৫টি অভিযানে ১৩ কেজি ১৪৩ গ্রাম সোনা আটক করে। ওই সোনার মূল্য দেখানো হয় ৯ কোটি ৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এ সময় ৭ জনকে আটক করা হয়। ৪৯ বিজিবি ছাড়াও ২১ বিজিবি (খুলনা ব্যটালিয়নে কর্মরত) চলতি বছর প্রায় ২৬ কেজি সোনা আটক করেছে।
এভাবে একের পর এক সোনা জব্দ ও উদ্ধারের ঘটনা ঘটছে। কখনো গাড়িতে বিশেষ কায়দায়, কখনো পেটের ভেতর, পায়ূ পথে বা নারীদের বিশেষ অঙ্গে, কখনো স্যান্ডেল-জুতার ভেতরে নানা কায়দায় এবং নানা পদ্ধতিতে সোনা পাচার করা হচ্ছে। অনেক সময় পরিত্যক্ত অবস্থায় কেজি কেজি সোনা ধরা পড়ছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কখনো কোনো পাচারের হোতা বা মূল আসমি আটক হয়নি, শাস্তিও হয়েছে বলে কেউ শোনেনি।
বিজিবি সূত্রের দাবি, সোনা চোরাচালান অতীতেও ছিল, এখনো আছে এবং যতদিন আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্রে সোনার চাহিদা ও দাম থাকবে ততদিন চোরাচালানের প্রচেষ্টাও থাকবে। আমাদের দেশের শুধু যশোর জেলায় ভারতের সাথে প্রায় একশ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এই সীমান্ত দিয়ে সহজেই সোনা পাচার করা যায়, তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যশোর হয়ে সোনা বেশি পাচার হয়। দেশের অন্য সীমান্ত দিয়ে চোরাচালন হলেও সোনা চোরাচালানকারীদের বড় একটা অংশ কোলকাতা কেন্দ্রিক । তা ছাড়া যশোরেও কয়েকজন পাচারকারী রয়েছে। পাচার হওয়া বা পাচারের জন্যে ব্যবহৃত সোনা কোনোটাই বাংলাদেশের নয়। এটি অন্য দেশ থেকে বাংলাদেশে এনে তা পার্শ¦বর্তী দেশে পাঠানো হয়। আমাদের দেশে সোনা বেচা কেনার ক্ষেত্রে নিয়ম কানুন অনেক কঠিন কিন্তু ভারতে তেমনটি নয়। ফলে পথের বিপদ, খোয়া যাওয়া, হারানো, ধরাপড়ার ভয় থাকা সত্বেও সহজে এবং দ্রুত অর্থ উপার্জনের পথ হিসেবে অনেকই সোনা চোরা চালানের সাথে জড়িয়ে পড়ছে।
চোরাচালান প্রতিরোধে কাজ করা একাধিক সূত্র জানায়, এক পিস স্বর্ণের বার দেশের কুমিল্লা, চট্টগ্রাম বা ঢাকা যে পথেই প্রবেশ করুক না কেন পাচার হয়ে ভারতে যাওয়ার জন্যে বিভিন্ন ভাবে ৩০ থেকে ৪০ জন কাজ করে। কেউ বাহক, কেউ লাইনম্যান, কেউবা ইনফরমার। আবার কেউ কেউ বাহক বা লাইনম্যান ও ইনফরমারের ওপর গতিবিধি অনুসরণের কাজও করে। প্রতিপিস বার পাচারের জন্য মুল হোতা পাচার কাজে নিয়োজিত একজনকে দায়িত্ব দেন। এজন্য তাকে দেয়া হয় ৩ হাজার টাকা করে । ঐ টাকার মধ্য থেকে বাহকসহ রাস্তায় নিয়োজিত ওয়াসম্যানদের মোট দেয়া হয় ১ হাজার টাকা করে। ওয়াসম্যানরা বিভিন্ন মোড়ে বা রুটে নির্দিষ্ট এরিয়ায় কাজ করেন। বিজিবি বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ আসছে কিনা বা ওই রুটে সামনে কোন বিপদ আছে কিনা সেটা নির্দিষ্ট একটি বা দুটি মোবাইল নম্বরে জানিয়ে দেয় তারা। এর আগের জন বা পরের জন কে তাও যেমন তারা জানে না, তেমনি মূল হোতা কারা তাও তাদের জানতে দেওয়া হয় না। তারা শুধু নির্দিষ্ট সময় ইনফরমেশন দিয়ে সহায়তা করে এবং তাদের ভাগের টাকা যথাযথভাবে বুঝে পায়। সে টাকাও গ্রহণ করতে হয় অপরিচিত মাধম থেকে। এজন্য মুল হোতারা থেকে যায় ধরা ছোয়ার বাইরে।
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীতে কাজ করা একাধিক সূত্র মনে করে, সোনা চোরাচালানে নগদ টাকার ছড়াছড়ি, এই কাঁচা টাকার মোহেই অনেক জড়িয়ে পড়েন সোনা পাচার কাজে। এক সময় সোনা পাচারের সাথে জড়িত বাহককে আটক করা হলে রিমান্ড পর্যন্ত চাওয়া হতো না। এখন রিমান্ড চাওয়া হলেও মামলা সাজানোর ক্ষেত্রে ত্রুটি রাখার অভিযোগ রয়েছে। সেই ত্রুটির ফাঁক দিয়েই পার পেয়ে যায় ধৃতরা।
এ ব্যাপারে জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু মোর্ত্তজা ছোট জানান, সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে আগে এক সময় বাহকদের রিমান্ড চাওয়া হতো না। এ ধরনের মামলায় স্থানীয় কোর্ট থেকে জামিনও হয় না।
এ বিষয়ে পাবলিক প্রসিকিউটর(পিপি) অ্যাড. মো. ইদ্রিস আলী বলেন, ‘গত ৩ বছর এখানে কোনো জামিন হয়নি, উচ্চ আদালত থেকে জামিন পায় অভিযুক্তরা। তিনি আরও জানান, এর আগে বাহাদুরপুর এলাকায় গাড়ি থেকে সাড়ে ১৫ কেজির অধিক সোনা আটক হয়। সে মামলায় গঠনগত ত্রুটি থাকার করণে ম্যাজিট্রেট আসামিদের রিমান্ড দেননি। পরে পিপির উদ্যোগে মামলাটি পুনরায় উত্থাপন করে আসামিদের রিমান্ড করানো হয়। ’এদিকে রিমান্ডে নেওয়ার পরও আজ পর্যন্ত কোনো বাহক মূল হোতাকে চিহ্নিত করেছে তার নজির নেই বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
এ ব্যাপারে ৪৯ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহেদ মিনহাজ সিদ্দিকী দৈনিক সমাজের কথাকে জানান, বর্তমানে বেশি ধরা পড়ছে মানে এই নয় যে চোরাচালান সম্পূর্ণ বন্ধ হয়েছে। অতীতে চোরাচালান ছিল এবং এখনো চলছে। এখন বেশি ধরাপড়ার কিছু কারণ আছে। তার মধ্যে যার নেতৃত্বে এটা করা হয় তার সোর্স মেইনটেনিং, কর্মপরিকল্পনা, দক্ষতা, আন্তরিকতা ও কৌশল অনেক কিছু জড়িত থাকে। সোর্সকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে অবশ্যই অনেক পদক্ষেপ নিতে হয়। তবে সোনা কোনো সস্তা পণ্য নয় যে এক চালান ধরিয়ে দিয়ে বড় বড় অন্য চালান সে সময় পাচার করবে। তিনি বলেন, সোনা সব সময় নানা উপায়ে পার হয়ে থাকে। একশ বার পাচার করতে পারলে বাহকরা ৩ লাখ টাকা পেয়ে থাকে। এই টাকার লোভে অনেকেই বাহক হিসাবে কাজ করছে।
নকল সোনা ধরিয়ে দিয়ে আসল সোনা পাচারের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বিজিবির এই কর্মকর্তা জানান, প্রতিটি চালান আটকের পর স্থানীয় স্বর্ণকারদের সমিতির মাধ্যমে তা পরীক্ষা করিয়ে ওজন করা হয়, শুদ্ধতা যাচাই করা হয়। এরপর নির্ধারিত হয় দাম। ফলে আটক সোনা নকল বলার কোন সুযোগ নেই। তিনি আরও জানান, দিন যত যাচ্ছে নগদ টাকা বা অন্য কোনো লোভে এতে জড়িত হচ্ছে বেশি বেশি লোক এবং কোনভাবেই গড ফাদারদের ধরা যাচ্ছে না। তিনি এ প্রসঙ্গে বেনাপোলের গোল্ড নাছিরের কথা উল্লেখ করে জানান, দুই বার তাকে ধরা হয়েছে কিন্তু তার কাছে বা তার বাড়ি থেকে কোনো সোনা উদ্ধার হয়নি বা এমন কোনো আলামত পাওয়া যায়নি যা দিয়ে তাকে আটকে রাখা যায়।
তিনি বলেন, সবার মুখে মুখে রয়েছে যে, নাছির সোনা চোরকাবারের সাথে জড়িত কিন্তু এর কোনো প্রমাণ নেই। তিনি আরও জানান, প্রতিবেশি রাষ্ট্রে এর বৃহৎ বাজার রয়েছে, চাহিদা ও লাভের কারণে পাচার বেশি হয়। বাহকরা টাকার জন্যে এ কাজে নামে এবং একটি নির্দিষ্ট কৌশলে এরা একজনের কাছ থেকে সংগ্রহ করে আর একজনের কাছে দেয়। এরা একে অপরকে চেনেও না। এ রকম নানা জটিলতায় প্রচুর সোনা ধরা পড়লেও গড ফাদার বা মূল হোতারা আটক হয় না।