৩রা অক্টোবর ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৮ই আশ্বিন ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
নজরুল সাহিত্যে সাম্যবাদ,মানবিকতা ও অসাম্প্রদায়িকতা
208 বার পঠিত

সন্তোষ দাস: “অগ্নিবীণা হাতে তাঁর প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো তার প্রকাশ”
বিদ্রোহী কবি, প্রেমের কবি, সাম্যের কবি, মানবতার কবি, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। ইংরেজি প্রতিশব্দে এককথায় বলা যায় “ভারস্যাটাইল।” একাধারে কবি, গীতিকার, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী, গল্পকার, উপন্যাসিক, নাট্যকার, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, সাংবাদিক, সম্পাদক, সৈনিক ইত্যাদি বহুরূপে তাঁকে আমরা দেখি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে “ছন্দ সরস্বতীর বরপুত্র” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও তিনি আরবি, ফার্সি, উর্দু, হিন্দি, সংস্কৃত, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষায় পারদর্শি ছিলেন। “আলগা করোগো খোপার বাঁধন, দিল ওহি মেরা ফাস গায়ি” গানটিতে তিনি বিস্ময়করভাবে একইসাথে বেশ কয়েকটি ভাষার সম্বন্বয় ঘটিয়েছেন। এই বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী কবির জীবনটা কিন্তু ট্র্যাজেডিতে ভরা। মাত্র নয় বছর বয়সে পিতাকে হারিয়ে তাঁকে রোজগারে নামতে হয়। দারিদ্র্যতার কারণে তাঁকে খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা, রুটির দোকানের কর্মচারী ইত্যাদি কাজ পর্যন্ত করতে হয়। ছোট বেলায় দুঃখ কষ্টের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছেন বলে তাঁর আর একটি নাম দুখু মিয়া। দুঃখ-কষ্ট, চড়াই উৎরাই পেরিয়ে তিনি যখন সাহিত্য সাধনার মধ্য গগনে, ঠিক তখন ১৯৪২ সালে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে দুরারোগ্য প্রিক্স ডিজিজে (এক ধরনের নিউরো ডিজিজ) আক্রান্ত হয়ে বাক্শক্তি এবং মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তিনি ৭৭ বছর (১৮৯৯-১৯৭৬) বেঁচে ছিলেন। এর মধ্যে মাত্র ২৫ বছর (১৮ বছর বয়স থেকে ৪৩ বছর পর্যন্ত) সাহিত্য সাধনা করতে পেরেছিলেন। বাকি ৩৪ বছর তিনি অসুস্থ হয়ে ছিলেন। তাঁর জীবনের পুরোটা সময় যদি তিনি সাহিত্য সাধনা করতে পারতেন, তাহলে বাংলা সাহিত্য আরো কতটা সমৃদ্ধ হতে পারত, ভাবলে বিস্মিত হতে হয়!

নজরুলের কবি প্রতিভার প্রকাশ ঘটে বাল্যবেলাতেই। তিনি বাংলার লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে লেটো দলে যোগ দিয়েছিলেন। লেটো দল হলো বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমাণ নাট্যদল। নজরুল এই দলের জন্য গান ও গীতিনাট্য লিখতেন, সুর করতেন, গাইতেন এবং অভিনয় করতেন। কিশোর বয়সে তিনি থিয়েটার দলে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সাহিত্য চর্চা শুরু হয় মূলত সৈনিক জীবনে তিনি যখন করাচি সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন। ১৯১৭ সালের শেষ দিক থেকে ১৯২০ সালের মার্চ এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছর ছিল তাঁর সৈনিক জীবন। এই সময়ে তিনি করাচি সেনানিবাসে বসে রচনা করেন তাঁর জীবনের প্রথম গদ্য সাহিত্য “ বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী”। তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা-মুক্তি ছাড়াও কবিতা-সমাধি, ছোট গল্প হেনা, ব্যথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে ইত্যাদি এখানে বসেই রচনা করেন। তখন করাচী সেনানিবাসে বসে তিনি কলকাতা থেকে প্রকাশিত প্রবাসী, মানসী, সবুজপত্র, সওগত ইত্যাদি পত্রিকা পড়তেন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ তৎকালীন প্রখ্যাত কবি সাহিত্যিকদের সাহিত্য কর্মের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান।

১৯২০ সালে কবি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় চলে আসেন এবং একই সাথে সাংবাদিকতা ও সাহিত্য সাধনায় মনোনিবেশ করেন। এই সময় তিনি কলকাতার ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস করতে শুরু করেন। কবির সাথে একই সাথে থাকতেন ঐ সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা, উপমহাদেশের প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ। কবির সাথে মুজাফ্ফর আহমদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়। কবি তাঁর বন্ধুর সাথে নিয়মিত রাজনৈতিক সভা সমিতিতে যোগ দিতেন। রাজনৈতিক দলের জন্য গান লিখতেন, সুর করতেন এবং গাইতেন। কমিউনিস্ট নেতা বন্ধু মুজাফ্ফর আহমদ, তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক ও রাশিয়ার বিপ্লব দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। এতে অনেকে মনে করতেন তিনি সমাজতন্ত্রের সমর্থক। কিন্তু তিনি নিজে কখনো এই দলের সদস্য পদ গ্রহণ করেননি। তবে ১৯২০ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে কবি নজরুল কংগ্রেসের হয়ে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস তাঁকে নমিনেশন না দিলে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন, যদিও নির্বাচনের ফল তার পক্ষে যায়নি। তবে এসব ঘটনা থেকে কবির রাজনৈতিক সচেতনতার পরিচয় পাওয়া যায়।

কবির সাহিত্যে প্রকাশ পেয়েছে প্রেম, মুক্তি, সাম্যবাদ, বিদ্রোহ, মানবিকতা ও অসাম্প্রদায়িকতা। ধর্মভেদ ও লিঙ্গভেদ তাঁকে স্পর্শ করেনি। বাল্যে কুরআন শরীফ পড়েছেন, মসজিদে মুয়াজ্জিম ছিলেন, মক্তবে শিক্ষকতা করেছেন। কৈশোরে লেটো ও থিয়েটার দলে যোগ দিয়ে উদার লোকজ সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হয়েছেন। আবার যৌবনে শ্যামা সঙ্গীত ও হিন্দু ভক্তিগীতি লিখেছেন। এর পরই লিখেছেন ইসলামী সঙ্গীত ও গজল। বাংলা সাহিত্যে ইসলামী চেতনার সূচনা হয় কবি নজরুলের হাত ধরেই। তিনি যেমন ইসলামী ধর্মতত্ব ও দর্শন পড়েছেন, তেমন পড়েছেন হিন্দু পুরান, সংস্কৃত সাহিত্য, বাইবেল প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থ। একদিকে বাল্যবেলার ইসলামী শিক্ষা, অন্যদিকে লেটো দলের উন্মক্ত বিচিত্র অভিজ্ঞতা এবং পরবর্তীতে সর্বধর্ম পাঠ তাকে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করেছিল। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেই তাঁর শেষ ভাষণে বলেন, “কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটোর কোনটাই না। আমি শুধু হিন্দু মুসলিমকে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্ট করেছি। ”

নজরুলের অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার আরো পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর চার সন্তানের নাম রাখার মধ্য দিয়ে। কবি তাঁর চার সন্তানের নাম রাখেন যথাক্রমে-কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ (বুলবুল), কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ।

তিনি ধর্মান্ধদের উদ্দেশ্যে লিখেছেন,
“জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছ জুয়া
ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয়তো মোয়া।।
তিনি জানতেন প্রগতির পথে বড় অন্তরায় সাম্প্রদায়িকতা। এর বিরুদ্ধে কান্ডারি হুশিয়ার কবিতায় তিনি লিখেছেন,

“হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন?/ কান্ডারি! বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র।
নজরুলের অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার কথা বলতে গিয়ে বিশিষ্ট গবেষক অধ্যাপক শিবনারায়ণ বলেছেন,“ এক হাজার বছরে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর মত অসাম্প্রদায়িক কবি আর দেখা যায়নি।”
ঠিক একইভাবে নজরুল সাহিত্যে আমরা সাম্যবাদের প্রকাশ দেখি।
“গাহি সাম্যের গান-/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান/ গাহি সাম্যের গান। (সাম্যবাদী)
আবার মানুষ কবিতায় তিনি বলেছেন,
“গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।

কবি নজরুল মানুষে মানুষে শ্রেণিবিভেদকে ঘৃণা করতেন। বরং কথিত নিচু তলার চাষা কুলি মজুররা ছিল তার সাহিত্যের প্রধাণ উপজিব্য। কুলি মজুর কবিতায় তিনি লিখেছেন,
“দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি বলে এক বাবু স’াব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে।

কবির মানব প্রেমের আরো একটি উদাহরন আমরা পাই গবেষক জিয়াদ আলীর লেখায়। তিনি লিখেছেন,
একদিন রাতে কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে হ্যারিসন রোডের মুখে এক রিকসাওলাকে নাকি কবি বলেছিলেন, “এই প্রতিদিন তুই মানুষ টানিস, আজ তুই রিকসায় চড়ে বস, আমি তোকে টানব।”
কবির কাছে লিঙ্গভেদেরও কোন স্থান ছিল না। নারী কবিতায় তিনি লিখেছেন,
“ আমার চক্ষে পুরুষ-রমনী কোন ভেদাভেদ নাই।/ বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দি বাঙালি জাতিকে শোষণ ও উৎপীড়ন থেকে মুক্ত হবার ডাক দিয়ে তিনি লিখেছেন,
“ বল বীর-
বল উন্নত মম শির!/ শির নেহারি আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!”
এমনিভাবে নজরুলের প্রেম, দ্রোহ, অসাম্প্রদায়িকতা, মানবিকতা, সাম্যবাদিতার প্রকাশ ঘটেছে তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে, যা সব কালে সব সমাজে প্রাসঙ্গিক। তাই আজ আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে নজরুলকে আরো বেশি করে উপস্থাপন করার সময় এসেছে।

লেখক: প্রভাষক, সরকারি ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজ, ফকিরহাট, বাগেরহাট

সম্পাদক ও প্রকাশক : শাহীন চাকলাদার  |  ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আমিনুর রহমান মামুন।
১৩৬, গোহাটা রোড, লোহাপট্টি, যশোর।
ফোন : বার্তা বিভাগ : ০১৭১১-১৮২০২১, ০২৪৭৭৭৬৬৪২৭, ০১৭১২-৬১১৭০৭, বিজ্ঞাপন : ০১৭১১-১৮৬৫৪৩
Email : samajerkatha@gmail.com
পুরাতন খবর
Fri Sat Sun Mon Tue Wed Thu
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031  
স্বত্ব © samajerkatha :- ২০২০-২০২২
crossmenu linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram