১৭ই মে ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৩রা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস
‘আইন মেনে সড়কে চলি, নিরাপদে ঘরে ফিরি’

সমাজের কথা ডেস্ক : নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে বিপুল পরিমাণ অবকাঠামোগত উন্নয়নকাজ হয়েছে; কিন্তু ব্যবস্থাপনাগত উন্নয়ন না হওয়ায় সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছে না। সড়কে দুর্ঘটনা বৃদ্ধির সাথে হতাহতের সংখ্যাও বাড়ছে। দুর্ঘটনাগুলোতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু কিংবা পঙ্গুত্ববরণ করায় ধুঁকছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার। শুধু একেকটি পরিবারই নয়, সড়ক দুর্ঘটনার কারণে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনেরও (জিডিপি) বিপুল ক্ষতি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবহন চালকদের অসতর্কতা, আইন না জানা, আইন অমান্য করা ও বেপরোয়া গাড়ি চালনা এবং যানবাহনের ফিটনেস ও চালক বাছাইয়ে পরিবহন মালিকদের অবহেলা এবং অতি ব্যাবসায়িক মনোবৃত্তি সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান দুই কারণ। তবে পরিবহন মালিক—শ্রমিকদের বেপরোয়া মনোভাবে লাগাম পরানোর মতো যথাযথ তদারিক ব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি।

জানা গেছে, সড়ক পরিবহন আইনের পর বিধিমালা প্রণয়ন করে সরকার; কিন্তু সেখানে সড়ক নিরাপত্তার দিকটি গুরুত্ব পায়নি। দেশ স্বাধীনের পর আজও করা হয়নি আনফিট গাড়ির তালিকা। গাড়ি চালাতে নিয়ম মানছেন না চালকেরা। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে আজ সপ্তম বারের মতো পালন করা হচ্ছে ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’। এবারের প্রতিপাদ্যÑ ‘আইন মেনে সড়কে চলি, নিরাপদে ঘরে ফিরি’।

<< আরও পড়তে পারেন >> সড়ক দুর্ঘটনার করুণ আর্তচিৎকার থামবে কবে?

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে যাত্রীকল্যাণ সমিতির এক হিসাবে দেখা গেছে, দেশে ২০১৫ সালে ৬ হাজার ৫৮১টি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ৮ হাজার ৬৪২ জন মারা যান। এর মাঝে কয়েক বছর এ সংখ্যা একটু কমলেও ২০২২ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ৬ হাজার ৭৪৯টি। এতে মৃত্যু হয় ৯ হাজার ৯৫১ জনের। এতে দেখা যাচ্ছেÑ গত সাত বছরে সড়কে অনেক অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও দুর্ঘটনা ও মৃত্যু কমছে না।

একাধিক গবেষণায় সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের অদক্ষতা ও শারীরিক—মানসিক অসুস্থতা, চালকদের বেতন—কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, তরুণ—যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতি এবং গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজিকে।

গবেষণাগুলোতে উঠে এসেছেÑ সাধারণত পেশাদার গাড়িচালকদের যতটুকু ট্রাফিক আইন জানা উচিত, তুলনামূলকভাবে তার চেয়ে অনেক কম জানেন তারা। কোন জায়গায় গতি কমাতে হবে আর কোথায় থামা যাবে নাÑ এসব বিষয়ে তারা কম সচেতন। চালকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) একটি কর্মসূচি পরিচালনা করা হয়; কিন্তু তা খুবই অপ্রতুল। এক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার ঘাটতি রয়েছে।

সড়কে অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা বন্ধ করে সবাইকে ট্রাফিক আইন মেনে চলার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৯ অক্টোবর সড়ক ভবনে বলেছেন, ‘চালকদেরকে মনস্তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। যারা বাস, ট্রাক বা অন্য গাড়ি চালায়Ñ রাস্তায় তাদের যে একটা অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা, ওভারটেক করার প্রবণতা তা বন্ধ করতে হবে। আমি ড্রাইভারদের বলবÑ দুর্ঘটনায় শুধু মানুষের জীবন যায় তা না, নিজেরও তো ক্ষতি হয়। গতি মেনে চলতে হবে। সড়কে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হবে।’

সড়ক—মহাসড়কে বিপুল পরিমাণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন সত্ত্বেও দুর্ঘটনা না কমায় আক্ষেপ ঝরেছে খোদ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কণ্ঠেও। অন্য এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেনÑ ‘এত মেগা প্রজেক্ট, এত উন্নয়ন করার পরও স্বস্তি পাচ্ছি না দুর্ঘটনার কারণে। কেন হবে? আমরা কি এটা এড়াতে পারি না? সড়ক দুর্ঘটনায় দেশে ৩৫ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক ক্ষতি হয়। আমাদের ভাবনার চেয়ে বাস্তবায়ন খুবই ধীরগতি।’

সড়কে ব্যবস্থাপনার ঘাটতি দেখা যাবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবেও। সরকারি সংস্থাটির তথ্যে জানা গেছে, দেশে নিবন্ধিত মোট মোটরযানের সংখ্যা ৫৮ লাখের বেশি। গত মার্চ পর্যন্ত ড্রাইভিং লাইসেন্সের সংখ্যা ৫৯ লাখ ৫৬ হাজার ৫২৩। এতে সংখ্যার দিক থেকে মোটরযান ও ড্রাইভিং লাইসেন্স সমান বটে। তবে প্রকৃত পক্ষে এক ব্যক্তির একাধিক (হালকা যান ও ভারী যান) এবং দূরপল্লার একটি বাসের জন্য একাধিক চালক প্রয়োজন। এ বিবেচনায় দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যার চেয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স অনেক কম।

বিআরটিএ বলছে, বর্তমানের হারে যানবাহনের নিবন্ধন চলতে থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ যানবাহনের সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে যাবে। এ সময় চালকের প্রয়োজন পড়বে প্রায় দেড় কোটি। সংশ্লিষ্টদের মতে, ফিটনেস প্রক্রিয়াটি সঠিকভাবে করা না গেলে এবং যানবাহনের কাঠামোগত দুর্বলতা দূর করতে না পারলে সড়কে প্রাণহানি ঘটবে। চিন্তার বিষয় হচ্ছেÑ দেশে কী পরিমাণ ফিটনেসবিহীন গাড়ি রয়েছে, তার কোনো হিসাব বিআরটিএর কাছে নেই।

এ বিষয়ে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, নবায়নের ফি পরিশোধ না করার হিসাব থেকে ফিটনেসবিহীন গাড়ি বলা হয়; আদতে এটি সঠিক নয়। মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি হিসাবে গড়ে বলা হয় ৫ লাখ। কারিগরিভাবে কতগুলো গাড়ি আনফিট তা নির্ণয়ের প্রক্রিয়া চলছে। প্রাইভেট অনেক গাড়ি কোনো কারণে যথাসময়ে ফি দিতে পারেনি। সেগুলোও কিন্তু ওই ৫ লাখের তালিকায় আছে। তাই প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয়ে কাজ চলছে।

যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাব মতে, মোট যানবাহনের মধ্যে ফিটনেসবিহীন বাস ২০ শতাংশ, ট্রাক—কাভার্ডভ্যান ২০—২৫ শতাংশ, পিকআপের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ হতে পারে। আর নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত হিউম্যান হলারের ৮০ শতাংশই ফিটনেসবিহীন।

সড়ক পরিবহন আইন অনুসারে একটি বাসের ফিটনেস সনদ দেওয়ার আগে অন্তত ৬০ ধরনের পরীক্ষা—নিরীক্ষা করার কথা। এর মধ্যে যানবাহনের ওজন, টায়ারের বিট, গতি ও ব্রেক ঠিকমতো কাজ করছে কিনাÑ এগুলো মূল বিষয়। বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয়ে যন্ত্রের সাহায্যে (ভেহিকল ইন্সপেকশন সেন্টার—ভিআইসি) পরীক্ষা করার সুযোগ তৈরি হয়েছে গত ১৯ অক্টোবর। প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে এর কার্যক্রমের উদ্বোধন করেছেন। ১২টি লেনে দৈনিক ৫০০ গাড়ির ফিটনেস যাচাই করা যাবে সেখানে। পর্যায়ক্রমে দেশের অন্যান্য স্থানেও এটি চালুর কথা রয়েছে; কিন্তু সমস্যা হচ্ছেÑ এরকম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল আরও আগে। ১৯৯৭ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ৪০ কোটি টাকায় রাজধানীর মিরপুর ও ইকুরিয়া, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও খুলনায় যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করা হলেও তা একবারের জন্যও ব্যবহার করা যায়নি। পরে ২০১৬ সালে মিরপুর কার্যালয়ের ভিআইসি কোরিয়ান ইন্টারন্যাশনাল কো—অপারেশন এজেন্সির সহায়তায় নতুন যন্ত্রপাতি সংযোজন করে চালু করা হয়; কিন্তু চালুর কয়েক দিন পর আবার অকার্যকর হয়ে যায়। এবার নতুন করে ঢাকার মিরপুরে স্বয়ংক্রিয় মোটরযান ফিটনেস পরীক্ষাকেন্দ্র (ভিআইসি) স্থাপনে ব্যয় ধরা হয়েছে ১২১ কোটি ২৪ লাখ টাকা।

ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচলের কারণ জানতে চাইলে বিআরটিএ বলে, এটি পুলিশ বিভাগের দায়িত্ব। তারা এনফোর্স করে। আর পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, যানবাহনের ফিটনেস সনদ দেয় বিআরটিএ। নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে অভিযান চালায় পুলিশ। সনদ ছাড়া ফিটনেসবিহীন গাড়ি পেলে ডাম্পিং করা হয়, মামলা দেওয়া হয়। অর্থাৎ দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে।

সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে হার্ট ফাউন্ডেশনের রোড সেফটি ও প্রিভেনশন প্রোগ্রামের পরিচালক ডা. মাহফুজুর রহমান ভূঁইয়া একটি প্রবন্ধে বলেছেন, শুধু ৫ শতাংশ গতি নিয়ন্ত্রণ ও পরিবীক্ষণের মাধ্যমে ৩০ শতাংশ মৃত্যুঝুঁকি কমানো সম্ভব। সিটবেল্ট বাঁধলে মৃত্যুঝুঁকি কমে ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ। শিশুদের জন্য বিশেষায়িত সিটের ব্যবস্থা করলে ৫৪ থেকে ৮০ শতাংশ ঝুঁকি কমে। সঠিক মানের হেলমেট ব্যবহারে মৃত্যুঝুঁকি ৪০ শতাংশ এবং গুরুতর আঘাতের ঝুঁকি ৭০ শতাংশ কমে।

এই বিষয়ে সড়ক পরিবহন বিধিমালায় স্পষ্ট কিছু নেই। বিধিমালায় গুরুত্ব পায়নি সড়ক নিরাপত্তা। ১৬৭টি বিধির মাত্র পাঁচটিতে নিরাপত্তার বিষয়ে বলা হয়েছে। বাকিগুলোতে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা সংক্রান্ত। বিধিমালার ১২৫—এ গতিসীমা নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও কীভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করা হবে, তা বলা নেই। সিটবেল্টের বিষয়েও বিবিধমালায় স্পষ্ট নির্দেশনা নেই। সূত্র : আমাদেরসময়

সম্পাদক ও প্রকাশক : শাহীন চাকলাদার  |  ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আমিনুর রহমান মামুন।
১৩৬, গোহাটা রোড, লোহাপট্টি, যশোর।
ফোন : বার্তা বিভাগ : ০১৭১১-১৮২০২১, ০২৪৭৭৭৬৬৪২৭, ০১৭১২-৬১১৭০৭, বিজ্ঞাপন : ০১৭১১-১৮৬৫৪৩
Email : samajerkatha@gmail.com
পুরাতন খবর
FriSatSunMonTueWedThu
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31 
স্বত্ব © samajerkatha :- ২০২০-২০২২
crossmenu linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram