রতন কুমার তুরী : প্রকৃতপক্ষে ‘কারার ঐ লৌহকপাট ভেঙে ফেল কর রে লোপাট রক্ত—জমাট শিকল পূজার পাষাণ—বেদী’— গানটি নজরুলের শুধু একটি গানই নয়। এ গানটি ছিল ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত ভারত কারাগারের ভেতর থেকে ব্রিটিশদেরই বিরুদ্ধে নজরুলের তীব্র প্রতিবাদের দলিল। গানটি কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচনা করেছিলেন এখন থেকে একশ বছর আগে। এ গানটি বাঙালিরা হৃদয়ে ধারণ করে আছে এমনভাবে যে, গানটি কোথাও বাজলেই বাঙালি গণমানুষের রক্তে কাঁপন ধরে। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামসহ যে কোনো আন্দোলন—সংগ্রামে বাঙালিকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে এসেছে এ গানটি।
এমন একটি জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত গানকে এ আর রহমান কেন সুর পাল্টিয়ে নজরুল ভক্তদের মনে আঘাত দিলেন তা সত্যিই বোধগম্য নয়। পুরো বদলে দেয়ায় গানটির আবেদন অর্থাৎ কাজী নজরুল ইসলাম যে প্রেক্ষাপট নিয়ে গানটি রচনা করেছিলেন তার লেশমাত্র আর গানটিতে অবশিষ্ট নেই।
মূলত কবির বিদ্রোহের ভাষা মেনে নিতে পারেনি ব্রিটিশরা। জেলবন্দি নজরুলকে চরম অত্যাচার করা হতো। বিদ্রোহী কবি রাগে—অপমানে অনশন শুরু করেছিলেন। অনশনের মাত্রা এত ভয়াবহ ছিল যে, ভাত—পানি সব মুখে তোলা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। জেলে গিয়ে মুখে খাবার তোলার জন্য কাতর আবেদন জানিয়েছিলেন স্বয়ং বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এক জেল থেকে আরেক জেল; চোর, ডাকাত, পকেটমারদের মতো একই ব্যবহার করা হতো তার সঙ্গেও। তবুও কবিকে থামানো যায়নি। অন্ধকার কুঠুরিতে দুই হাতে হাতকড়া বেষ্টিত কবি সেলের লোহার গরাদের সঙ্গে ঘা দিয়ে দিয়ে বাজিয়ে গান গাইতেন ‘কারার ঐ লৌহকপাট’। এই গানের জন্য কাজী নজরুলকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে।
ব্রিটিশরা মরমে মরমে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, নজরুলকে কারাগারে আবদ্ধ রাখা সম্ভব নয়। কারণ বিদ্রোহী নজরুলের বিদ্রোহী সত্তা ছিল সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত। তিনি যেখানে যে পরিবেশে থাকেন না কেন অন্যায় দেখলে তার বিদ্রোহী সত্তা জেগে ওঠবে প্রতিবাদ করবেই। যে রকম জেলের ভেতর বিভিন্ন অনিয়ম দেখেই নজরুল প্রতিবাদী কণ্ঠে গেয়ে ওঠেছিলেন ‘কারার ঐ লৌহকপাট’—এর মতো নিজের লিখা বিখ্যাত গানটি, যা বাঙালিরা এখনো বুকে ধারণ করে আছেন।
মূলত ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাস, গান্ধীজির সত্যাগ্রহ আন্দোলনের জন্য বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী তখন ইংরেজদের হাতে বন্দি। ওই বছরই জেলে যেতে হয় চিত্তরঞ্জনকেও। কবি নজরুল ভাঙার গান লিখেছিলেন চিত্তরঞ্জনের স্ত্রী বাসন্তী দেবীর অনুরোধে। ১৯২২ সালের ২০ জানুয়ারি কবিতা হিসেবে প্রকাশিত হয় ‘কারার ঐ লৌহকপাট’।
পরে নাকি হুগলির জেলে দেশবন্ধু ও অন্য বন্দিরা একসঙ্গে এই গান গাইতেনও। গানের কথা, জেলবন্দিদের মধ্যে তার প্রভাব দেখে সুবিধের লাগেনি ব্রিটিশদের। সরকারবিরোধী প্রচারের জন্য কবিকে ৬ মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়। তড়িঘড়ি ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ করে এই গানটি। এরপর কারাদণ্ডের মেয়াদ আরো বাড়ে।
প্রথমে প্রেসিডেন্সি জেলে নিয়ে গেলেও সেখান থেকে পাঠানো হয়েছিল আলিপুর জেলে। এরপর সেখান থেকে কবিকে পাঠানো হয়েছিল হুগলির জেলে। অমানবিক অত্যাচার চলত। জেলের মধ্যে নজরুল ইসলাম ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটা গাইতেন। তখন যোগ দিতেন সাধারণ কয়েদিরাও।
প্রকৃতপক্ষে এই গানটি নজরুল জেলের কয়েদিদের চাঙা থাকার জন্য এবং ব্রিটিশদের বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ গাইলেও পরবর্তীতে এ গানটি বাঙালির আন্দোলন, সংগ্রামের একটি শক্তিশালী অনুপ্রেরণাদায়ী গান হিসেবে কাজ করছে। আমরা প্রত্যাশা করব শুধু এ আর রহমান নয়, অন্য কেউ যাতে বিদ্রোহী কবি নজরুলের গান নিয়ে এমন ছেলেখেলা না করে।
রতন কুমার তুরী : লেখক এবং শিক্ষক। turiratan49@gmail.com
—সৌজন্যে : ভোরের কাগজ