বিল্লাল বিন কাশেম
বিশ্বব্যাপী মহামারীর এ সময়ে গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে কাশ্মিরের লাদাখ সীমান্তের গালওয়ান ভ্যালি ও প্যাংগং লেক এলাকায় চীন-ভারতের সেনা মোতায়েনকে ঘিরে দু’দেশের সম্পর্কে তীব্র উত্তেজনা চলছে। এরই মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন ভারতীয় সেনার মৃত্যু হয়েছে লাদাখে। এ নিয়ে দুই দেশই একে অপরের বিরুদ্ধে প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ এনেছে। করোনার মধ্যে শুরু হওয়া এই বিরোধ খুব তাড়াতাড়ি মিটবে বলে মনে হচ্ছে না। ৪৫ বছরের মধ্যে এই প্রথম লাদাখের নিয়ন্ত্রণ রেখায় সংঘর্ষে এতজন সৈন্য মারা গেলেন। দুই সেনাবাহিনী অবশ্য মঙ্গলবারই উত্তেজনা প্রশমনের জন্য বৈঠক করেছে। আর এটাও দুই পক্ষই বলেছে যে আগের চার দশকের মতো এই সংঘর্ষেও কোনও গুলি চলে নি। চীন-ভারত সীমান্ত বিরোধ শতাব্দী জুড়েই চলমান। ব্রিটিশের আমলে ম্যাকমোহন যে সীমানা ঠিক করেছিলেন তা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পূর্বেকার কুমিংটান পার্টির সরকারও কখনও মানেনি। অবশ্য ১৯৬২ সালে সীমান্ত নিয়ে চীন-ভারতের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। ভারত সেই যুদ্ধে পরাজিত হয়। ভারতের অভিযোগ যে চীন একতরফাভাবে স্থিতাবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে চেয়েছিল। অন্যদিকে চীন ভারতীয় বাহিনীর দিকে আঙ্গুল তুলে বলেছে তারাই চীনা বাহিনীর সদস্যদের আক্রমণ করেছিল। বিবিসি সূত্রে জানা গেছে, গত সোমবারের ওই সংঘর্ষে দুই পক্ষেই হতাহত হয়েছে বলে ভারতীয় সেনাবাহিনী জানালেও চীন এখনও তাদের দিকে কোনও হতাহতের সংখ্যা জানায়নি। চীনের এক সামরিক মুখপাত্র এই প্রথম মুখ খুলেছেন বিষয়টি নিয়ে। চীনের সরকারি পত্রিকা পিপলস্ ডেইলি সেই বিবৃতি ছেপেছে। পিপলস লিবারেশন আর্মির পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের মুখপাত্র ঝ্যাং শুইলি কে উদ্ধৃত করে পিপলস ডেইলি লিখেছে, “ভারতীয় সৈন্যরা তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে আবারও প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পার করে বেআইনি কাজ চালাচ্ছিল এবং ইচ্ছে করে প্ররোচনা দেয় আর চীনা বাহিনীকে আক্রমণ করে।” “তারই ফলশ্রুতিতে দুই পক্ষের মধ্যে ‘ভয়ঙ্কর’ শারীরিক সংঘাত হয় এবং হতাহত হয়।” মি. ঝ্যাং আরও বলেছেন, “ভারতের উচিত তাদের বাহিনীকে কঠোরভাবে সংযত করা। নিয়ন্ত্রণরেখা লঙ্ঘন ও প্ররোচনা দেওয়া বন্ধ করে তাদের উচিত চীনের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার নিষ্পত্তি করা।” পিপলস্ ডেইলির মালিকানাধীন ট্যাবলয়েড পত্রিকা ‘গ্লোবাল টাইমস’ বুধবার একটি সম্পাদকীয় লিখেছে, যেখানে ভারতের কড়া সমালোচনা করা হয়েছে। “চীন-ভারত সীমান্তে সবসময়েই উত্তেজনা বিরাজ করার পিছনে ভারতের দম্ভ আর অদূরদর্শী মনোভাবই দায়ী। সম্প্রতি নতুন দিল্লি সীমান্ত ইস্যু নিয়ে একটা কঠোর মনোভাব নিয়েছে, যা দুটি ভুল মূল্যায়নের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে” “তারা মনে করে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমাগত চাপের ফলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ত করতে চাইবে না চীন। তাই ভারতের তরফে প্ররোচনা দেওয়া হলেও হয়তো চীন প্রত্যাঘাত করবে না। এছাড়াও ভারতের কিছু মানুষের মনে ভুল ধারণা আছে যে তাদের নিজেদের বাহিনী চীনের বাহিনীর থেকে বেশি শক্তিশালী। এই দুটি ভুল ধারণাই ভারতের মতামতের যৌক্তিকতাকে প্রভাবিত করে চীন সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণের সময়ে,” লিখেছে গ্লোবাল টাইমস। ওই সম্পাদকীয়তে আরও লেখা হয়েছে, “ভারতের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াতে চায় না চীন। তারা আশা করে দ্বিপাক্ষিক সীমান্ত সমস্যাগুলি শান্তিপূর্ণভাবেই মেটানো যাবে। এটা চীনের বদান্যতা, দুর্বলতা নয়।” এর আগে মঙ্গলবারই ভারতের সেনাবাহিনী দুটি বিবৃতি দেয়। প্রথমে মৃতের সংখ্যা তিন বলা হলেও রাতে একটি বিবৃতিতে জানানো হয় গুরুতর আহত হয়েছিলেন, এমন ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার ফলে লাদাখের ওই সংঘর্ষে মোট ২০ জন নিহত হয়েছেন।
সীমান্তে প্রায় পাঁচশ’ বর্গমাইল ভারতীয় এলাকা এবং উত্তর-পূর্ব সীমান্তে প্রায় সাত হাজার বর্গমাইল এলাকা চীন দখল করে রেখেছে। হিসাব নিকাশ করার পর যখন ভারতের হুঁশ ফিরে আসে তখন ওই হারানো এলাকা উদ্ধারের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৬২ সালের শিল্প-বাণিজ্যে সামরিক শক্তিতে চীনের চেয়ে ভারত ভাল অবস্থানে ছিল। তারপরও ভারত চীনের কাছে পরাজিত হয়েছিল। ভারত আর চীনের যুদ্ধ হয়েছিল প্রায় ছয় দশক পূর্বে। এখন দুটি দেশের কেউই পূর্ব অবস্থায় নেই। চীন এখন পরাশক্তিধর। ভারতও ভারত সেই পর্যায়ে পৌঁছাতে না পারলেও এগিয়ে চলেছে। তবে ভারত ১৯৬২ সালের যুদ্ধের প্রতিশোধ গ্রহণের স্পৃহা ত্যাগ করতেও পারেনি। তারপরও অবশ্য ভারত কোনও বিবাদে জড়ায়নি। এদিকে, চীন দীর্ঘ সময় ধরে ছোট ছোট সেনাদল ভারত সীমানায় ঢুকিয়ে সম্ভবত ভারতের প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। হয়তো ভারতের আরও কিছু জায়গা চীনের প্রয়োজন হচ্ছে। এখন হয়তো সেগুলো নেওয়ার ফন্দিফিকির চলছে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যুদ্ধ এড়ানোর জন্য নানা ধরনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। যেমন হটলাইনে দুই দেশের নেতারা তাৎক্ষণিকভাবে সরাসরি কথা বলে উত্তেজনা প্রশমনের ব্যবস্থা রেখেছিলেন। চীন এবং ভারতের বেলায় কি সেরকম কোন মেকানিজম আছে? এরকম ব্যবস্থা দুই দেশের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে আঞ্চলিক অধিনায়ক পর্যায়ে আছে। সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের লেফটেন্যান্ট জেনারেল পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে এরকম যোগাযোগ হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিকভাবে যারা আসলে সিদ্ধান্তগুলো নেবেন। দু’দেশের নেতৃবৃন্দের মধ্যে যোগাযোগের কোন ব্যবস্থা এখনো আছে বলে মনে হয়না। চীনের নেতা শি জিনপিং যখন সম্প্রতি ভারত সফরে যান, তখন এরকম একটা ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাব উঠেছিল। তবে সেটি বাস্তবায়িত হয়েছিল কীনা জানা যায়নি। এটাও সত্য যে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করলেও চীন ভারতের মধ্যে কোনও যুদ্ধ হবে না বলে প্রতিয়মান হয়। এখনো চীন ভারতের মধ্যে প্রায় ১০ হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়। এই বাণিজ্যে চীন বেশি লাভবান সত্য, কিন্তু বাণিজ্য বন্ধ হলে চীনের চেয়ে ভারতেরই ক্ষতি বেশি। কারণ, তার পণ্য বাজার এবং কলকারখানা চীনের ওপর অনেক নির্ভরশীল ভারত। চীন ব্যবসা করে। নিশ্চই তারা ভারতের মতো এত বড় একটি বাজার সহসা নষ্ট করতে চাইবে না। নয়া বিশ্ব ব্যবস্থায় ক্রমেই চীনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এবার দেখার বিষয় চীন-ভারত সম্পর্ক তিক্ততা বাড়বে? না চীনের নয়া উদার নীতির ফলে দু’টি দেশের সম্পর্ক উন্নয়ন ঘটবে।
বিল্লাল বিন কাশেম
লেখক ও কলামিস্ট
bellalbinquashem@gmail.com