২৫শে এপ্রিল ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
একাত্তরের স্মৃতি বিজড়িত ঝিকরগাছা শিমুলিয়া মিশন

শাহ জামাল শিশির, ঝিকরগাছা (যশোর) ॥ আমাদের মিশনের অনেকগুলো গরু ছিল, গরু চরাতো সোনা সরকার। সেদিন মাঠে গরু চরাতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি সে। কেও বলে মিলিটারির গুলিতে গরু মরেছিল আবার কেও বলে সোনা সরকার মিশনের লোকজনের খাওয়ানোর জন্য গরু জবাই করেছিল। মাংস কাটার ব্যস্ততম সময়েই চলে আসে মিলিটারি, সাথে ছিল একজন রাজাকার। বলা নেই কওয়া নেই ঠাস ঠাস গুলি। বিশাল গর্তে সোনা সরকারের নিথর দেহটা ফেলে দেয়া হয়। এরপরই গ্রামে আতংক ছড়িয়ে পড়ে , আমরা সবাই ভারতে চলে যায়। কেও পায়ে হেটে, কেও বেতনা নদী দিয়ে নৌকায়। কুড়ুলিয়া হয়ে কৃষ্ণনগর তারপর জিয়াগঞ্জ, এরপর একেকজনের ঠিকানা একেক ক্যাম্পে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে কথাগুলো বলছিলেন বয়সের ভারে নেতিয়ে যাওয়া অনিল বিশ্বাস। বর্ননা করছিলেন কীভাবে একাত্তরে শিমুলিয়া মিশনপাড়ার খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ দেশ ছেড়ে ভারতে উদ্ভাস্তু হয়েছিল।

যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের পাশে ঝিকরগাছা উপজেলার বেনেয়ালি গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাম্প বানিয়েছিল। মূলত এই ক্যাম্প পাহারা দিত কিছু রাজাকার। তারা গাড়ি থামিয়ে মানুষজনকে তল্লাশী করতো। মাঝেমধ্যে খানসেনারাও আসত সেখানে। মুক্তিবাহিনী এই অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে দাবি করলেও পাক সেনাদের নিয়মিত যাতায়াত লক্ষ্য করা যেত এই অঞ্চলে।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ১৮৫৫ সালে ক্যাথলিক মিশনারীরা ধর্ম প্রচারের জন্য আসেন এই অঞ্চলে। তারা অনেককেই খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি আকর্ষিত করে ধর্মান্তরিত হন। তাদের প্রার্থনার সুবিধার্থে ‘চার্চ অব আওয়ার লেডী অব দ্যা রোজারি’ নামের একটা উপসনালয় স্থাপন করা হয় ১৮৮৩ সালে। এছাড়া সেন্ট লুইস নামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। ১৯৭০ সালে এই অঞ্চলের মানুষের জ্ঞানার্জনের জন্য সেন্ট লুইস মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়।

একাত্তরে শিমুলিয়া মিশনের ফাদার কোব্বেসহ সকলেই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পৃষ্টপোষক। গির্জায় ছিল মুক্তিবাহিনীর যাতায়াত। সেখবর অবশ্য রাজাকার বাহিনীর কানেও পৌঁছে গেছিল। গির্জার পাশেই দুই রাজাকারকে হত্যা করে মুক্তিবাহিনী। এইবার পাক মিলিটারির আগমন। মারকো ছিলেন মিশনের একজন সাহায্যকারী। মুসলমানদের মত বড় দাঁড়ি থাকার কারণে স্থানীয়রা তাকে দেড়ে মারকো বলেই ডাকতেন।
মিশনপাড়ার নিলু মৃধা জানান, মারকো প্রতিদিন মিশনের লোকজনের জন্য খাবার আনতে যেত। মিশনের লোক হিসেবে তার বাইরে যাতায়াতের অনুমতি ছিল। দুই রাজাকার হত্যাকা-ের জেরে মিশনকে দায়ী করা হয়। গীর্জার পাশে বটতলায় মারকোকে গুলি করে হত্যা করে মিলিটারি, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে লাশ ফেলে রাখে দূরের ধানক্ষেতে। এই ঘটনার জেরে আশেপাশের অনেক গ্রামও পুড়িয়ে দেয়া হয়, অনেক মানুষও হত্যাকা-ের শিকার হয়। পুরো ঘটনায় হতবিহ্বল হয় পড়েন গীর্জার ফাদার ভ্যালেরিয়ান কোব্বে। মিশনের সকলকে ভারতে পাঠিয়ে নিজে থেকে যান গীর্জায়। তার সঙ্গী হিসেবে ছিলেন ফাদার সেসি। মিশনের ত্রিশটা মেয়ের সম্ভ্রম রক্ষার দায়িত্ব যে ফাদারকেই নিতে হবে। দেড় হাজার খ্রিস্টানের জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবেই সকলকে তিনি ভারতে যাওয়ার অনুমতি দেন।

শিমুলিয়া মিশনে পাক হানাদার কিংবা রাজাকার বাহিনীর অত্যাচারের হাত থেকে বিদেশিরাও রক্ষা পায়নি। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় অবরুদ্ধ বাংলাদেশে রিলিফ প্রদানের জন্য কম্বলের গাঁট নিয়ে ভারত হয়ে ব্রিটিশ নাগরিক গর্ডন স্ল্যাভেন হাজির হয়েছিলেন শিমুলিয়া মিশনে। সাথে ছিলেন তার সাংবাদিক বান্ধবী মার্কিন নাগরিক অ্যালেন কনেট। অবৈধভাবে সীমানা পাড়ি দিয়ে অনুপ্রবেশের দায়ে মিলিটারিরা তাদের মিশন থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পেছনে অবশ্য অন্য কারণও ছিল। অভিযোগ ছিল তারা যুদ্ধবিরোধী স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম ‘অপারেশন ওমেগা’র সদস্য। এজন্য ৭১ এর অক্টোবরে গ্রেফতার করে দুইবছরের কারাদ- দেয়া হয়। অবশ্য ৭ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হওয়ার পরে মুক্তিবাহিনী তাদের মুক্ত করে।

সম্পাদক ও প্রকাশক : শাহীন চাকলাদার  |  ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আমিনুর রহমান মামুন।
১৩৬, গোহাটা রোড, লোহাপট্টি, যশোর।
ফোন : বার্তা বিভাগ : ০১৭১১-১৮২০২১, ০২৪৭৭৭৬৬৪২৭, ০১৭১২-৬১১৭০৭, বিজ্ঞাপন : ০১৭১১-১৮৬৫৪৩
Email : samajerkatha@gmail.com
পুরাতন খবর
FriSatSunMonTueWedThu
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
2627282930 
স্বত্ব © samajerkatha :- ২০২০-২০২২
crossmenu linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram