৯ই জুন ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ২৬শে জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড
যশোর বোর্ডের এসএসসির খাতা বন্টন নিয়ে নানা প্রশ্ন

তহীদ মনি : যশোর শিক্ষাবোর্ডের এসএসসি পরীক্ষার খাতা বন্টনে অনিয়ম ও মূল্যায়নের পদ্ধতি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। ৩০০ খাতা মূল্যয়নের জন্য একজন পরীক্ষক সময় পাচ্ছেন মাত্র ৮দিন। একটি খাতার পেছনে (মূল্যায়ন, নম্বর যোগ ও এসআইএফ পুরণসহ) ২০ মিনিট ধরলে একজন শিক্ষককে প্রতিদিন ১৩ ঘণ্টা সময় ব্যয় করতে হবে। প্রতিদিন দেখতে হবে কমপক্ষে ৪০টি খাতা।

একজন শিক্ষকের পক্ষে দিনে ১৩ ঘণ্টা সময় বের করা সম্ভব কিনা তা নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠছে তখন কেনো কোনো শিক্ষক বরাদ্দকৃত ৩শ’র স্থলে ৪০০ খাতা পাচ্ছেন। কোন কোন শিক্ষক ভিন্ন নামে ৬০০ খাতাও উত্তোলন করছেন বলে অভিযোগ আছে। আবার এক বিষয়ের শিক্ষক অন্য বিষয়ের খাতা পেয়েছেন বলেও স্বীকার করেছেন। ইংরেজি অংকের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ পরীক্ষক পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে পরীক্ষক নিয়োগের ক্রম উপেক্ষা করে কম অভিজ্ঞতা সম্পন্নদের খাতা দিতে বাধ্য হচ্ছে বোর্ড। কয়েকজন কর্মচারীর কারসাজিতে কম অভিজ্ঞ পরীক্ষকরাও খাতা মূল্যায়ন করার সুযোগ পাচ্ছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ কৌশলে খাতা উঠিয়ে অন্যকে দিয়ে দেখানোর অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে।

চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয় ৩০ এপ্রিল। পরীক্ষা শেষের পথে। যশোর শিক্ষাবোর্ড থেকে পরীক্ষকদের মাঝে খাতা বন্টনও শুরু হয়েছে। কোনো কোনো বিষয়ের খাতা মূল্যায়ন শেষে বোর্ডে ফিরতেও শুরু করেছে। প্রতিটি বিষয়ের খাতা মূল্যায়নের জন্যে বোর্ডের অনলাইনে আগ্রহী শিক্ষকদেরকে ওটিপি পূরণ করতে হয়। সে অনুসারে প্রতি বিষয়ের জন্যে কতজন পরীক্ষক আছেন তা বোর্ড জানতে পারে। তাছাড়া চাকরির অভিজ্ঞতা, খাতা দেখার অভিজ্ঞতা, বয়স প্রভৃতি অনুসারে ওই তালিকার ক্রম নির্ধারিত হয়। খাতা বন্টনের ক্ষেত্রে ওই ক্রম অনুসরণ করার বিধান রয়েছে।

কিন্তু চলতি বছর পরীক্ষার প্রথম দিক থেকেই বোর্ডের বিভিন্ন দপ্তরে চাউর হয় খাতা বন্টনে ক্রম ও অভিজ্ঞতার বিষয়টি উপেক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নতুন হওয়ার সুযোগে একজন সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও দুইজন কর্মচারীর সাথে বিশেষ যোগাযোগের মাধ্যমে কতিপয় অসাধু শিক্ষক বিভিন্ন বিষয়ের খাতা গ্রহণের প্যানেলে নিজেদের নাম লেখাতে ও খাতা পেতে সক্ষম হচ্ছেন।

জানা গেছে, চলমান পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে সাধারণত একজন পরীক্ষক ৩০০ খাতা গ্রহণ করেন। নেওয়ার দিন ও ফেরত দেওয়ার দিনসহ মোট ৮ দিন খাতা মূল্যায়নের জন্য সময় পান। তারা ৩ থেকে ৪ দিনের মধ্যে প্রথমে কিছু খাতা দেখে প্রধান পরীক্ষকের কাছে পাঠিয়ে দেন। অবশিষ্ট খাতা ওই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেখা শেষ করে প্রধান পরীক্ষকের কাছে জমা দেন। প্রধান পরীক্ষকও একই রকম সময় পান , তিনি তার মূল্যায়ন শেষে বোর্ডকে নম্বর জমা দেন।

