তহীদ মনি : দেশে সবচেয়ে বেশি দিন গরম ও শীত অনুভুত হচ্ছে যশোরে। বিগত কয়েক বছরের আবহাওয়া চিত্রে এমন তথ্য উঠে আসছে। স্মরণকালে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের রেকর্ড হয় যশোরে। ২০১৩ সালে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড ৪.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, তাও যশোরে। গ্রীষ্মে চরমাভাপন্ন ও শীতে চরমশীতল পরিবেশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে যশোরের আবহাওয়া। ফলে এ অঞ্চলের জলবায়ুতে আসছে আমুল পরিবর্তন। গবেষকরা বলছেন, নদ নদী শুকিয়ে যাওয়া ও গ্রীন হাউস ইফেক্টের কারণে এ অবস্থা হচ্ছে।
চলতি মওসুমে শীতে দেশ কেঁপেছে জানুয়ারির ৬দিন। এর মধ্যে তিনদিন দেশের সর্বনিন্ম তাপমাত্রা ছিল যশোরে। বাকি দিনগুলোতে একই ধারায় শীত উপলব্ধি হচ্ছে। আবহাওয়া তথ্য বলছে, স্মরণকালে দেশের সবচেয়ে শীতল মৌসুম ছিল ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাস। তাপমাত্রার পারদ নেমেছিল ৪দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ রেকর্ডটি যশোরের।
আবার গ্রীষ্মে যশোরের গড় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ তাপ উপলব্ধিত হয়েছে যশোরে ১৯৯৫ সালে। গত দুই যুগে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস উঠেছিল যশোরে। ২০১৪ সালের ২৪ এপ্রিল যশোরের তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠে। ওই সময় পুরো এক সপ্তাহ ধরে যশোরের তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করে। ২০২১ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, যশোর দেশের ‘চরম আবহাওয়া’প্রবণ জেলা। রাজশাহীতে বছরে ১৫৫ দিন শীত অথবা গরম বেশি ছিল। যশোরে তা ছিল ১৫৩ দিন। এর পরে রয়েছে ঈশ্বরদী ১৪৫ দিন। দেশের ৯টি জেলার ৩৭ বছরের তাপমাত্রা পরিস্থিতি বিশ্লেষণে তৈরি এ গবেষণা প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বছরে গরম বেশি থাকা ৬টি জেলার মধ্যে শীর্ষে যশোর। বছরে গরম বেশি ছিল ৪৮ দিন। এরপর ছিল পাবনা (৪২ দিন), মৌলভীবাজার (৩৬ দিন) ও রাজশাহী (৩৪ দিন)।
যশোর জেলায় বছরে গড়ে ৭৫ দিন উষ্ণ ছিল, রাজশাহীতে ছিল ৬৭ দিন ও ঈশ্বরদীতে ৫৮ দিন।
অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডার ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয় ও ক্যালগেরি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একদল গবেষকের প্রকাশ করা এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানাগেছে, দেশের মধ্য ও উত্তরাঞ্চলের তুলনায় উপকূলীয় জেলাগুলোয় তাপমাত্রা দ্রত বাড়ছে। তারা গরম বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, মৌসুমি বায়ু ক্রমশ শুষ্ক হয়ে ওঠা, নদী-জলাশয় শুকিয়ে যাওয়া ও বনভূমি কমে যাওয়াকে দায়ী করেছেন।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদদের মতে, দেশে মার্চ-এপ্রিলে গরম বাতাসের একটি প্রবাহ প্রবেশ করে। আগে এর মূল কেন্দ্রটি পাবনার ঈশ্বরদী এলাকা দিয়ে ঢুকে রাজশাহী বিভাগে বেশি দিন অবস্থান করত। সাম্প্রতিককালে তা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হয়ে যশোর-চুয়াডাঙ্গা দিয়ে দেশে প্রবেশ করছে। সে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে উষ্ণ বায়ুপ্রবাহের প্রবেশের পথ কিছুটা বদলে যাচ্ছে।
পরিবেশ গবেষক আতিক আহসান বলেন, শুধু আবহাওয়াগত কারণেই যশোর অঞ্চলের আবহাওয়া চরম হয়ে উঠছে, তা নয়। এর সঙ্গে নদী শুকিয়ে যাওয়া ও গাছপালা কমে যাওয়াও অন্যতম কারণ। বিশাল এলাকাজুড়ে একসময় সুন্দরবন বি¯ত্মৃত ছিল। নদী ও পানি প্রবাহ বেশি ছিল। এখন গাছ উজাড় হয়েছে এবং নদীতে পানিপ্রবাহ কমে গেছে।
একটি তথ্যে জানা যায়, যশোরের সাতটি নদীর মধ্যে মাত্র দুটি এখনো কোনোমতে স্রোত নিয়ে টিকে আছে। ভৈরব ও মুক্তেশ্বরী নদ-নদী মৃতপ্রায়। কপোতাক্ষ, শ্রীহরী, টেকা, বুড়িভদ্রাসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানিপ্রবাহ কমেগেছে।
অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আশরাফ দেওয়ান একটি প্রতিবেদনে উলেস্নখ করেছেন বৈশ্বিক জলবায়ু বদলের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের খুব বেশি কিছু করার নেই। তবে যদি যশোর-খুলনার মতো উপকূলীয় এলাকায় নদীর পানি প্রবাহ বাড়ানো যায় এবং সেখানকার বনভূমি রক্ষা ও গাছপালা বাড়ানো যায়, তাহলে বৃষ্টিপাত বেড়ে তাপমাত্রা কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব। বিশেষ করে গরমকালে।
শুধু শীত কিংবা গরম নয়, পরিবর্তন দেখা দিয়েছে সাইক্লোন, বন্যা, ঝড় এমনকি ভূমিকম্পেও। ২০২২ সালের ১১ আগস্ট যশোরে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর আগেও একাধিকবার যশোরে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। তবে ২০২২ সালের ভূমিকম্পটি একটি বিরল ঘটনা। কারণ এর উৎপত্তি স্থল যশোর সদর উপজেলা থেকে মাত্র ৯ কিলোমিটার দূরে ছিল।
ওই দিন বিকেল ৫ টা ২৯ মিনিটে এই ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ২০২১ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের বেশিরভাগ প্রভাব ছিল যশোরের উপর। ওই ঝড়ে অšত্মত ৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছিল। ২০০০ সালে ভয়াবহ বন্যাও দেখেছে যশোরবাসী। অথচ কম দুর্যোগপ্রবন এলাকা হিসেবে যশোরে স্থপিত হয়েছে ডিজাস্টার রিকভারি ডাটা সেন্টার। ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর বিজিবি আঞ্চলিক হেড কোয়াটারের মাঝে স্থাপিত সেন্টারটি উদ্বোধন হয়।
যশোরের আবহাওয়ার এ পরিবর্তন নিয়ে খোজ রাখছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইবুর রহমান মোলস্না। তিনি জানান, সৃষ্টির শুরম্ন থেকে নানাভাবে আবহাওয়া ও পরিবেশ বদলাচ্ছে। যে কারণে মরু অঞ্চল এখন সজীব অঞ্চলে পরিণত হচ্ছে, জীব বৈচিত্র পাল্টাচ্ছে। তাছাড়া ভৌগলিক পরিবর্তন, বৈশ্বিক পরিবর্তন, গ্রীন হাউস ইফেক্ট, প্রাকৃতিক পরিবর্তন, ভূমিরূপগত পরিবর্তন প্রতিটি দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন সৃষ্টি করছে। সামগ্রিকভাবে বিশ্বে তাপমাত্রা ঊর্ধ্বমুখি প্রবণতাসহ তিনি বৈশ্বিক এই পরিবর্তনকে গুরম্নত্বসহকারে দেখছেন।
তার মতে যশোরের এ পরিবর্তনের জন্য প্রকৃতির স্বাভাবিক পরিবর্তনের ধারা একটি বড় কারণ। এখন থেকে ৫০ বছর আগের আবহাওয়া ও জলবায়ু আর এখনকার আবহাওয়া-জলবায়ু একই ধারায় চলছে না।