তহীদ মনি : যশোরের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক ভবন কোনটি? এ প্রশ্নের উত্তরে সবাই একবাক্যে বলবেন যশোর কালেক্টরেট ভবন। যশোর প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু এ ভবনটি সম্প্রতি পেয়েছে আরো নান্দনিক রূপ। মোহনীয় রং, বর্ণিল আলোক ছটার সাথে দেওয়াল জুড়ে ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রকাশ দর্শনার্থীদের দিচ্ছে প্রশান্ত মন। তবে গোটা ভবনের সব সৌন্দর্য ¤œান করে দিচ্ছে পূর্বপাশে রক্ষিত মামলার আলামত। বছরের পর বছর রোদ বৃষ্টির মাঝে পড়ে থাকা আলামত রীতিমত জঞ্জালে পরিণত হয়েছে। ভবনের সৌন্দর্যহানিকর এ আলামতগুলো আদালতের এখতিয়ার ভুক্ত হওয়ায় কর্তৃপক্ষ কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
ব্রিটিশ ভারতের প্রথম জেলা যশোর। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শত্রুমুক্ত জেলাও যশোর। দেশের প্রথম ডিজিটাল জেলাও যশোর। সেই যশোরের কালেক্টরেট ভবনটি যেমন পুরাতন, তেমনি ঐতিহ্যমণ্ডিতও। ৩৬০ দুয়ারী হিসেবে পরিচিত ভবনের চারপাশেই আঙ্গিনা। এক সময় এ ভবনের ৩ পাশের বারান্দা ছিল নেশাখোর, ভিক্ষুক, নিশিবধূ, পকেটমারদের দখলে। সেখানে সন্ধ্যার পরই দেখা যেতো অন্য রকম চিত্র। আবর্জনাময় পুকুরটির চারপাশে এক সময় ছিল মানুষ সমান আগাছা। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রথমে পুকুর পাড় আগাছা মুক্ত করা হয়। হয় পুকুর সংস্কারও। স্বচ্ছ পানির দেখাও মেলে। রাতে করা হয় আলোর ব্যবস্থা । বারান্দার সব অবাঞ্ছিত লোকজন সরিয়ে, মুক্ত উদ্যানে হাটাহাটির সুযোগ তৈরি করা হয়। উত্তরদিকের জংলা পরিবেশও করা হয় পরিচ্ছন্ন। সেখানে গড়ে ওঠে নান্দনিক পার্ক। বাড়ে মানুষের আনাগোনা। নাগরিক জীবনের ক্লান্তি মুছে দিতে বিভিন্ন বয়সের লোকজন ভিড় করতে থাকে ওই পার্ক ঘিরে। এটির ইতিবাচক দিক জেলা প্রশাসনকেও নাড়া দেয়।
সময়ের প্রয়োজনে চাকরি সূত্রে অনেকে এসেছেন যশোরে, দায়িত্ব পালন শেষে আবার চলেও গেছেন। কিন্তু হাতেগোনা কিছুসংখ্যক জেলা প্রশাসক আজও যশোরবাসীর হৃদয়ে অমলিন হয়ে আছেন। তারা ব্যতিক্রম ও নান্দনিক উদ্যোগের মাধ্যমে যশোরের সুনাম উজ্জল করেছেন। প্রশাসনিক ধরাবাঁধা কর্মসূচির মাঝেও নিয়েছেন ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। মেধা ও মননকে কাজে লাগিয়ে মানুষের চিত্তকে দিয়েছেন ভাবনার খোরাক। এমনই একজন জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খান। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর রুটিন কাজের পাশাপাশি যশোরকে অনন্য উচ্চতায় পোঁছে দিতে নান্দনিক কিছু উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছেন। এর মধ্যে জেলার শিক্ষা-শিল্প সংস্কৃতির বিকাশ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে মেধাবী উদ্যোগগুলো ইতোমধ্যে সর্ব মহলে প্রশংসিত হয়েছে। এসব কাজের জন্য তিনি মানবিক জেলা প্রশাসক হিসাবেও স্বীকৃতি পেয়েছেন। করোনাকালীন সময়ে তিনি ভিন্নভাবে আবির্ভূত হয়েছেন যশোরবাসীর কাছে। সেবা ও তাৎক্ষণিক বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর নজির স্থাপন করে সব শ্রেণির মানুষের কাছে সুনাম কুড়িয়েছেন। সুশাসন ও দুর্নীতিমুক্ত গতিশীল জেলা প্রশাসন বাস্তবায়নে জিরো টলারেন্স নীতি পালন করেছেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সাড়া জাগানো এলেন গিন্সবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ এর ঐতিহ্য এতকাল মানুষের মুখে মুখে অথবা বইয়ের পাতায় থাকলেও তার দৃশ্যমান কোনো রূপ ছিল না যশোরে। মো. তমিজুল ইসলাম খান প্রথম কোনো জেলা প্রশাসক যিনি এটির দৃশ্যমান রূপ দিয়ে যশোরকে আবারো ইতিহাস-ঐতিহ্যের ঠিকানায় পৌঁছে দিয়েছেন। কালেক্টরেট ভবনেই টেরাকোটায় ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ ফুটিয়ে তুলেছেন। কালেক্টরেট ভবনের বর্ণিল সাজসজ্জা ও আলোকসজ্জায় বদলে গেছে দৃশ্যপট। এখন শহরমুখি মানুষ দূর থেকে পরিচ্ছন্ন্ ঝকঝকে লাল ভবনটি দেখতে পান। রাতে আলোকমণ্ডিত ভবনের রূপ নগরের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। বর্ণিল আর্কিটেকচারাল আলোকসজ্জায় রাতে মোহনীয় রূপ ধারণ করে যশোরের ঐতিহ্যের প্রতীক এ ভবনটি। তিনি শিক্ষা, শিল্প ও সাংস্কৃতিক কাজের মধ্যে দিয়ে নান্দনিক জেলা প্রশাসক হিসেবে মানুষের কাছে স্বীকৃতি পেয়েছেন। সাংস্কৃতিক সংগঠন ও কর্মীদের সর্বাত্মক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
২০২০ সালের আগস্টে যশোরের জেলা প্রশাসক পদে যোগদান করেন মো. তমিজুল ইসলাম খান। তার নান্দনিক কর্মকাণ্ডের পরশে নতুনরূপ পেয়েছে যশোর কালেক্টরেট ভবন। ভবন চত্বরে পার্ক ফিরে পেয়েছে প্রাণ। সবুজের মাঝে ফুলে ফুলে সুশোভিত করা হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শত্রুমুক্ত জেলা যশোর। ১৯৭১ সালে মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ লেখেন-‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন শরণার্থীদের দুর্দশা আর যুদ্ধবিভীষিকা ফুটে উঠে ওই কবিতায়। সেই বিখ্যাত কবিতা কালেক্টরেট ভবনের প্রবেশদ্বারের দেওয়ালে ‘টেরাকোটায়’ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সে দৃশ্য। প্রবেশপথ ধরে ভবনের দ্বিতীয়তলায় উঠলেই চোখে পড়বে ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ আলোকচিত্রে সাজানো হয়েছে সে কর্নারটি। এছাড়া মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন স্কুল থেকে বাছাই করা ৫০ শিক্ষার্থীর লেখা কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প ও আঁকা ছবি দিয়ে যশোর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছে ‘খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামে বই। শুধু তাই নয়, যশোরের আর একজন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ, মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতিকে অম্লান করতে ভবনের দোতলায় কনফারেন্স কক্ষ দুটিরও নতুন নামকরণ করেছেন। ‘অমিত্রাক্ষর’ ও ‘সনেট’ নাম দিয়ে কক্ষদুটির দিয়েছেন নতুন মাত্রা। এ ছাড়াও আঙ্গিনার পুকুর নতুন করে সংস্কার করিয়ে করেছেন দৃষ্টি নন্দন। পুকুরে শোভা পাচ্ছে লাল শাপলার ঝাড়, বাতাসে দোল খায় তার পাতাগুলি। পুকুরের ঢালগুলো টাইলস ও পাথর বসিয়ে পর্যটন স্পটে রূপ দেয়া হয়েছে। পুকুরের পাশের ওয়াকওয়েতে সকাল-সন্ধ্যায় মানুষ নিরাপদে ভ্রমণ করতে পারছেন। এখন তার পাশ দিয়ে পাম গাছ লাগানো হচ্ছে। ভবনের উত্তর দিক যেখানে এক সময় বিভিন্ন প্রকার কবিরাজ, ক্যানভাচার ও টোটকা তাবিজওয়ালাদের দখলে থাকতো সেখানে মাটি ফেলে উঁচু করে বিনোদন ও চমৎকার পর্যটন এলাকা তৈরি করা হচ্ছে।
তবে তার এত সব কাজ ম্লান হয়ে যাচ্ছে ভবন এলাকার পূর্ব পাশে মামলার আলামতের গাড়ি। দুর্গন্ধময় সে অঞ্চল বুনোগাছে ঠাসা-পরিবেশও স্যাঁতসেতে। ভাঙ্গাচোরা মোটরসাইকেল, ভ্যান, রিক্শা, প্রাইভেট কার, বাস, ট্রাক-কী নেই সেখানে। তবে সেটি যে আর কখনো সমাজ বা রাষ্ট্রের কোনো কাজে আসবেনা এটা নিশ্চিত ওই এলাকায় যারা নিয়মিত চলাচল করেন তাদের বেশিরভাগই। কত বছর পড়ে আছে তা কারো জানা নেই। কালেক্টরেট চত্বরের বড় একটা এলাকাজুড়ে জঞ্জালের ওই স্তূপ গোটা কালেক্টরেট এলাকার সৌন্দর্যকে ম্লান করে দিচ্ছে।
এলাকার চা দোকানে বসা, প্রাত ভ্রমণে যাওয়া, পার্কে ঘোরা তরুণ প্রজন্ম অথবা পুকুরপাড়ের বেঞ্চে বসা ক্লান্ত মানুষেরা ওই আবর্জনার স্তূপকে সহজভাবে মেনে নিতে পারছেন না। সমস্ত সৌন্দর্য আর নান্দনিক উদ্যোগকে ‘আলোর নিচে অন্ধকার’ এর মতো দেখছেন তারা। জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মাহমুদুল হাসান বুলু ও সাংস্কৃতিক যোদ্ধা হারুণ অর রশীদ এক বাক্যে যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলামের নান্দনিকতার নানা প্রশংসা করেছেন। তবে তারা জানান, ওই আবর্জনাগুলো সকল সৌন্দর্য ম্লান করে দিচ্ছে।
জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খান বলেন, যশোর জেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প সংস্কৃতি ও মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে- এ ভবনের। পরবর্তী প্রজন্মকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ, ইতিহাস সংরক্ষণ ও শিল্প সংস্কৃতি চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতেই নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই আঙ্গিনাকে একটি দর্শনীয় ও পর্যটন স্পটে পরিণত করার চেষ্টা তার। কাজগুলো বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসনের টিমসহ ও যশোরবাসী সহযোগিতা করেছেন। ঐতিহ্যবাহী যশোরকে নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছেন সবাইকে নিয়ে। তিনিও গাড়ির আবর্জনা স্তূপের কথা স্বীকার করে জানান, এটি যেহেতু আদালতের এখতিয়ার ও মামলার আলামত, তাই ইচ্ছে করলেও সব সম্ভব না। এ বিষয়ে বিচার বিভাগ ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা হয়েছে। বিচার বিভাগ সরেজমিন পরিদর্শন করেছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, বিচার বিভাগ এটি অপসারণে সুষ্ঠু উদ্যোগ নেবে।