শাহ জামাল শিশির, ঝিকরগাছা (যশোর) : ফুলের রাজধানীখ্যাত যশোরের গদখালিতে গোলাপ চাষীদের মাথায় হাত উঠেছে। বসন্ত বরণ ও ভালবাসা দিবসের আগে পচন রোগে গোলাপ গাছের ডাল, পাতা ও কুঁড়ি ঝরে পড়ছে। ছত্রাকের আক্রমণে গোলাপ ক্ষেতের ফুল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যেসব ক্ষেতে গোলাপ ফুটেছে তার পরিমাণও কম। এসব কারণে হাসি নেই চাষীদের মুখে। অতিমাত্রায় শীত, কুয়াশা ও অসময়ে বৃষ্টির কারণে গোলাপ ক্ষেতের এই সর্বনাশ ঘটেছে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালি—পানিসারা—হাড়িয়া অঞ্চলের গোলাপ চাষিদের মুখে হাসি নেই। ছত্রাকের আক্রমনে অধিকাংশ বাগানের গোলাপ নষ্ট হয়ে গেছে। যাদের বাগানে ফুল ফুটেছে সেটাও পরিমাণে কম।
কৃষকদের দাবি, কৃষি কর্মকর্তাদের জানিয়েও কিংবা তাদের দেয়া পরামর্শে প্রতিকার মিলছে না। অধিকাংশ কৃষকের অভিযোগ, কৃষি কর্মকর্তারা মাঠে আসেন না। আর কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, চাষিরা নির্দেশনা না মেনে অতিরিক্ত সার কীটনাশক ব্যবহার করার কারণে ছত্রাকের সংক্রমণ ঠেকানো যাচ্ছে না।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, এই অঞ্চলের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে গোলাপ বাগান। সাদা ক্যাপ মোড়ানো গোলাপের কুঁড়ি বাতাসে দুলছে। তবে কৃষকরা বলছেন, গতবছরের তুলনায় এবছর গোলাপের উৎপাদন কম। পঁচা রোগে অধিকাংশ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত। গাছের পাতা, ডাল কিংবা কুঁড়ি পঁচে ঝরে যাচ্ছে। কীটনাশক বা ছত্রাকনাশক স্পে্র করেও মিলছে না সমাধান।
পটুয়াপাড়া গ্রামের ওমর আলী এক বিঘা জমি বাৎসরিক ২০ হাজার টাকায় লিজ নিয়ে গোলাপ চাষ করেছেন। তিনি জানান, এবছর গোলাপ গাছে পঁচা রোগ লেগেছে। গাছের পাতা, ডাল, কুঁড়ি পঁচে যাচ্ছে। বিভিন্ন রকমের ওষুধ দিয়েও আশানুরূপ কাজ হচ্ছেনা। তিনি বলেন, এখনো পর্যন্ত কৃষি বিভাগের কাউকেই মাঠে দেখিনি। তারা কোন পরামর্শও দেয়নি। নিজেদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক স্পে্র করছি।
নীলকন্ঠনগর গ্রামের সাদেক হোসেন ২৫ কাঠা জমিতে গোলাপ চাষ করেছেন। তিনি দাবি করেন, লক্ষ্যমাত্রার তিন ভাগের এক ভাগ ফুলও তিনি তুলতে পারেননি। কুঁড়ি থেকে ফুল ফোটার আগেই সব পঁচে গেছে। যেটুকু ফুল ফুটেছিল তাও রোগাক্রান্ত, ফলে কাক্সিক্ষত দাম পাননি।
নীলকন্ঠনগর গ্রামের শিক্ষার্থী চয়ন হোসেন জানান, ১৫ কাঠা জমিতে তাদের গোলাপের চাষ রয়েছে। এই বাগানের বয়স অন্তত দশ বছর। এবছর পঁচা রোগের কারণে ফুল উৎপাদন কম হয়েছে। কিন্তু খরচ হয়েছে বেশি। চয়ন আরও বলেন, অতি কুয়াশার কারণেই পঁচা রোগ লেগেছে। প্রথমে গাছের পাতায় কিছু কালো দাগ আসে। এরপর ধীরে ধীরে পাতা পড়ে কান্ডে পঁচন লাগে। তারপর ফুল ফোটার আগেই কুঁড়ি নষ্ট হয়ে যায়।
নীলকন্ঠনগর গ্রামের ফুলচাষী সাইফুল ইসলাম বলেন, দেড় বিঘা জমির চায়না গোলাপ পঁচে শেষ হয়ে গেছে। কুয়াশা আর বৃষ্টির কারণে গাছে পঁচন লেগেছে। পাতা, কঁুড়ি শুকিয়ে পড়ে যাচ্ছে। কৃষি অফিসারের পরামর্শে ছত্রাকনাশক স্পে্র করেও কোন কাজ হয়নি।
পটুয়াপাড়া গ্রামের শাহাজান আলী জানান, গতবছর এই মৌসুমে ২৫ কাঠা জমিতে ৮ হাজার গোলাপ ফুলে ক্যাপ পরিয়েছিলেন। কিন্তু এবছর মাত্র ৩ হাজার গোলাপে ক্যাপ পরাতে পেরেছেন। তিনি অভিযোগ করেন, বাগানের এমন খারাপ অবস্থায়ও কোন অফিসার আসেননি বাগানে। পঁচা রোগে পাতা কঁুকড়ে যাচ্ছে। এতে অধিকাংশ কুঁড়ি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, যেগুলো থাকছে সেগুলো শক্ত হয়ে আর ফুটছে না।
যশোর ফুল উৎপাদক ও বিপনন সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুর রহিম জানান, এই অঞ্চলে অন্তত ২৫০ হেক্টর জমিতে গোলাপ চাষ হয়। এবছর অতিশীত ও অসময়ে বৃষ্টির কারণে গোলাপ ও গ্লাডিওলাস চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। গাছের কান্ড, পাতা, ও ফুলের কুঁড়ি পঁচে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন ব্যহত হয়েছে। আশানুরূপ গোলাপ উৎপাদন হয়নি।
তিনি বলেন, কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে দ্রুত ফুল তোলার জন্য যারা বেশি মাত্রায় সার ও সেচ দিয়েছেন তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে কমবেশি সবার ক্ষেতেই ক্ষতি হয়েছে।
উপ—সহকারী কৃষি কর্মকর্তা অর্ধেন্দু পাঁড়ে জানান, গোলাপ গাছে ছত্রাকের আক্রমণ হয়েছে। কৃষকরা কথা শোনেন না। তারা অতিমাত্রায় সার, কীটনাশক ব্যবহার করেন। এতে গাছের পাতায় স্তর তৈরি হয়ে গেছে। ফলে সালোক—সংশ্লেষণের মাধ্যমে গাছ খাবার তৈরী করতে পারেনা। তবে গরমের আবহাওয়া আসার সাথে সাথে পঁচা রোগ ঠিক হয়ে যাবে।
ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, কৃষিবিদ মাসুদ হোসেন পলাশ বলেন, এই অঞ্চলে ৬৫০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ধরণের ফুলচাষ হয়। এরমধ্যে অন্তত ১৫০ হেক্টর জমিতে গোলাপ চাষ হয়, যারমধ্যে ৩০ হেক্টর জমিতে চায়না গোলাপের চাষ হয়।
তিনি বলেন, অতিবৃষ্টি আর কুয়াশার কারণে গোলাপ গাছে পঁচন রোগ ধরেছে। চাষিদের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে আমরা মাঠ পরিদর্শন করেছি। যেসব বাগানের বয়স একবছরের কম সেসব বাগান বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চাষিদের সাথে মতবিনিময় করে এই রোগের জন্য ছত্রাকনাশক স্পে্র করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এখন তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে অবস্থার উন্নতি হয়েছে।