১৯শে মে ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
কালীগঞ্জের পাখাপলস্নীতে ব্যস্ততা
কালীগঞ্জের পাখাপলস্নীতে ব্যস্ততা

নয়ন খন্দকার, কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ) : তাল পাখার শীতল বাতাসে মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়। গ্রীষ্মের আগুন গরমে শরীরে শাšিত্মর পরশ বুলিয়ে দিতে তাল পাখার কোন জুড়ি নেই। আর এই তালপাখা তৈরির জন্য দেশের বেশ কিছু এলাকা বিশেষভাবে সুপরিচিত। তারই একটি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা। এখানে গরমের শুরম্নতেই পাখাপলস্নীর কারিগরদের ব্য¯ত্মতা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। পাখা ব্যবসায়ীদের হাঁকডাক আর ঘরে ঘরে কারিগরদের কাজে এই উপজেলার দুই গ্রামের দেড় শতাধিক পরিবারে এখন ভীষণ গরম হাওয়া বইছে।

সরেজমিন কালীগঞ্জ উপজেলার কোলা ইউনিয়নের পারিয়াট ও রায়গ্রাম ইউনিয়নের দুলালমুন্দিয়া গ্রামে যেয়ে দেখা যায়, কেউ পাতা কেটে সাইজ করছেন, কেউ সেলাই করছেন, কেউ সুতা ও বাঁশের শলাতে রং করছেন। কেউ পাখার বোঝা বাঁধছেন। আবার কেউ পাইকারি ক্রেতাদের সাথে বকেয়া হিসেব ও আপ্যায়নে ব্য¯ত্ম। কাজের ব্য¯ত্মতায় শরীর ঘেমে মাটিতে পড়লেও নিজেদের তৈরি তাল পাখার বাতাস নেওয়ার সময় তাদের নেই। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের পাখা পলস্নী খ্যাত দুলালমুন্দিয়া ও পারিয়াট গ্রামে বর্তমান এ অবস্থা বিরাজ করছে।

দুলালমুন্দিয়া গ্রামের মজনু, ফজলু, রহমত, বিলস্নাল, গফুর, মান্নান, জিন্নাত, চাঁন মিয়া, নুর আলী, আব্দুল বারিক, মো¯ত্মফা ও আব্দুর রহিম সাথে। তারা জানান, তাদের পূর্ব পুরম্নষেরা এই পাখা তৈরীর কাজ করতেন। পূর্ব পুরম্নষদের পেশাটাকে ধরে রাখার জন্য এখনো তারা পাখা তৈরির কাজ করে যাচ্ছেন। কালীগঞ্জের দুলালমুন্দিয়ার ৫০টি পরিবার ও পারিয়াট গ্রামের শতাধিক পরিবার তাল পাখা তৈরি করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছে। জন্মগতভাবে এ পেশাটাকে পেয়ে থাকে বলেই তাদের ছেলেমেয়েরাও বিভিন্ন নকশার পাখা তৈরীতে পারদর্শী।

পাখা কারিগররা জানান, হাত পাখার তৈরীর প্রধান উপকরণ তাল পাতা এই এলাকাতে পাওয়া যায় না। শীত মৌসূমে নড়াইল, মাগুরা, ফরিদপুর ও রাজবাড়ী জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে চারা গাছের পাতা কিনে আনেন তারা। তারপর পাতা রোদে শুকিয়ে পানিতে ভিজিয়ে রাখেন। পরে পানি থেকে উঠিয়ে নরম ভেজা পাতা গোলাকার করে কেটে মাঝখান থেকে দু-খ- করেন। এরপর বোঝা বেঁধে পাতা ঘরে রেখে দেন। পরে আবার তা পানিতে ভিজিয়ে ২৪ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখেন এবং সেখান থেকে নিয়ে সারাবছর বাড়িতে বসে তালপাখা তৈরী করেন। একটি তাল পাতা থেকে দুটি তালপাখা তৈরি হয়।

তিনি আরও জানান, পুঁজি না থাকায় এবং অনেক দূর থেকে পাতা কেনার কারণে পরিবহনে অনেক বেশি খরচ পড়ে যায়। কারিগর মজনু মিয়া জানান, বছরে ২/৩ মাস তাল পাখার বেশী চাহিদা থাকে। চৈত্র থেকে শুরম্ন করে জৈষ্ঠ্য মাস পর্য¯ত্ম বিক্রির মৌসুম হলেও চৈত্র ও বৈশাখ মাসই পাখা বিক্রির উপযুক্ত সময়। প্রচ- তাপদাহ ও বিদ্যুতের লোডশেডিং এ সময়টাতে বেশী হওয়ার কারণে এসময়টাতে তাল পাখার কাটতি বেশী হয়ে থাকে। ফলে এ সময় তাদের ব্য¯ত্মতা বেড়ে যায়। বছরের অন্যান্য মাসে তালপাখার তৈরীর কাজ ও বিক্রি চললেও শীত আসলে বিক্রি বন্ধ। তাই তারা শীতের আগমনকে ভয় পান তারা।
তিনি জানান, পরিবারের ছোটরাও বাবা মায়েদের ব্য¯ত্মতা দেখে বসে থাকতে পারে না। পড়াশুনার পাশাপাশি পাখা তৈরীর বিভিন্ন কাজ করে তারা বড়দের সাহায্য করে।

নুর আলী নামের একজন কারিগর জানান, বিগত বছরগুলোর চেয়ে চলতি বছর পাখার দাম অনেক বেশি। বাঁশ, সুতা রং ও কারিগরদের খরচ বাড়ায় পাখার দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। তারপরও লাভ হচ্ছে কম। কারণ প্রতিটি জিনিসেরই দাম বেশী।
পারিয়াট গ্রামের সলেমত মালিথার ছেলে আব্দুর রাজ্জাক মালিথা জানান, তাদের পরিবার ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে পাখা তৈরির কাজ করছেন। এছাড়া তাদের গ্রামের শতাধিক পরিবার পাখা তৈরির সাথে জড়িত। ওইসব বাড়ির স্ত্রী, কন্যা ও পুত্র সšত্মানরা লেখাপড়ার পাশাপাশি পাখা তৈরি কাজ করেন। তার পরিবারে তিনজন (স্ত্রী, পিতা ও নিজে) পাখা তৈরির কাজ করেন।

তিনি আরো জানান, পাখা তৈরি করতে রং, সুতা, বাঁশ, কুঞ্চি, তালের পাতার প্রয়োজন হয়। একটি তালের পাতা এখন ১০ টাকা দরে তারা ক্রয় করে থাকেন। আগে একটি পাতা ৫ টাকা দিয়ে কিনতেন। এখন দাম বেড়ে দ্বিগুন হয়েছে। আর যারা পাখা সেলাইয়ের কাজ করেন তারা পাখা প্রতি ২ টাকা করে পান। এছাড়া একটি বাঁশ কিনতে হয় ৪শ’ থেকে সাড়ে ৪শ’ টাকা দিয়ে। আর একশত গ্রাম রং কিনতে হয় ২০০ টাকা দিয়ে। সব মিলিয়ে একটি পাখা তৈরি করতে আগে খরচ পড়তো ৮/১০ টাকা । আর এখন একটি পাখা তৈরি করতে খরচ পড়ছে ২০ টাকা। আর তারা পাইকারী বিক্রি করে থাকেন ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। তাদের কাছ থেকে পাখা কিনে খুচরা বিক্রিতারা একটি পাখা ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি করছেন।

একজন কারিগর প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০ টি তালপাখা তৈরী করতে পারেন। ফলে প্রতিটি কারিগর বিক্রির মৌসূমে দিনে যাবতীয় খরচবাদে প্রায় ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা আয় করতে পারেন। পাইকাররা এখন বাড়ি থেকেই পাখা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। ফলে পরিবহন খরচ থেকে রেহাই পাচ্ছেন তারা।

তার স্ত্রী রোকেয়া বেগম জানান, তাদের গ্রামের গৃহবধূরা গৃহস্থলী কাজের পাশাপাশি পাখা তৈরি করে থাকেন। মহিলারা পাখায় শলা বাঁধা, সেলাই করা ও রংঙের কাজ করেন। পারিয়াট গ্রামের আলস্নাদী বেগম, রেক্সোনা খাতুন, কুলসুম বেগম, পিঞ্জিরা বেগম, রেশমা খাতুন, পারভিনাসহ শতাধিক নারী এসব পাখা তৈরি কারিগরের সাথে জড়িত।

বর্তমানে তাদের তৈরি করা পাখা ঝিনাইদহ জেলা ছাড়াও এখন চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, আলমডাঙ্গাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। তাদের গ্রামে আইনাল, মিন্টু, আমজাদ, ঝন্টু, সাহেব আলী, বাদশা, আব্বাস, আইজলী, মাসুদ, ইব্রাহিম বিশ্বাসের পরিবার ছাড়া দেড় শতাধিক পরিবার পাখা তৈরির সাথে জড়িত।

আব্দুর রাজ্জাক জানান, তাদের পুঁজি কম। তাই অল্প পুঁজি নিয়ে এ পেশা এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন। সরকার যদি পাখা কারিগরদের বিনামূল্যে ঋণের ব্যবস্থা করে দিত তাহলে এ শিল্পকে ধরা রাখা যেত।

জোছনা নামের এক গৃহবধূ জানান, তালপাতা দিয়ে পাখা তৈরী করে শরীর ঘেমে মাটিতে পড়লেও বাতাস নেওয়ার সময় তাদের হয় না। কারণ রান্নবান্না ও গৃহস্থলীর কাজের পাশাপাশি তাদেরকে পাখা তৈরীর কাজে ব্য¯ত্ম থাকতে হয়।

কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইসরাত জাহান জানান, উপজেলার দুইটি ইউনিয়নের যেসব গ্রামে পাখা তৈরি হচ্ছে সে শিল্পের বিষয়টি আমার নলেজে আছে। কুটির শিল্পের বিষয়ে একটি প্রকল্প হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতিমধ্যে সরকারের কাছে আমি তাদের তালিকা পাঠিয়েছি।
এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এবং যারা এ পেশার সাথে জড়িত তাদের পরিবারের উন্নয়ন করার জন্য সাধ্য মত চেষ্টা করা হবে।

 

 

সম্পাদক ও প্রকাশক : শাহীন চাকলাদার  |  ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আমিনুর রহমান মামুন।
১৩৬, গোহাটা রোড, লোহাপট্টি, যশোর।
ফোন : বার্তা বিভাগ : ০১৭১১-১৮২০২১, ০২৪৭৭৭৬৬৪২৭, ০১৭১২-৬১১৭০৭, বিজ্ঞাপন : ০১৭১১-১৮৬৫৪৩
Email : samajerkatha@gmail.com
পুরাতন খবর
FriSatSunMonTueWedThu
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31 
স্বত্ব © samajerkatha :- ২০২০-২০২২
crossmenu linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram