অধ্যাপক মো. মসিউল আযম:
শহিদ লে. আনোয়ার জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৭ সালের ৫ মে চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার আলীগঞ্জ সরকারি এতিমখানা কোয়ার্টারে। তার নানা মরহুম এয়াকুব আলী ছিলেন এতিমখানার সুপার। শহিদ আনোয়ারের পৈত্রিক নিবাস চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলার সোনাপুর গ্রামে। পিতা আব্দুল হক ছিলেন পুলিশ বিভাগের একজন কর্মকর্তা। সাত ভাইবোনের মধ্যে আনোয়ার ছিলেন পিতামাতার দ্বিতীয় সন্তান।
১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন অফিসার পদে তিনি রিক্রুট হন। এরপর পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক প্রশিক্ষণ একাডেমি কাবুল হতে চূড়ান্ত পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হন এবং ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি সময়ে সেকেন্ড লে. হিসেবে যশোর সেনানিবাসে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করেন।
১৯৭১ সাল ৩০ মার্চের শেষ সপ্তাহে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা তখন যশোর চৌগাছা এলাকার জগদীশপুর এলাকায় গ্রীষ্মকালীন মহড়ায় ব্যস্ত ছিলেন। ঐ সময় তাদেরকে পাঠানো হলো সিগন্যাল ম্যাসেজ দ্রুত ব্যারাকে ফিরে আসার জন্য। ফিরে আসার পরপরই তাদেরকে করা হলো নিরস্ত্র। তরুণ অফিসার লে. আনোয়ারের তাজা খুন উঠলো টগবগিয়ে। জ্বালা ধরিয়ে দিলো তার অস্থিমজ্জায়। তিনি ভাবলেন এভাবে নিরস্ত্র হয়ে শিয়াল কুকুরের মত মরার চেয়ে লড়াই করে বীরের মত শহিদ হওয়া গৌরবের কাজ।
১৯৭১ সাল ৩০ মার্চ সকাল পৌনে দশটা বাঙালি সৈন্যরা প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করে যুদ্ধ শুরু করে পাকহানাদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। হানাদারবাহিনী যেখানে ওদের নিরস্ত্র করে অস্ত্র জমা রেখেছিল একটি হাতুড়ি নিয়ে সেখানে ছুটে গেলেন লে. আনোয়ার। তাকে অনুসরণ করলেন কয়েকজন বাঙালি সৈনিক। মুহুূর্তের মধ্যে অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে হাল্কা অস্ত্র নিয়ে তারা এলেন বেরিয়ে। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে এই অস্ত্র বের হওয়ার খবর পৌছে গেল ওদের হাই কমান্ডে। একই সময়ে আরেকজন সহযোদ্ধা তরুণ অফিসার লে: হাফিজ উদ্দীনও অস্ত্র তুলেনেন হানাদারদের বিরুদ্ধে।
একদিকে ভারী অস্ত্র অপরদিকে বিদ্রোহীদের হাতে সামান্য হাল্কা ধরনের অস্ত্র। তবুও বিদ্রোহী সৈন্যরা প্রানপণে লড়ছিলেন হানাদারদের বিরুদ্ধে। হঠাৎ একটি মেশিনগানের ব্রাশফায়ার এসে লেঃ আনোয়ারের তলপেট ও উরু ঝাঁঝরা করে দেয়। আহত অবস্থায় সঙ্গী সৈনিকের নিয়ে আসে সানতলা সেনানিবাসের পাশে ছাতিয়ানতলা গ্রামে। প্রচুর রক্তক্ষরণে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। পরে গ্রামের ৩ জন যুব ও সাথী সৈনিকেরা তার লাশ একটি গরুর গাড়িতে করে (গরুবিহীন) কাজী নজরুল ইসলাম কলেজ সংলগ্ন হৈবতপুর গ্রামে আনা হয়। পরে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে নামাজে জানাজা শেষে যশোর ঢাকা সড়কের ধারে একটি কড়ই গাছের ছায়ায় তাকে সমাহিত করা হয়। এখানেই ঘুমিয়ে আছেন চিরতরে বীর সৈনিক শহিদ লে. আনোয়ার।
১৯৭৩ হতে এই সুদীর্ঘ ৫১ বছরের স্মৃতি বিজড়িত ইতিহাস রয়েছে তা এই লেখার মধ্যদিয়ে আমি আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে চাই।
১৯৭৩ সাল। যশোর সেনানিবাসের তৎকালীন ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন লে. কর্নেল এম এ মঞ্জুর । তিনিই সর্ব প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন শহিদ লে. আনোয়ার হোসেনের মৃত্যু বার্ষিকী উদযাপন করার। ৩০ মার্চের কয়েকদিন পূর্বে যশোর সেনানিবাস কর্তৃপক্ষ থেকে আমাদের কলেজে খবরপাঠানো হয় আমাদের আগামী ৩০ মার্চ অনুষ্ঠেয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করার। লে. আনোয়ার হোসেনের ২য় মৃত্যুবার্ষিকী সেবার পালিত হয়। সেই হতে অদ্যাবধি প্রায় ৫০ বছর ধারাবাহিকভাবে যথাযোগ্য মর্যাদা সহকারে শহিদের মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপিত হয়ে আসছে।
১৯৭৩ সালের কথা। আমি তখন কাজী নজরুল ইসলাম ডিগ্রী কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি দৈনিক বাংলারবাণী পত্রিকায় যশোর জেলা প্রতিনিধির দায়িত্বে ছিলাম। শহিদ লে. আনোয়ার হোসেনের মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপনের সংবাদটি ছবিসহ দৈনিক বাংলারবাণী পত্রিকায় ছাপা হয়। উক্ত অনুষ্ঠানের সমস্ত আলোকচিত্র গ্রহণ করেন বিশিষ্ট আলোকচিত্র শিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা মোঃ শফি। আমার ও শফি ভায়ের সাথে লে. কর্নেল এম এ মঞ্জুরের খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমি যতবার সেনানিবাসে এম এ মঞ্জুরের সাথে সাক্ষাৎ করেছি ততবারই আলোকচিত্র শিল্পী মোঃ শফি ভায়ের খোঁজখবর নিয়েছেন।
যশোর সেনানিবাস হতে বদলী হওয়ার আগে তার সাথে সাক্ষাত করতে গেলে তিনি অধ্যক্ষ ও আমাকে বলেন আপনারা যে কোন সময় আমার কাছে আসবেন। আর লেঃ আনোয়ার এই অনুষ্ঠানকে সব সময় ধরে রাখবেন। এটি ছিল একজন সেনা কর্মকর্তা ও মুক্তিযোদ্ধার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন। আমরা আজও তার সেই অসিয়ত এখনও অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছি।
এরপর লেঃ কর্নেল এম এ মঞ্জুর বদলী হন ঢাকা সেনা সদর দপ্তরে। ঢাকা গেলে সময় পেলেই তার সাথে সাক্ষাত করতে ভুলতাম না। উনি খুবই সমাদর করতেন। একবার অধ্যক্ষ ইব্রাহিম হোসেন ও আমি ঢাকা সেনানিবাসে স্টাফ রোডে বাসভবনে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য গিয়েছিলাম। তিনি আমাদের যে সম্মান ও অমায়িক আচরন করেছিলেন তা কোন দিন ভোলার নয়। সাক্ষাত পর্ব শেষে তিনি আমাদের নিজে গাড়ী চালিয়ে ঢাকার গন্তব্যস্থলে নামিয়ে দিয়ে যান। উনি তখন ব্রিগেডিয়ার। এতবড় একজন উচ্চপদস্থ সেনা আফিসার হওয়া সত্বেও আমাদের প্রতি যে সম্মান দিয়েছিলেন তা চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে স্মৃতির মনি কোঠায়।
লেখক: প্রবীন সাংবাদিক