মিলন রহমান : রাকিব ক্লাস থ্রিতে উঠেছে। যশোর এমএম কলেজের পাশে অংকুর স্কুলে পড়ে। সকালে স্কুলে যায়, আর বিকেলে ফুল বিক্রি করে। রাকিবের মা প্লাস্টিক কারখানায় কাজ করে।মা-ছেলের আয়ে কোন রকমে সংসার চলে যায়।
স্কুল থেকে ফিরে বিছানায় শুয়ে পড়ে রাকিব। নানান ভাবনা ভিড় করে তার মাথায়। স্কুল তার কাছে খুব মজার। স্যার-আপা’রা কত সুন্দর করে পড়ায়। পড়তে তার খুব ভাল লাগে।শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে বড় হয়ে মস্ত বড় মানুষ হবে। তার অনেক সুনাম হবে। তখন মা’কে আর কাজ করতে দেবে না। মা’কে মাথায় করে রাখবে।
এই তো সেদিনের কথা। দেখতে দেখতে কেটে গেছে তিন বছর। এর আগে রাকিব স্কুলে যেতো না। সারাদিন ফুল বিক্রি করতো। কখনও এমএম কলেজ ক্যাম্পাসে, কখনও পৌরপার্কে; আবার কখনও বা ঈদগাহ, টাউন হল ময়দানে।ফুলের ঝুড়ি নিয়ে ঘুরতো পথে পথে। এমনি একদিন ফুল নিয়ে রাকিব অংকুর স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কী সুন্দর! তার মতই ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা ক্লাস করছে। মন ভারী খারাপ হয় তার। মনে হয়Ñ ইস! সেও যদি স্কুলে পড়তে পারতো।বাবা নেই বলে তার মা’কে কাজ করতে হয়। আর রাকিবকে ফুল বেচতে হয়। তা নাহলে যে ভাত জোটে না! তাই ইচ্ছেরা মনের ভেতরে ঘুরপাক খেলেও উপায় দেখতে পায় না। রাকিব ভাবনার মধ্যে হারিয়ে যায়। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। চমক ভাঙ্গে রাকিবের। তার মায়ের মতো একজন মহিলা তার হাত ধরে স্কুলের অফিসরুমে নিয়ে যান।নাম জানতে চান, বাড়ি কোথায়Ñ জিজ্ঞেস করেন। নিজের নাম বলে রাকিব জানায়, পাশেই বস্তিতে সে আর তার মা থাকে।
মহিলাটি রাকিবকে বলেন, ‘আমি স্কুলের বড়আপা! তোমার কি স্কুলে পড়তে ইচ্ছে হয়?’
রাকিব যেনো আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। বলে, ‘জ্বি আপা, স্কুলে পড়ার আমার খুব শখ!’
বড় আপা বলেন, ‘তাহলে তোমার মা’কে আমার সাথে দেখা করতে বোলো।’
দু’দিন পরই রাকিবের মা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সাথে দেখা করেন। তিনি রাকিবকে স্কুলে ভর্তির জন্য তার মা’কে অনুরোধ করেন। প্রথমে রাকিবের মা আপত্তি করে বলেছিল, ‘আমরা দুইজন যা আয় করি তাই দিয়ে পেট চলে। ও ফুল বেচা বাদ দিলি খাবো কি কইরে?’
প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘রাকিবকে তো ফুল বেচা বাদ দিতে বলিনি। ও সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত স্কুলে পড়বে।বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ফুল বেচবে। রাতে আবার বাড়ি পড়বে। লেখাপড়া শিখতে পারলে ও আর ভাল কাজ করতে পারবে। আর স্কুলের জন্য কোনো খরচ তাদের দিতে হবে না।’
এমন আশ্বাসে রাজী হয়ে রাকিবকে স্কুলে ভর্তি করে দেন তার মা। সেই শুরু। তারপর থেকে শিশু, ওয়ান, টু পাস করে এবার সে থ্রি’তে উঠেছে। ফুল বিক্রি আর লেখাপড়া একসাথে চলে তার। দারুন মেধাবী। স্কুলের আপারা খুব আদর করে লেখাপড়া শেখায়। ক্লাসে তার রোল তিন।
ভাবনার জগত থেকে ফিরে আসে রাকিব। গা ঝাড়া দিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়ে। মা সকালে ভাত রান্না করে রেখে গেছে। কয়টা ভাত খেয়েই ফুল নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। কালকে স্কুল ছুটি। বাংলার আপা পড়ানোর সময় বলছিলেন, ‘আগামীকাল একুশে ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের এই দিনে বাংলা ভাষার জন্য অনেকে পাকিস্তানিদের গুলি খেয়ে শহীদ হয়েছেন।সারাদেশের মানুষ এদিন শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে তাদের শ্রদ্ধা জানাবে।’ রাকিব মনে মনে ভাবে, ‘কাল সেও শহীদ মিনারে যাবে।’ ভাত খেয়ে ফুল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে রাকিব।
একুশে ফেব্রুয়ারি। স্কুল বন্ধ। সারাদিনই ফুল বিক্রি করবে রাকিব। কিন্তু তার আগেই এমএম কলেজে শহীদ মিনার থেকে ঘুরে আসতে হবে।
খুব সকালেই রাকিব শহীদ মিনারের দিকে যায়।শহীদ মিনারের রাস্তা জুড়েই অনেক ভিড়। ভিড় ঠেলে কলেজের গেট পর্যন্ত গেলেও ভিতরে আর ঢুকতে পারে না। অগত্যা মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে আসে। কয়টা ভাত মুখে দিয়েই ফুল নিয়ে বিক্রি করতে বের হয়ে যায়।
ফুল বিক্রি করতে করতে রাকিব পরিকল্পনা করে, একটু বেলা বাড়লে আবার শহীদ মিনারে যাবে। দুপুর বারোটার দিকে ফুলের ঝুড়ি নিয়েই শহীদ মিনারের কাছে যায় রাকিব। শহীদ মিনারে ভিড় নেই। শহীদ বেদী ফুলে ফুলে ঢাকা। পাশেই কয়েকজন পুলিশ বসে আছে। শহীদ মিনারের সিঁড়ির কাছে যেতেই এক পুলিশ লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে।
বলে, ‘ফের ফুল চুরি করতে এসেছিস্। ভাগ্।নইলে লাঠি দিয়ে মেরে ঠ্যাং ভেঙ্গে দেবো।’
দাঁড়িয়ে যায় রাকিব। পুলিশ এসে তার ঘাড় ধরে। রাকিব বললো, ‘স্যার, আমি ফুল চুরি করতি আসিনি। শহীদ মিনারে একটা মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবো বলে আইচি।’
থমকে যান পুলিশ কনস্টেবল। তার চোখেমুখে অবিশ্বাস। বলেন, ‘কই দেখি তোর মালা?’
রাকিব ঝুড়ির তলা থেকে ফুল দিয়ে বানানো একটি মালা বের করে। গতরাতে সে মালাটি তৈরি করেছিল।বিভিন্ন ফুল দিয়ে মালাটি গেঁথে তার মধ্যে রফিক, শফিক, জব্বারের ছবিও জুড়ে দিয়েছে। পত্রিকা থেকে ছবিগুলো কেটে কেটে সংগ্রহ করেছে সে।
মালা দেখে বিশ্বাস হয় পুলিশ কনস্টেবলের। তিনি রাকিবকে ছেড়ে দেন। বলেন, ‘দাঁড়া বাবা, জুতোটা খুলে নিই। তোর সাথে আমিও শহীদ মিনারে ফুলের মালাটা দিই। হাজার হাজার মানুষ তো ফুল দিয়েছে। তোর মত ভালবাসা নিয়ে ক’জন এসেছিল রে!’
গলাটা ধরে আসে কনস্টেবলের, ভিজে ওঠে চোখ!