সালমা খাতুন জেরিন
বাবা আমাদের পরিবারের বটগাছ। ছোটবেলার সব ঘটনা মনে নেই আমার। তবুও একটিবার ফিরে যাব ছোটবেলায়। প্রথমেই যেটা মনে পড়লো “আমার বাবার নতুন ভাবে বাঁচার স্বপ্ন”।
তখন আমার ৫/৬ বছর বয়স। মা’কে অনেকের কাছে গল্প বলতে শুনতাম। তার মারা যাওয়া প্রথম মেয়ের গল্প। তাকে ঘিরে ছিলো বাবার পৃথিবী। নয়মাস বয়সে সে মারা যায়। বাবা পাগলপ্রায়। কবরস্থানে বসে কাটতো বেশির ভাগ সময়। শুনেছি দিন, রাত, ঝড়, রোদ এগুলো তার কাছে কিছুই মনে হতো না। মৃত সন্তানের কবরের পাশে নিঃশব্দে বসে থাকতেন। নয় বছর পর আমি পৃথিবীতে আসি। সেদিন ভোররাতে আমার কান্নার শব্দ শুনে বাবা কেঁদেছিলেন। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিলেন। বাবার নয় বছরের দুঃখ যেন এক মিনিটে মুছে যায়।
আরেকটা স্মৃতি খুব ভালো মনে আছে। মনে পড়লে একা একাই হাসি আবার দুঃখও পাই। পরিশ্রমী বাবাকে না বুঝে কি কষ্টটায় না দিয়েছি! ছোটবেলায় খুব দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তাম। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার ভিতর। প্রতিরাতে দুই-তিনবার ওয়াশরুমে যাওয়া লাগতো। বাবা বনবিভাগের চাকরি করেন। সারাদিন দুই চাকার মোটরসাইকেল নিয়ে সাইডের কাজ থাকতো। সন্ধ্যায় সব ব্যস্ততা শেষ হয়। অফিসের কোয়ার্টারের ওয়াশরুম বাইরে ছিলো। ঘুমের ভিতর একটু পরপর ডেকে তুলতাম বাবাকে, ‘বাবা ওয়াশরুমে যাব’। খুব ভয় পেতাম তাই বাবা একবারে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন। কিন্তু কখনও বিরক্ত হতে দেখিনি। তবে বিরক্ত হতে দেখতাম নিউজ দেখার সময়। ছোট বেলায় আমি প্রচুর কথা বলতাম। লাল রং এর একটা বিটিভি ছিলো আমাদের। বাবা কাজ শেষ করে নিউজ দেখতে বসতেন। কথা বলা তখন আমার বেশি বেড়ে যেতো। আম্মু তখন বলতেন, ‘আমার মেয়েও তার দৈনন্দিন খবর শুরু করলো। আমরা টিভিতে নই বরং আমাদের মেয়ের খবরে মনোযোগ দেই।’ শত চেষ্টা করেও আমার কথা বলা কেউ কমাতেই পারেনি। সিদ্ধান্ত নিলো টিভি অন্য রুমে সেট করবে।
বাবাকে ঘিরে ভালো লাগার অনূভুতিগুলো অনেক আছে। যখন দেখি অসহায়দের ত্রাণের জন্য কার্ড সংগ্রহ করে, ত্রাণ পাওয়ার যোগ্য মানুষটির হাতে পৌঁছে দেন। করোনাকালীন এ সময়ে নিজে অনেকগুলো পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ঈদের সময় নিজের এবং পরিবারের কথা না ভেবে অনেকের মুখে হাসি ফুটানোর দায়িত্ব নেন। অন্যদের মুখে নিজের বাবার প্রশংসা যখন শুনি, তখন ভাল লাগার এক অনুভূতি বয়ে যায় হৃদয়জুড়ে।
এখন আমি বড় হয়েছি। যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। স্বভাবতই বিয়ের প্রস্তাব বাড়িতে কমবেশি আসে। এলাকার কিছু ব্যক্তি বাবাকে বলেন, ‘মেয়ের বয়স হয়ে যাচ্ছে বিয়ে দিয়ে দাও’। বাবা তখন বলেন, ‘আমার কোন সমস্যা নাই; মেয়ে আমার, চিন্তাও আমার। পড়াশোনা শেষ হলে মেয়ের মতামতের গুরুত্ব দিয়ে সিদ্ধান্ত নেবো। ইনশাআল্লাহ।’ একথা শুনে আমি আনন্দে, আবেগে আপ্লুত হই। অবাক হয়েছিলাম এক ব্যক্তির কথায়। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাথম্যাটিক্সে পড়াশোনা করেন। তিনি বলেছিলেন, ‘জেরিন তুমি তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ো না, তোমার তো উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নেই। তাহলে তোমার বাবা বিয়ে কেনো দেন না।’
আমি একথা বাবাকে জানিয়েছিলাম। বাবা বললো, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেই ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হয়?’ আমার বাবার প্রশ্নের ভেতরই আমি উওর পেয়েছিলাম। এখনও কত মানুষ ভুলের ভেতর আছে, তাদের জন্য আমার বাবার উদাহরণই যথেষ্ট।
আমাদের বাবা-মেয়ের সম্পর্ক এখনও বন্ধুর মত। আমার পিরিয়ডকালীন সময়ে কোন খাবার খাওয়া উচিত, আমার বেডরুম পরিষ্কার কিনা, ওয়াশরুম পরিষ্কার কিনা সেগুলোও বাবা খেয়াল রাখেন। একটা মেয়ের এসময় যেমন সাপোর্ট প্রয়োজন আমি পরিবার থেকে সেগুলো পাই। সঠিক বুদ্ধি হবার পর কখনও বাবার অবাধ্য হইনি। সব বিষয়ে বাবা ও পরিবারের সাপোর্ট পাই। পৃথিবীর সকল বাবাই শ্রেষ্ঠ তার সন্তানের কাছে। পৃথিবীর সকল সন্তান শ্রেষ্ঠ তার বাবার কাছে। ভালোবাসি বাবা তোমাকে, একটি বিশেষ দিনে নই; সবসময়ই।