এই সময়ের মধ্যে কীভাবে এতো খাতার মূল্যায়ন করা সম্ভব এটা জানতে চাইলে খুলনা, নড়াইল, মেহেরপুর ও সাতক্ষীরার একাধিক শিক্ষক জানান, এটা নিয়ম তাই তারা কষ্ট করে কাজ করেন। একটা খাতায় কতটুকু সময় দেওয়া যায় এমন প্রশ্নের উত্তরে তারা জানান, অভিজ্ঞতার বলে খাতা দেখা সম্ভব। একজন শিক্ষক জানান, অনেকে দিনে ৫০ টি খাতার মূল্যায়নও করেন। তাছাড়া দিনে ৩৫টি করে খাতার মূল্যায়ন করলে নির্দিষ্ট সময়ে মূল্যায়ন শেষ করা সম্ভব। একজন শিক্ষক জানান, তাদের ভুল থাকলে প্রধান পরীক্ষক সেটি পর্যবেক্ষণ শেষে সংশোধনের জন্যে আহ্বান করেন। ফলে সমস্যা হয় না।

এ বিষয়ে আতঙ্কিত দুইজন অভিভাবক জানান, তাদের ছেলেমেয়েরা যথেষ্ট মেধাবী। অতীতে ভালো ফলাফল করেছে বিদ্যালয়ের বিভিন্ন পরীক্ষায়। এতো সংক্ষিপ্ত সময়ে খাতার মূল্যায়ন নিয়ে তারা মনে করেন, যথার্থভাবে খাতা দেখতে পারেন না পরীক্ষকরা। তারা হিসেব কষে দেখান, ৮ দিনে ৭ রাত্রি। যাওয়া আসার দুই দিনে ২৪ ঘণ্টা বাদ দিলে অবশিষ্ট ৭ দিনে ১৬৮ ঘণ্টা। এর মধ্যে ৬ ঘণ্টা ঘুম , ৬ ঘণ্টা অফিসিয়াল কাজ, খাওয়া, গোসল, অন্যান্য ৪ ঘণ্টা ব্যয় হয় তা হলে দৈনিক সর্বেচ্চ ৮ ঘণ্টা খাতা দেখতে পারেন। সে হিসেবে ৭ দিনে ৫৬ ঘণ্টায় ৩০০ খাতা মূল্যায়ন করতে হয়। ওই অভিভাবকদের মতে ৩০০ খাতা মূল্যায়ন করলে ১১ মিনিটে প্রতিটি খাতা মূল্যায়ন করতে হয়।

সাবেক একজন পরীক্ষক ও প্রধান শিক্ষক জানান, সাধারণত পাসের ক্ষেত্রে সমস্যা হয় না, মোটামুটি গড়পড়তা একটা নম্বর শিক্ষকরা অভিজ্ঞতার থেকে দেন। আর ফেল বেশি করলে তাকে জবাবদিহিতার মধ্যে আসতে হয় তাই সতর্কভাবে সেটি এড়িয়ে যান পরীক্ষকরা। তবে ভালো ছেলে মেয়েদের সঠিক মূল্যায়ন এতো অল্প সময়ে যথার্থ হয় না। তিনি আরও বলেন, খাতার উপরের পৃষ্ঠা বা কভার পৃষ্ঠা পূরণে ওই ৩/৪ শ খাতার জন্যে ৪/৫ দিন লেগে যায়। অন্য একজন শিক্ষক জানান, কভার পৃষ্ঠা সাধারণত খাতা না পাওয়া শিক্ষক বা ক্লাসের ভালো ছাত্র দিয়েও অনেক শিক্ষক পূরণ করান। তবে অভিভাবক ও শিক্ষকরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এত তাড়াতাড়ি না হলে হয়তো আরও একটু ভালোভাবে মূল্যায়ন করা যেতো। আবার কয়েকজন জানান, সময় বেশি দিলে অনেকেই ফেলে রাখে এবং পরে এক সাথে দেখা শুরু করে। ফলে তখনও অল্প সময়ে অধিক খাতার মূল্যায়ন করতে হয়।

এদিকে খাতা বন্টনে অনিয়মের কথা উঠেছে বারবার।একটি সূত্র জানায়, মেহেরপুর গাংণীতে একজন আইসিটি শিক্ষক বাংলা ২য় পত্রের খাতা গ্রহণ করেছেন। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের সাথে যোগাযোগ করলে তারা বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে জানান, এতে তো কোনো সমস্যা নেই। বোর্ডের ওটিপিতে আইসিটি দেওয়া আছে। ২য় পত্রের খাতা চাওয়া হয়েছে।। মূল্যায়নেও সমস্যা হবে না। অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলে দুজনেই জানান, মাঝেমাঝে ক্লাস তো নেওয়া হয়, তাই খাতা দেখতে সমস্যা হবে না।

একইভাবে ইংরেজির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতা কেউ কেউ বেশি নিয়েছেন। সেখানেও বেশি দেওয়ার ক্ষেত্রে ওই ৩ জন কর্মচারীর নাম এসেছে বারবার। অভয়নগরের একজন শিক্ষক, মণিরামপুরের একজন শিক্ষক মিলে খাতা নিয়ে দিচ্ছেন এই সব কর্মচারীদের যোগসাজসে এমন কথাও বোর্ডের দপ্তরে দপ্তরে ঘুরে ফিরে আসছে। একটি সূত্র জানায়, খাতা মূল্যায়নের পরীক্ষক নির্বাচনের ক্ষেত্র ও পদ্ধতির কারণে অনেকে অনাগ্রহী। অনেকে মনে করেন তাদেরকে যথার্থ মূল্যায়ন করা হচ্ছে না।

অনেক সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষককে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের কাছে খাতা জমা দিতে হয়(প্রধান পরীক্ষক হওয়ায়) এটাকে তারা যথাযথ মনে করেন না। আবার কোচিং বাণিজ্যে বেশি লাভ থাকায় অনেক যোগ্য শিক্ষক পরীক্ষক হওয়ার চেয়ে কোচিং করানোকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। বোর্ড এই সমস্যা সমাধানে কার্যকরী কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারছে না।

পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. বিশ্বাস শাহীন আহমেদ জানান, অভিজ্ঞ শিক্ষকরা বোর্ডের ওটিপি পূরণে আগ্রহী হন না। এ কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের বলেও পরীক্ষকদের তালিকায় নাম উঠানো সম্ভব হয় না। তাই আগ্রহীদের মধ্যে থেকে যোগ্যদের নির্বাচিত করতে হয়। এবার ইংরেজিতে অনেক শিক্ষককে ৪ শ খাতা দিয়েছেন বলেও স্বীকার করেন। এতো অল্প সময়ে ৪শ খাতা বিশেষ করে ইংরেজির মতো বিষয়ে কতটুকু যথার্থ হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জানান, শিক্ষকরা রাত জেগে কষ্ট করে হলেও খাতার মূল্যায়ন করেন। দিন কতটুকু রাত কতটুকু এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শিক্ষকদেরকে নির্দিষ্ট সময়ে খাতার মূল্যায়ন শেষ করতে হয়। এ বিষয়ে তারা অভিজ্ঞ। এতে ফলাফলে সমস্যা হবে না। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ মানতে হবে সকলকে।


বোর্ড চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আহসান হাবীব বলেন, ইংরেজি খাতা নেওয়ার জন্যে দ্বিগুণ পরীক্ষককে আহবান করা হয়েছিল, বেশিরভাগই আসেননি। অনেককে নির্ধারিত ৩শ খাতার চেয়েও বেশি দেওয়া লেগেছে। তার মতে, খাতা বন্টনে কোনো অনিয়ম হয়নি তবে যোগ্য ও অভিজ্ঞ শিক্ষকরা খাতা নিতে চাননা বলে বোর্ডকে বিকল্প পদ্ধতিতে কাজ করতে হয় কারণ নির্দিষ্ট সময়ে খাতার মূল্যায়ন ও ফলাফল অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সময় মতো খাতার মূল্যায়ন না হলে ফলাফল ঘোষণা করা যাবে না। আর কম সময়ে খাতা মূল্যায়ন নিয়ে তার বক্তব্য হচ্ছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ফলাফল প্রকাশের ক্ষেত্রে সময় বেঁধে দিয়েছে।

পরীক্ষক খাতার মূল্যায়ন শেষে প্রধান পরীক্ষক মূল্যায়ন করেন, তারপরও বেশ কয়েকটি স্টেপ সম্পন্ন করার পর ফলাফলের জন্যে প্রস্তুত হতে হয়। এ কাজে জনবলও সময় দুটোই লাগে। তবে যারা খাতা নেন তারা আন্তরিকভাবে মূল্যায়নের চেষ্টা করেন। সময় কম বা বেশি কথা নয় শিক্ষকদের সেটি নির্দিষ্ট সময়ে দক্ষতার সাথে করতে হয়। অতীতেও যেমন এতে ফলাফলে প্রভাব পড়েনি এবারও পড়বে না।

সম্পাদক ও প্রকাশক : শাহীন চাকলাদার  |  ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আমিনুর রহমান মামুন।
১৩৬, গোহাটা রোড, লোহাপট্টি, যশোর।
ফোন : বার্তা বিভাগ : ০১৭১১-১৮২০২১, ০২৪৭৭৭৬৬৪২৭, ০১৭১২-৬১১৭০৭, বিজ্ঞাপন : ০১৭১১-১৮৬৫৪৩
Email : samajerkatha@gmail.com
পুরাতন খবর
Fri Sat Sun Mon Tue Wed Thu
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30  
স্বত্ব © samajerkatha :- ২০২০-২০২২
crossmenu linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram