৩০শে সেপ্টেম্বর ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ই আশ্বিন ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
যশোর জেনারেল হাসপাতাল
যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে পাকে পাকে বকশিস

এস হাসমী সাজু : যশোর বকচর এলাকার শহীদ হোসেন তার অসুস্থ স্ত্রী রাবেয়া (২৫) কে নিয়ে ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসেন। ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তাকে মেডিসিন ওয়ার্ডে নিতে বলেন। ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র লেখা তখনো শেষ হয়নি। এক ব্যক্তি রোগীর ট্রলি নিয়ে চলতে শুরু করলেন। শহীদ হোসেনের তখন দোটানা অবস্থা। স্ত্রীর ট্রলির পেছনে যাবেন না ডাক্তারের সাথে কথা বলবেন। ডাক্তারের সাথে কথা শেষ করে এক প্রকার দৌড়াতে দৌড়াতে ট্রলি ধরলেন মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডের সামনে। কোথাও খালি বেড আছে কিনা দেখার সুযোগ পেলেন না। যিনি ট্রলি ঠেলে আনলেন তিনি তড়িঘড়ি করে মেঝেতে একটি কম্বল বিছিয়ে রোগী নামিয়ে দিয়েই পাতলেন হাত ‘৫শ টাকা দেন’। কিসের টাকা জিজ্ঞেস করাতেই বলছেন ‘রোগী আনার টাকা’।

অনেক কথাকাটাকাটির পরে শহীদ হোসেন জানতে পারলেন ট্রলি বয়ের নাম খায়রুল ইসলাম। সে হাসপাতালের স্টাফ না। রোগী এলেই জিম্মি করে টাকা নেন। শেষ পর্যন্ত ৩০০ টাকা পেয়ে গালি দিতে দিতে চলে যায় খায়রুল। এখানেই শেষ নয়, এরপরে মেডিসিন ওয়ার্ডে চিকিৎসক রোগীর নাকে টিউব দিতে বলেন। শহীদ হোসেন টিউব কিনে আনেন। টিউব লাগিয়ে ওয়ার্ড বয় ১ হাজার টাকা বকশিস দাবি করেন। তখন রোগীর স্বজন তাকে ৫০০ টাকা দিয়ে কাকুতি-মিনতি করে রক্ষা পান। শুধু শহিদ নন- এমন সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছেন হাসপাতালে ভর্তি প্রায় সকল রোগীই।
যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে টাকা ছাড়া (বখশিস) কোনো কাজ করছেন না কর্মচারীরা। ট্রলি ঠেলা, টিউব ও ক্যাথেটার পরানো, প্রস্রাব পায়খানা পরিষ্কার করার নামে নানা ছলনায় টাকা নিচ্ছেন কর্মচারীরা। এ কাজে এগিয়ে স্বেচ্ছাসেবী কর্মীরা। তারা বেতন নেই অজুহাত দেখিয়ে ইচ্ছেমত টাকা আদায় করছে। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হারুন অর রশিদ জানিয়েছেন, এদের বিষয়ে কঠোর হবে প্রশাসন।


বকশিস সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয় হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ডে। সাধারণত দরিদ্র পরিবারের মায়েরা সরকারি হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ডে আসেন। তবে চিকিৎসা ফ্রি পেলেও বকশিসের চাপে পড়েন তারা। গত ২৫জুন রাজিয়া সুলতানা (২৩) নরমালে একটি পুত্র সন্তান জন্ম দেন। এই পুত্র সন্তানকে আয়া আয়শা ও হেনা রোগীর স্বজনদের দেখাতে নিয়ে যান। কিন্তু এক হাজার টাকা ছাড়া (বখশিস) রোগীর স্বামী আনিছুর রহমানকে তার সন্তান দেখতে দেওয়া হয়নি। পরে তিনি ওই টাকার ব্যবস্থা করে আয়াকে দিলে তিনি নবজাতককে পিতার কাছে দেন। অভিযোগ রয়েছে, এই প্রসূতি ওয়ার্ডে নরমাল ও অপারেশন করা যেভাবেই জন্ম নিক না কেনো ছেলে সন্তান হলে এক হাজার টাকা এবং কন্যা সন্তান হলে ৫শ টাকা জোরপূর্বক আয়া, ওয়ার্ড বয় ও ঝাড়ুদাররা আদায় করছেন। কেউ দিতে না পারলে কর্মচারীদের কাছে অপমানিত হতে হয় বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।


একই ভাবে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ভর্তি রোগীদের একাধিক অভিভাবক অভিযোগ করেছেন, প্রসূতি ওয়ার্ডে, হাসপাতালের জরুরি বিভাগ, অস্ত্রোপচার কক্ষ, পুরুষ ও মহিলা সার্জারী ওয়ার্ড, পুরুষ ও মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ড, পুরুষ ও মহিলা পেয়িং ওয়ার্ড, মডেল ওয়ার্ড, গাইনী ওয়ার্ড, সংক্রামক ওয়ার্ড এবং শিশু ওয়ার্ডে সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি বহিরাগত স্বেচ্ছাসেবীরা দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তারা চিকিৎসাধীন রোগীর এবং সিজারিয়ান রোগীর ক্যাথেটার লাগাতে গেলে টাকা, খুলতে গেলে টাকা, টলি ঠেলতে গেলে টাকা, ড্রেসিং করতে গেলে টাকা নেন। টাকা ছাড়া তারা কোন কাজই করেন না। অর্থাৎ রোগী ভর্তি হওয়া থেকে শুরু করে ছাড়পত্র দেয়া পর্যন্ত বিভিন্ন অজুহাতে স্বজনদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে এখানে। হাসপাতালের নিজস্ব কর্মচারী ও বহিরাগতরা এই অর্থবাণিজ্যের সাথে জড়িত।


এদিকে হাসপাতালের একটি সূত্র জানায়, বহিরাগতদের অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেয়ায় এ অবস্থা হয়েছে। তারা হাসপাতালের পরিচয়পত্রকে পুঁজি করে প্রতারণা করছেন। মানুষকে জিম্মি করে অর্থবাণিজ্য হলো তাদের মূল টার্গেট। এসব স্পেশাল কর্মচারীদের দাপটের কাছে চিকিৎসা নিতে আসা লোকজন রীতিমতো অসহায়। দীর্ঘদিন ধরে কর্মচারীরা এই অবৈধ বাণিজ্য করে আসছে। কিন্তু বর্তমানে বাণিজ্য বেড়েছে কয়েকগুণে। তারা ৩শ’ টাকার কম নিচ্ছেন না বলে রোগীর স্বজনরা অভিযোগ করেন।


হাসপাতালে বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রোগীর স্বজন তানভীর, সোহাগ হোসেন, পারভীনা বেগমসহ অনেকেই জানান, দায়িত্বরত কর্মচারীকে কোনো কাজের কথা বললেই তারা টাকার প্রশ্ন তোলেন। অসহায় মুহূর্তে তারাও কর্মচারীদের টাকা দিতে বাধ্য হন। কেননা তাদের চাহিদামতো টাকা না দিলেই পরবর্তীতে আর কোনো কাজ করেন না । ডাকলেও রোগীর কাছে আসতে চান না। এমনকি মারমুখী আচরণ করেন।


রাসেল আহম্মেদ নামে একজন জানান, গত ৬ জুলাই বৃহস্পতিবার ছেলে নাজমুলকে হাত ভাঙ্গা অবস্থায় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন। এ সময় ডাক্তার দেখে হাতে প্লাস্টার দেওয়ার নির্দেশ দেন। তখন জরুরি বিভাগ থেকে রোগীর প্লাস্টার করতে গিয়ে পুরুষ সেবিকাকে ৫শ টাকা দিতে হয়েছে। তিনি আরও বলেন এ সময় জরুরি বিভাগে এক জখমি রোগীকে ক্ষতস্থানে সেলাই করা বাবদ ৫শ টাকা নেন দায়িত্বরত কর্মচারী।


এই বিষয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হারুন অর রশিদ জানান, তিনি যোগদান করার পর রোগীর স্বজনদের জিম্মি না করার জন্য কর্মচারীদেরকে নির্দেশনা দিয়েছেন। এরপরেও যদি কেউ অর্থবাণিজ্যে লিপ্ত থাকে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি আরো জানান, ইতোমধ্যে প্রসূতি ওর্য়াডসহ কয়েকটি ওয়ার্ডের কর্মচারীদের বাদ দেওয়া হয়েছে এবং অর্থবাণিজ্য না করতে পারে সে জন্য প্রতি মাসে ডিউটি রোস্টার পরিবর্তন করা হচ্ছে। কোন স্বেচ্ছাসেবী রোগীর স্বজনদের জিম্মি করে অর্থবাণিজ্যের ধান্দা করলে তাকে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়া হবে।

সম্পাদক ও প্রকাশক : শাহীন চাকলাদার  |  ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আমিনুর রহমান মামুন।
১৩৬, গোহাটা রোড, লোহাপট্টি, যশোর।
ফোন : বার্তা বিভাগ : ০১৭১১-১৮২০২১, ০২৪৭৭৭৬৬৪২৭, ০১৭১২-৬১১৭০৭, বিজ্ঞাপন : ০১৭১১-১৮৬৫৪৩
Email : samajerkatha@gmail.com
পুরাতন খবর
Fri Sat Sun Mon Tue Wed Thu
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930  
স্বত্ব © samajerkatha :- ২০২০-২০২২
crossmenu linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram