৪ঠা মে ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২১শে বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শুদ্ধ বাংলা চর্চাই হোক একুশের অঙ্গীকার

সন্তোষ দাস : মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার্থে জীবন দিলেন এ দেশের সূর্য সন্তানেরা। তাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলা ভাষা তার স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের সোপান বেয়ে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণরেখা স্পর্শ করেছি। কিন্তু বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত যে প্রখর চেতনা আর আবেগে আমরা ভাষা শহিদদের স্মরণ করেছি, বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় সচেষ্ট থেকেছি কেন যেন স্বাধীনতা উত্তরকালে সে চেতনা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে গেছে। এখন অতি আধুনিক শহুরে মেকী সমাজে বাংলা ভাষা অবহেলিত। ভাষা আন্দোলন নিয়ে বাঙ্গালির যে গর্ব ও অহঙ্কার ছিল আজ যেন তা অনেকটাই বিবর্ণ। এখনকার তরুণ সমাজ মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। আমাদের পূর্বসূরিরা যে ভাষার জন্য জীবন দিলেন, আমরা পারছি না তার মর্যাদাটুকু রাখতে।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন একদিকে শোকের অন্যদিকে গর্বের। কারণ ভাষার জন্য আন্দোলন শুধু বাঙ্গালীরাই করেছে। রক্ত দিয়েছে বাংলার সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বাররা। ১৯৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৯৯ এর নভেম্বর পর্যন্ত শুধু আমরাই পালন করেছি দিবসটি। অবশেষে ১৯৯৯ এর ১৭ নভেম্বর যখন জাতিসংঘের ইউনেস্কো একে আন্তজার্তিক মাতৃভাষার মর্যাদায় অভিষিক্ত করল তখন থেকে দিনটি হয়ে গেল বিশ্ব মানবের।

<<আরও পড়তে পারেন>> একসাথে চাকরি আর পড়াশোনা

এতে একদিকে যেমন আমাদের ভাষার মর্যাদা বাড়ল, বাড়ল আমাদের গৌরব ও অহংকার। তেমনি অন্যদিকে বিশ্বের বহু জাতি অনুপ্রাণিত হল তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষা রক্ষায়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাষাভাষী জনগোষ্টীর উপর শক্তিশালীদের যে মোড়লপনা সেটা খর্ব হওয়ার সম্ভবনা তৈরি হলো। ক্ষুদ্র নৃগোষ্টির অনেক মৃতপ্রায় ভাষা বেঁচে থাকার প্রেরণা পেল। সারা বিশ্বের প্রায় ২০০ টি দেশ দিনটি পালন করছে। ১৯৫২র ২১ ফেব্রুয়ারি যে অসাধারণ কাজটি আমরা করেছিলাম তা বিশ্ব মাঝে আমাদের গৌরব বাড়িয়েছে। এ অহংকার একমাত্র বাঙ্গালির।

কিন্তু এই গর্বের মধ্যেও একটি হতাশার দিক আছে। যখন দেখি এ দেশের সর্বত্র বাংলা ভাষার প্রচলন নেই অথবা শুদ্ধ বাংলা চর্চার তাগিদ নেই, তখন অহংকারের জায়গায় একটু হোচট লাগে। বেশি হতাশার জায়গাটি সৃষ্টি করেছে আমাদের তরুণ সমাজ। ২১ এর চেতনা ওদের মধ্যে প্রায় অনুপস্থিত। আমরা যখন স্কুল কলেজের ছাত্র ছিলাম তখন যে উৎসাহ উদ্দীপনায় ২১ পালন করতাম বা যে সংখ্যায় প্রভাত ফেরীতে অংশ নিতাম তা এখন দেখা যায় না। দেশে লোক বাড়ছে কিন্তু, ২১ এর প্রভাত ফেরীতে লোক কমছে। তরুণরা এখন ঐ সকাল ঘুমিয়ে কাটায় অথবা ব্যাচ কোচিং এ দেঁৗড়ায়। ব্যাচ কোচিং এর স্যারেরা তাদের ব্যবসায়িক ক্ষতির আশংকায় এমন একটা জাতীয় দিবসে ছুটি পর্যন্ত দেয় না। তরুণদের মধ্যে চেতনা জাগ্রত না হওয়ার জন্য হয়ত আমরা বড়রাও কম বেশি দায়ী।

শহর কেন্দ্রিক তরুণ—যুব সমাজের মধ্যে সুন্দর এবং শুদ্ধ করে বাংলা বলার ক্ষেত্রেও অনিহা। বাংলা হিন্দি এবং ইংরেজি মিলিয়ে খিচুড়ি করতে ওস্তাদ ওরা। কোনোটা ঠিক হয় না। এক্ষেত্রে একটা গল্প মনে পড়ল। কোথায় যেন পড়েছিলাম।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার জাহাজে করে বিদেশ থেকে ফিরছিলেন। একই জাহাজে বিলেত থেকে সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করা এক বাঙ্গালি যুবকও ছিলেন। যুবক যখন জানলেন জাহাজে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আছেন তখন তিনি ভাবলেন যাই কবিগুরুর সাথে একটু গল্প করে আসি। যুবক ইঞ্জিনিয়ার রবীন্দ্রনাথের সাথে ইংরেজিতে কথা বলছিলেন। কথার মাঝে একসময় তিনি কিছুটা কৈফিয়তের সুরে বললেন, “দীর্ঘদিন বিদেশে থাকতে থাকতে বাংলা ভুলে গিয়েছি। তাই ইংরেজি বলছি।” কবি তখন স্মিত হাস্যে বললেন, “তাতে দুঃখ ছিল না যদি ইংরেজিটাও শুদ্ধ করে বলতে।”

আমাদের তরুণ সমাজের অবস্থা অনেকটা ওই যুবক ইঞ্জিনিয়ারের মত। এরা টিভি দেখে কিছু ইংরেজি আর হিন্দি শিখছে এবং সেটা বাংলার সাথে মিশিয়ে ’হিংবাংলিশ’ করে ফেলছে। বেসরকারি বেতার, টিভির বা মঞ্চের উপস্থাপকরা ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে বিকৃত উচ্চারণে কথা বলে। এরা নিজেদেরকে অত্যাধুনিক বা স্মার্ট মনে করে। এগুলো দেখে মনে হয় মাতৃভাষার যে গুরুত্ব বা মর্যাদা তার কোনো অনুভূুতিই তাদের মধ্যে নেই। রবীন্দ্রনাথ তার ‘আমার ছেলেবেলায়’ লিখেছেন, “সেজদা বলতেন, আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি তারপর ইংরেজি শেখার পত্তন।” নিজের ভাষার বুনিয়াদ ভাল করে গড়ে অবশ্যই অন্য ভাষা শেখা যায়। পৃথিবীর উন্নত জাতি তাদের নিজস্ব ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতির ব্যাপারে কোন আপোস করে না।

আমারা আমাদের মাতৃভাষার জন্য জীবন দিতে পারলাম আর এখন কেন পারব না এর মর্যাদা রাখতে? আমরা ২১ এর দিনে যত কথা বলি, যত লেখা লেখি তা যদি সারা বছর মনে রাখি, আমরা যদি আমাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করতে পারি, নিজ ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রতি তাদের অনুরাগ সৃষ্টি করতে পারি তবেই বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষা পাবে এবং জাতি হিসেবে আমাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব টিকে থাকবে।

লেখক : প্রভাষক, সরকারি ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা ডিগ্রি কলেজ, ফকিরহাট, বাগেরহাট। ই—মেইল : santoshlipi71@gmail.com

সম্পাদক ও প্রকাশক : শাহীন চাকলাদার  |  ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আমিনুর রহমান মামুন।
১৩৬, গোহাটা রোড, লোহাপট্টি, যশোর।
ফোন : বার্তা বিভাগ : ০১৭১১-১৮২০২১, ০২৪৭৭৭৬৬৪২৭, ০১৭১২-৬১১৭০৭, বিজ্ঞাপন : ০১৭১১-১৮৬৫৪৩
Email : samajerkatha@gmail.com
পুরাতন খবর
FriSatSunMonTueWedThu
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31 
স্বত্ব © samajerkatha :- ২০২০-২০২২
crossmenu linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram