মনিরুজ্জামান মনির ও বিএম রুহুল কুদ্দুস শাকিল : বুধবারের বৃষ্টিতে নাস্তানাবুদ কৃষক। পাকা ধান ঘরে তুলতে হিমসিম খাচ্ছেন তারা। শুধু ধান বাঁচালে চলছে না, তাদের ভাবতে হচ্ছে বিচালি নিয়েও। কৃষাণ না পেয়ে অনেক কৃষক স্বপরিবারে নেমেছেন মাঠে।
যশোর জেলা কৃষি অধিদপ্তারের সূত্রে জানা যায়, যশোরে বোরো ধানের চাষ হয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার ১৮ হেক্টর। এর মধ্যে হাইব্রীড ধান ২৭ হাজার হেক্টর এবং উফশী ধান ১ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর। এ পর্যন্ত যশোরের কৃষকেরা ৪০ শতাংশ ধান মাঠ থেকে ঘরে তুলছে পেরেছেন।
যশোর আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে আগামী কয়েকদিন বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। বুধবার যশোরে বৃষ্টিপাত হয়েছে ৩১ মিলিমিটার। এতেই বিপদে পড়ে কৃষক।
উত্তর নলিতাদাহ গ্রামের কৃষক আজহার আলী রিয়াজ জানান, ‘৫ বিঘা মত ধানের চাষ করেছি। প্রতিদিন বিকেল হলেই আকাশের যে অবস্থা তাতে ধান নিয়ে চিন্তায় আছি। যখন বৃষ্টি প্রয়োজন নেই তখন বৃষ্টি হচ্ছে।’
বীর নারায়ন পুর গ্রামের কৃষক আ. মান্নান জানান, মাঠে কাঠা ধান পানিতে ভাসছে। দৌড়াদৌড়ি করে ধান বাচাতে পারলেও বিচালি হয়তো নষ্ট হয়ে যাবে। বিচালি ভালো না থাকলে গরুগুলো বাঁচানো যাবে না।
বাঘারপাড়া উপজেলার লক্ষিপুর গ্রামের কৃষক আজিম উদ্দিন জানান, ধান এখনো অর্ধেক বাড়িতে আনতে পারিনি। এক বেলা রোদ এবং এক বেলা বৃষ্টি এতে ধানে শিকড় গজাতে পারে। এ বছর যে ভাবে বৃষ্টি শুরু হয়েছে তাতে বৃষ্টি তো দূরের কথা ধানও বাড়িতে আনতে পারবো কিনা সেই চিন্তায় আছি।
যশোর জেলা কৃষি অধিদপ্তারের উপপরিচালক মো. মঞ্জুরুল হক বলেন, এ আবহাওয়ায় আমরা কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি ধান কাটার সাথেই বাড়িতে আনার। কারণ প্রতিদিন বিকেলে বৃষ্টি হওয়া সম্ভাবনা আছে। যে সমস্ত কৃষক ধান কেটে মাঠে ফেলে রাখছে এসমস্ত ধানে শিকড় আসতে পারে। এখনো এভাবে ৩ থেকে ৪ দিন বৃষ্টি পাতের সম্ভাবনা আছে। তিনি বলেন তবে এ বৃষ্টিতে সবজির ভালো উপকার হচ্ছে। তবে কৃষকেরা একটু সচেতন হলে ধান নিয়ে এ বৃষ্টিতে তেমন কোন সমস্যায় পড়বেনা।
এদিকে শার্শায় বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। চাষের শুরু থেকে ধান পাকার আগ মূহুর্তে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবং তুলনামূলক পোকামাকড়ের উপদ্রব কম থাকায় এ ফলন সম্ভব হয়েছে। বৈরী আবহাওয়ায় কৃষকের সব স্বপ্ন-আনন্দ যেন বিষাদে পরিনত হয়ে পড়েছে। গত চার-পাঁচ দিনের মাঝারি ভারী বৃষ্টিতে মাঠে কেটে রাখা শত শত হেক্টর ধান নিয়ে দুঃচিন্তায় পড়েছেন বোরো চাষিরা। ক্ষেতে কেটে রাখা অধিকাংশ পাকা ধান পানিতে ভাসছে। মাটি পানিতে মিশে থাকা ধান নতুন করে আবার চারা (কল) হচ্ছে। এ অবস্থায় চাষিরা হতাশা এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে, চলতি বোরো মৌসুমে শার্শায় ২৩ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে ধান চাষ করা হয়েছে। যা গত বছর ছিল ২৩ হাজার ৬৬০ হেক্টর। গত বছরের তুলনায় এ বছর ধানের ফলন বেশ ভাল। এ পর্যন্ত ৬০ শতাংশ বোরো ধান কৃষকের ঘরে উঠেছে। বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে বাকি ধানগুলো যাতে দ্রুত কৃষকের ঘরে তোলা যায় সে বিষয়ে উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে কৃষকদের বিভিন্ন ভাবে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছর তুলনামূলক বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় নিচু জমিসহ ডাঙ্গা জমিতে এবছর বেশ আগে ভাগেই বোরো ধান রোপন করা হয়। ঈদের আগেই অধিকাংশ ধান পেকে যায়। বাইরের জেলার ধান কাটা শ্রমিক নির্ভর এ উপজেলায় নির্ধারিত ওই সময়ে শ্রমিক সংকট, প্রচ- তাপদাহ সর্বপরি ঈদ উৎসবের কারণে ধান কাটা সম্ভব হয়ে উঠেনি। তবে ঈদের আগে উপজেলার কিছু কিছু এলাকায় স্থানীয় শ্রমিক দিয়ে ধান কাটা শুরু হলেও কৃষকরা ধান বাড়িতে না এনে জমিতেই রেখে দেন।
ঈদ পরবর্তী সময়ে পুরোদমে চাষিরা যখন ধান গোছানোর কাজে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন ঠিক তখনই ঝড়োবৃষ্টিতে প্রবাদবাক্য ভরা পেটে বাইল ধারার বাড়ির মত অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। উপান্তর না পেয়ে অনেক চাষিরা ধান বাঁচাতে বিছালি কেটে রাখা ধান আঁটি বেধে আবার বিছালিসহ চড়া মজুরি খরচ দিয়ে মাথায় করে উঁচু স্থান ও বাড়িতে নিয়ে ফুঁকো মেশিন দিয়ে ঝেড়ে নিচ্ছেন। অনেকের দাঁড়িয়ে থাকা পাকা ধান গাছ বাতাসে হেলে পড়েছে। ফলে কাটা এবং গুছিয়ে ঘরে তোলাসহ ধান শুকানো নিয়ে কৃষকরা পড়েছেন বেশ বেকায়দায়।
বৃষ্টির একটু বিরতিতে নতুন করে বড় বড় চাষিরা বাইরের শ্রমিক দিয়ে ফসল গোছাতে ব্যস্ত হলেও ছোটি ছোট চাষি বাইরের শ্রমিক আনতে না পারায় এবং স্থানীয় শ্রমিক সংকটের কারণে অনেকের পাকা ধান গাছ মাঠেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার, শনিবার, রবিবার, সোমবার ও বুধবার পাঁচ দফায় মাঝামাঝি এবং ভারি ঝড়ো বৃষ্টি হয়। এতে অনেক খেতেই পানি জমে গেছে।
উপজেলার ডিহির তেবাড়িয়া, দরিদূর্গাপুর ও নিজামপুরের গোড়পাড়া বনমান্দার গ্রামের সেন্টু, নিজাম উদ্দীন, লাভলু ও ইজ্জত আলিসহ অনেকে জানান, মাঠে কেটে রাখা ধান বৃষ্টির পানিতে ভেসে গিয়ে কল হয়ে যাওয়ায় আঁটি বেধে ক্ষেত থেকে চড়া মজুরি খরচ দিয়ে মাথায় করে বাড়িতে এনে ফুকো মেশিন দিয়ে ধান ঝেড়ে নেওয়া হচ্ছে।
ডিহি, লক্ষণপুর ও বাহাদুরপুর ধান্যখোলা গ্রামের শামীম, আক্রোম আলি, মালেক, আব্দুল জুব্বার জানান, বৃষ্টির কারণে মাঠেই ধান ঝেড়ে বাড়িতে নিচ্ছেন।
কাগজপুকুর, বাহাদুরপুর ও শালকোনা গ্রামের কৃষক আল আমিন, আনোয়ারুল ইসলাম ও সবুজ হোসেন বলেন, ঈদের আগে ধান পাকলেও বাইরের ধান কাটা শ্রমিক না আসায় এবং প্রখর রোদে রোজা রেখে ধান কাটা সম্ভব হয়নি। তার পরও বছরের ঈদ উৎসব ভেবেছি পরেই কাটবো। তাই ঈদের দুই দিন পরে ধান কাটা শুরু করি। ধান ঘরে তোলার আগেই বৃষ্টিতে আমাদের ধানের জমিতে কাটা ধান ভাসছে।
তেবাড়িয়া গ্রামের আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ঈদের তিনদিন পর আমার মাত্র এক বিঘা জমির ধান বাড়তি দাম দিয়ে স্থানীয় শ্রমিক দিয়ে কেটে ছিলাম। কয়েক দিনের বৃষ্টিতে জমিতে পানি জমে ধানে কল হয়ে গেছে। সেই ধান আবারও বাড়তি মজুরি দিয়ে মাঠেই যেটুকু রৌদ্র পেয়েছি তাতেই শুকিয়ে মাঠে জালি দিয়ে রেখেছি। এখন পানি-কাদার জন্য বাড়িতে আনতে পারছি না। তিনি আরও বলেন আমার তিনটি গরু আছে। বিছালির জন্য বাড়তি টাকা খরচ করেছি। এ বছর যে অবস্থা তাতে গো-খাদ্য বিছালির দাম বৃদ্ধি পাবে।
সাতক্ষীরা ও ঠাকুরগাঁও জেলা থেকে এ উপজেলায় ধান কাটা শ্রমিকের কাজে আসা আবু কালাম, দাউদ হোসেন, ইব্রাহিম, আবু সুফিয়ান সহ অনেকে বলেন, ধান কাটা গোছানোর এই সময়ে ঝড়ো বৃষ্টির কারণে স্বাভাবিক কাজ কর্ম বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। ফলে অধিকাংশ অলস সময় কাটছে। যা মালিক এবং আমাদের উভয়ের জন্য খুবই বিবৃতিকর। তার পরও সৃষ্টিকর্তার ও প্রকৃতির বাইরে আমাদের কারোরি কোন হাত নেই।
শার্শা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা প্রতাপ কুমার মন্ডল বলেন, আবহাওয়া পরিস্থিতি কিছুটা খারাপ হলেও কয়েকদিনের বৃষ্টিতে ধানের তেমন সমস্যা হবে না। তবে বৃষ্টির আগে যারা ধান ঘরে তুলতে পারেননি তাদের ধানের কিছুটা ক্ষতি হতে পারে। চাষিদের প্রতি যত দ্রুত সম্ভব মাঠ থেকে পানি অপসারণ করে ধান সংগ্রহ করে বাড়িতে আনার পরামর্শ দেন এ কর্মকর্তা।