২৭শে এপ্রিল ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ফিরে দেখা ।। ফাহমিদা ইয়াসমিন
106 বার পঠিত

কাশির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় রায়হানের। কাঁচাঘুম ভেঙে গেলেও খারাপ লাগে না আগের মতো। হাই তুলতে তুলতে বিছানা ছাড়ে। জানালা দিয়ে নরম রোদ এসে বালিশ ছুঁয়েছে। সেদিকে খেয়াল নেই তার। চোখ পড়লে বুঝতে পারতোÑ বালিশ তার সঙ্গ চাইছে। রায়হান চোখ কচলাতে কচলাতে ছোটঘরের দিকে এগিয়ে যায়।
নামাজে দাঁড়াতে আর ছোট ঘরে যেতে এখন যতো ভয় রায়হানের। এই দুই জায়গাতে হাজির হলেই দুনিয়ার সব চিন্তা ঘিরে ধরে তাকে। চিন্তাগুলো দুশ্চিন্তা হয়ে আগ্রাসন চালায়। মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার কথা। শৈশবে একবার মৌমাছির চাকে ঢিল মেরেছিল। আর যায় কোথায়! ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছিরা তার পিছু নিয়েছিল। কী করবে জানা ছিল না। এখন নামাজে দাঁড়ালে কিংবা ছোটঘরে গেলে সেদিনের মৌমাছিদের মতো দুশ্চিন্তারা পিছু ছোটে।

দুশ্চিন্তার তাড়া খেয়ে হাঁফিয়ে উঠেছে রায়হান। বেকারত্বের জীবন। এমন জীবনে প্রতি মুহূর্তেই হতাশার। সেই হতাশার মধ্যে যোগ হয়েছে দুশ্চিন্তা। সব মিলিয়ে দুর্বিসহ। একটিকে কাটিয়ে ধরা পড়তে হয় আরেকটির কাছে। প্রতিনিয়ত এক একটা সৈনিক মাছি আঘাত করে চলেছে যেনো।

ছোট ঘর থেকে ফিরে নামাজ পড়ে রায়হান। গুটিগুটি পায়ে মায়ের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। মা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। গভীর ঘুমেও অনবরত কাশি দিয়ে যাচ্ছে। এজমার সমস্যা। কাশি অনেক বাড়লে ঘুম আসে না। আজ ঘুমাচ্ছে। অনেক ক্লান্তিতে ঘুমাচ্ছে। এই ক্লান্তি ধীরে ধীরে তার মাকে পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
মায়ের কপালে হাত রাখে রায়হান। হাত বুলাতে বুলাতে চলে যায় স্মৃতিতেÑ ভোরে মায়ের কোরআন তেলাওয়াতের সুমিষ্ট সুরে ঘুম ভাঙতো। আজও একই সময়ে ঘুম ভেঙেছে। কিন্তু মায়ের কোরআন তেলায়াতে না, অভ্যাসে। অনেক কষ্ট সহ্য করেছে মা। দাদীর কষ্ট, বাবার কষ্ট। কতো যে কষ্ট, তার হিসাব মা-ও দিতে পারবে না। কিছু কিছু জানে প্রতিবেশিরা, আর জানেন ওই ওপরের রাজা।

রায়হানের নানাবাড়ির সম্পত্তির ভাগ নিয়েই শুরু। ভাইদের দিয়ে দিলো তার মা। এরপর থেকে বয়ে গেলো নির্যাতনের সুনামি, টর্নেডো, আমফান। যারা দেখেছে তাদের চোখে সমুদ্র নেমে এসেছে। ভাবতে ভাবতে রায়হানের চোখ ভিজে এলো। ভেজা চোখ ধুয়ে নেয় তার কষ্টগুলো। ফোটায় ফোটায় পড়তে থাকে মায়ের চোখে-মুখে। ঘুম ভেঙে যায় মায়ের। চোখ মেলে ছেলেকে পাশে দেখে মায়ের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কাশতে কাশতে চোখ বুজে আসে, তবু ছেলেকে দেখার ইচ্ছায় টান করে রাখে। লাল হয়ে ওঠে মুহূর্তেই। সম্ভবত কঠিন অসুস্থতায় সব মায়েরা সন্তানকে সবচেয়ে বেশি কাছে পেতে চায়। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ভুলে গিয়ে শুধু সন্তানকে কাছে টানতে চায়। সন্তানের আগের সব ভুল, সব অন্যায় তুচ্ছ হয়ে ওঠে।
মায়ের সাথে খুনসুটি শুরু করে রায়হান। এরই এক ফাঁকে বৃহস্পতিবারের পরীক্ষার কথা জানায়। চাকরির পরীক্ষা। ঢাকায় যেতে হবে। শুনে মা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়।

দেখতে দেখতে বৃহস্পতিবার চলে আসে। গ্রাম থেকে এই প্রথম শহরের বাইরে যাচ্ছে রায়হান। মাকে বাড়িতে একা রেখেই যেতে হচ্ছে, কিন্তু মন সাঁই দিচ্ছে না। তবুও জীবনের তাগিদ তাকে যেতে বাধ্য করছে। স্বার্থপরের মতো যেতে হচ্ছে।

মাকে রেখে বাইরে পা বাড়াতেই রায়হানের মনে হলোÑ পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষই মূলত একা। স্বার্থের প্রয়োজনে কিছুটা সময় সঙ্গ পেলেও একাকীত্ব ঘোচাতে পারে না। রায়হান কিংবা তার মা-ও পারছে না। একটা টান পেছন থেকে টেনে ধরলেও পারছে না।

খুব সকালেই স্টেশনে পৌঁছে রায়হান। সূর্যের নতুন আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে। সবুজ তরতাজা ঘাস সে আলোয় আরও সবুজ হয়ে ধরা দিচ্ছে। দুলে দুলে বইছে হালকা হাওয়া। নারিকেলের পাতায় তা লেগে ঝিরঝির করে উঠছে। আর তালের পাতায় তুলছে মিষ্টি একটা সুর। স্টেশনের পাশেই একটা পরিত্যক্ত ঘর। সেখান থেকে ভেসে আসছে কবুতরের বাকবাকুম বাকবাকুম শব্দ। বেশ কিছু সাদা পায়রা ওড়াউড়ি করছে। একটু দূরেই পুকুরের জলে ভেসে উঠা কলাগাছে নীরব মনে বসে আছে মাছরাঙা।

সবকিছুরই একটা আগমনী বার্তা থাকে। অতিথিকে স্বাগতম জানাতে চারিদিক থেকে অনুসারীও যেনো তার আগমনের পরিবেশ তৈরি করে। সেটা ভালো হউক বা খারাপ, পাপের হউক বা পূণ্যের। আর এ তো সূর্য। আঁধারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজের উদারতায় রাতকে পরিণত করে দিনে। রাতের রানী চাঁদকে পরম যতেœ অন্দরে গুছিয়ে রেখে ঘটে আগমন। যার আগমনে আজ একটু অন্যরকম উৎফুল্লতা দেখতে পেলো রায়হান। এতসবের মধ্যে রায়হানের মন পড়ে আছে মায়ের কাছে। বারবার ভাবনারা দোলা দিচ্ছে। ভাবছেÑ মা নিজে নিজে ওষুধ খেতে পারবে তো? ঠিকঠাক খাওয়া-দাওয়া করবে তো? ভাবতে ভাবতে বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ^াস বেড়িয়ে আসে। চোখজুড়ে থাকে উদাস করা দৃষ্টি।

স্টেশনটিতে সব ট্রেন থামে না। তবু মানুষের যাতায়াত নেহায়ত কম না। আলো বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে আনাগোনা। মানবমুখর হচ্ছে চারদিক। তারই একপাশে বসে আছে রায়হান। মায়ের চিন্তায় যখন সে আচ্ছন্ন, তখন বারো তেরো বছরের এক শিশু কাছে এসে বলেÑ স্যার, বাদাম নেবেন? ও স্যার নেবেন? খুবোই টেস্ট। নগদ ভাইজ্যা আনলাম। শুনে দূর থেকে কেউ কথা বলছে মনে হলো রায়হানের। পরে গায়ে অনেকটা ধাক্কা দিয়ে ছেলেটি বললোÑ কতা কন না ক্যান গো স্যার? নেবেন। দামও কম। খাইয়্যা দ্যাহেন। মজা পাইবেন।
সম্বিত ফিরে পেলো রায়হান। ছেলেটির দিকে তাকালো। মিষ্টি চেহারার মলিন মুখ। বোঝাই যাচ্ছে, ঠিকঠাক খেতে পায় না। থাকার জায়গাতেও রয়েছে বিপত্তি। ছেলেটির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে রায়হান বললোÑ
‘দাও তো দশ টাকার। লবণও দিও।’
‘এই লন ভাইজান।’

রায়হান ছেলেটিকে কাছে ডাকলো। বাদাম নিতে নিতে ছেলেটির কপাল থেকে চুল সরিয়ে দিয়ে নাম জিজ্ঞেস করলো। ছেলেটি কেমন ছটফট করছে। পেছন থেকে অনাহুত কেউ তাড়া করলে যেমন হাসফাস করে, তেমন। রায়হান বাদামের খোসা ছাড়িয়ে একটা তাকে দিলো। এরপর বললো, ‘তুমি তো এখানে বাদাম বিক্রি করো, কতোক্ষণে ট্রেন আসবে বলতে পারো?’

ছটফটানি ধরে রেখেই ছেলেটি বললো, ‘এইডা ভাইজান বলা মুশকিল। কেউই কইতে পারবো না। ছয়ডায়ও আহে, সাতটায়ও আহে। ঠিক-ঠিকান নাই। আজগা ফের কহোন আইবো, কে জানে?’
আচ্ছা ঠিক আছে। এখন বলোতো তোমার নাম কী?

‘শরীফ। তয় কেউ কেউ শরীফবিল্লাহ কয়’, বলে আর বাঁধা থাকতে চাইলো না শরীফ। ‘ট্যাকা দ্যান ভাইজান। যাইতে অইবো। হেরপর আরও অনেকে বাদাম বেঁচতো আইয়্যা পড়বো। তহোন বেশি লাভ হইবো না।’
শরীফের ছটফটানী এতোক্ষণে বুঝলো রায়হান। ওর সাথে কথা বলতে ভালো লাগছিলো। টাকা দিতে দিতে বললো, ‘একটা কথা বলি?’ চোখ ভরা তার কৌতুহলবশত। বুঝে নিলো শরীফ। বললো, ‘বলেন।’
‘তুমি এতো অল্প বয়সে বাদাম বিক্রি করো কেনো? তোমার মাÑবাবা কোথায়?’

‘বাবায় মায়রে অকাম কইরা আমারে পয়দা করছে। তয় মায়ে বুঝতে পাইছে আমি বাইচা থাকলে হেতির বিয়ে হইবো না। তাই ওই যে ডাস্টবিনটা দেখেন, সেখানে ফালাই দিছিলো। পরে কিডা জানি টাইন্যা তুলছিলো। আমার কান্দোন তারে মায়া জাগাইছিলো। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তুইল্যা এইহানে রাইখ্যা সেও চইল্যা যায়। পরে এইহানের মানুষরা আমারে কোলে পিঠে এতদূর আনছে। এসব আমার হুনা কথা। নিজের ছোটবেলা নিজে দেহি ক্যামনে?’ এ পর্যন্ত বলে একটা দীর্ঘশ^াস নেয় শরীফ। আবার বলতে শুরু করে, ‘আগে ভিক্ষা করতাম, চুরি করতাম। অনেক ট্যাকা পাইতাম। হেই ট্যাকায় ড্যান্ডি খাইতাম। পরে এক স্যারে আমারে একদিন ডাকলো। কাজ করবার কথা বললো। জীবন শিহাইলো। হের পর এগুলান কিইন্যাও দিলো। অহোন আমি বাদাম বেইচ্যা খাই’ বলে রায়হানকে বললো, ‘আর কিছু জানতে চাইলে বলেন ভাইজান, তাড়া আছে। প্যাট মানে না। বাদাম বেচতে অইবো।’

শরীফকে বিদায় জানায় রায়হান। ফের মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। তার জন্মের পরেই বাবা মারা যান। কতো না কষ্টে এপর্যন্ত এনছে তাকে। সহ্য করা সেই সব কষ্ট নানা রোগ হয়ে বাসা বেঁধেছে মায়ের শরীরে। সেই মাকে ছেড়ে শহরে কিভাবে রাত কাটাবে! রায়হানের চোখ জলে ভরে ওঠে। বৃষ্টির ফোটা হয়ে টপটপ ঝরতে থাকে। সেই ফোটা ভিজিয়ে দেয় উত্তপ্ত বুক।

চোখের বৃষ্টি আর আকাশের কান্না এক হয়ে যায় মুহূর্তেই। এরই মধ্যে ট্রেন আসে। মাথায় দেওয়ার জন্য এদিক ওদিক কিছু খুঁজলে লাগলো রায়হান। এরই মধ্যে হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিলো। ছাউনি থেকে দৌড়ে কোনমতে ট্রেনে ওঠে রহিম। তার পেছনে পেছনে শরীফও উঠতে চেষ্টা করে। এক হাতে বাদামের ঝুড়ি সামলে আরেক হাতে ধরে ফেলে হাতল। কিন্তু লোহার ভেজা হাতল ফসকে পড়ে যায় তার পাতলা দেহ। খন্ড খন্ড হয়ে যায় শরীফের দেহ।

ট্রেন এগিয়ে যায়। জানালা দিয়ে যতোদূর দেখা যায় তাকিয়ে থাকে রায়হান। চোখে পড়ে জনতার ভিড়। বেশিদূর মন টেকে না। পরের স্টেশনেই নেমে পরে। হাঁটতে থাকে ফিরতি রেললাইন ধরে। অগণিত শরীফের কাছে ফিরতে হবে তাকে…

সম্পাদক ও প্রকাশক : শাহীন চাকলাদার  |  ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আমিনুর রহমান মামুন।
১৩৬, গোহাটা রোড, লোহাপট্টি, যশোর।
ফোন : বার্তা বিভাগ : ০১৭১১-১৮২০২১, ০২৪৭৭৭৬৬৪২৭, ০১৭১২-৬১১৭০৭, বিজ্ঞাপন : ০১৭১১-১৮৬৫৪৩
Email : samajerkatha@gmail.com
পুরাতন খবর
FriSatSunMonTueWedThu
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
2627282930 
স্বত্ব © samajerkatha :- ২০২০-২০২২
crossmenu linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram