১৯শে মে ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
‘অবৈতনিক’ হচ্ছে নিম্ন মাধ্যমিক স্তর
‘অবৈতনিক’ হচ্ছে নিম্ন মাধ্যমিক স্তর

সমাজের কথা ডেস্ক : বর্তমানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে (অবৈতনিক শিক্ষা) পড়াশুনা করছেন শিক্ষার্থীরা। এটি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করতে যাচ্ছে সরকার। ফলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়তে পারবেন শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষাকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রথম ধাপে নিম্ন মাধ্যমিক স্তরকে অবৈতনিক করা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে শিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় আলাদা আলাদা উদ্যোগ নিয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে শিক্ষা জাতীয়করণের পথ সুগম হবে— এমনটা মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।

সূত্র বলছে, বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী চলতি বছরের জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি অগ্রাধিকার কিছু খাত নির্বাচন করেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো- নিম্ন মাধ্যমিক স্তরে অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা। এরই অংশ হিসেবে রোববার (৫ মে) শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে দেশের বিশিষ্ট কয়েকজন শিক্ষাবিদ, দুই মন্ত্রণালয়ের তিন সচিব, মহাপরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সভায় ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে দুই মন্ত্রণালয় যৌথভাবে কাজ করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
যদিও ২০১৯ সালে প্রথম এই কার্যক্রম শুরু হয়। ওই সময় বলা হয়েছিল, ২০২৩ সালের মধ্যে নিম্ন মাধ্যমিক এবং ২০২৫ সালের মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক বা দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হবে। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায়। করোনার পর সরকার আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়ে। সে কারণে ওই উদ্যোগে আর হাত দেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বিনা মূল্যে পাঠ্যবই ও উপবৃত্তি দিয়ে আসছে সরকার। এটি কিন্তু সারা বিশ্বের বিস্ময়! এর সুফল পাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। এখন সরকারের পরবর্তী টার্গেট বিনা বেতনে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা করানো। এজন্য এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এমন উদ্যোগ নেওয়ার যুক্তি তুলে ধরে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘প্রাথমিক সমাপনীতে পাস করা ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে এসএসসিতে অংশ নেয় ২১ বা ২২ লাখ। অর্থাৎ পাঁচ বছরের ব্যবধানে আট লাখের বেশি শিক্ষার্থী ঝরে যায়। এ বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী অদক্ষ হয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। আমাদের লক্ষ্য এই শিক্ষার্থীদের ক্লাস রুমে ধরে রাখা।’

‘নিম্ন মাধ্যমিক স্তর যদি অবৈতনিক করা যায় তা হলে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেকাংশে কমানো সম্ভব। আমরা চাই নিম্ন মাধ্যমিক অবৈতনিকের পাশাপাশি এ স্তরের শিক্ষার্থীদের কারিগরি শিক্ষা দেওয়া। যাতে তারা দক্ষ হয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারে। দেশ ও বিদেশে সে আর অদক্ষ শ্রমিক হয়ে থাকবে না।’

জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশে যৌথ সভা ডাকা হয়। বিষয়টি একদমই প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। তথ্য দেওয়ার মতো সময় হয়নি।

মাধ্যমিক শাখার একজন উপসচিব বলেন, শিক্ষামন্ত্রী দ্রুত সময়ের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন করার নির্দেশনা দিয়েছেন। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে ফের সভা ডাকা হবে।

যেসব সুবিধা পাবেন শিক্ষার্থীরা

বর্তমানে দেশের সরকারি প্রাথমিক স্কুলে বিনা বেতনে শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা করার সুযোগ পান। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক হলে প্রাথমিকের মতো তারাও বিনা বেতনে পড়তে পারবেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লেখাপড়ার পেছনে শিক্ষার্থীদের বড় দুই দাগে ব্যয় হয়। একটি প্রাতিষ্ঠানিক, অন্যটি পারিবারিক। পারিবারিক ব্যয়ের মধ্যে আছে খাতা, কলম, জামা-কাপড় ইত্যাদি। অবৈতনিক হলে প্রাতিষ্ঠানিক খরচ সরকার বহন করবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক এক জরিপে বলা হয়েছে, বর্তমানে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছে ৪৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। বাকি ৫৩ দশমিক ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। তবে, সম্প্রতি ইউনেস্কোর গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্টের প্রতিবেদন বলছে, দেশের ৫৫ শতাংশ শিশু প্রাক-প্রাথমিক স্তরে বিভিন্ন ধরনের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়। মাধ্যমিক পর্যায়ে এই হার ৯৪ শতাংশ, যা বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ২০১২ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে এ খাতের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ। ছয় হাজার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিপরীতে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে মাত্র ৯০০টি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক শাখার একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করে এ প্রসঙ্গে বলেন, সরকারের পরবর্তী টার্গেট উচ্চ মাধ্যমিক বা দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়ালেখার ব্যবস্থা করা। ইতোমধ্যে বিনা মূল্যে পাঠ্যবই ও সমন্বিত উপবৃত্তি দিয়ে এ কার্যক্রমের অনেকাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। বিনা বেতনে কাজটি করতে পারলে জাতীয়করণের কাজটি অনেক দূর এগিয়ে যাবে।

যেভাবে সংস্থান হবে টিউশন ফি’র

এ সংক্রান্ত কৌশলপত্র তৈরির সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, অবৈতনিক শিক্ষা বাস্তবায়ন করা হলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো টিউশন বা অন্যান্য ফি আদায় করা হবে না। এর পরিবর্তে সরকার দুভাবে টিউশন ফি’র সংস্থান করবে। একটি হচ্ছে, প্রত্যেক স্কুল-মাদ্রাসা একই হারে টিউশন ফি নেবে। সেই ফির অর্থ সরকার শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠাবে। শিক্ষার্থীরা তা স্কুলে জমা দেবে। অথবা, ধার্য টিউশন ফি সরকার সরাসরি প্রতিষ্ঠানে পাঠাবে।

ওই কর্মকর্তা বলেন, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পেছনে সরকার কত টাকা ব্যয় করবে, তা আলাদাভাবে নির্ধারণ করা হবে। এরপর সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্রেণিভিত্তিক মোট কত টাকা সরকার ব্যয় করবে, তা বের করা হবে। এ ক্ষেত্রে স্কুলের টিউশন ফি ও অন্যান্য ব্যয় হিসাবে আনা হবে।
তিনি জানান, বর্তমানে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ১০০, সপ্তম শ্রেণিতে ১৫০ এবং অষ্টম শ্রেণিতে প্রস্তাবিত টিউশন ফি ২০০ টাকা নির্ধারণ করা আছে। নবম ও দশম শ্রেণিতে যথাক্রমে ৩০০ ও ৫০০ টাকা এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা আছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, আপাতত অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষাকার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আগামী ছয় বছরের মধ্যে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের টিউশন ও সেশন ফিসহ প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের ব্যয় বহন করবে সরকার।
সংযুক্ত অষ্টম শ্রেণির স্কুলের তালিকা চেয়েছে ডিপিই

শিক্ষানীতি-২০১০ অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে আট বছর করার কথা ছিল। এর অংশ হিসেবে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারণ করার কথা। কিন্তু বিগত ১৩ বছরে মাত্র ৬৯৬টি বিদ্যালয় সম্প্রসারণ করা হয়েছে। সেগুলো নিয়েও নানা জটিলতা রয়েছে।

সর্বশেষ তথ্য হলো, দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারণের কাজ আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরই অংশ হিসেবে দেশে কতগুলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে, তার তথ্য চেয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)। গত ৩০ এপ্রিল বিভাগীয় পরিচালক ও জেলা শিক্ষা অফিসারদের কাছ থেকে তথ্য চাওয়া হয়েছে। অধিদপ্তরের অফিস আদেশে দেশের কতটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস চালু করা যাবে— নির্ধারিত ছকে সে তথ্য চাওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ্ রেজওয়ান হায়াত ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে এটি বলা ছিল। করোনাসহ নানা কারণে এত দিন এটার কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি।

‘আমাদের ৬৯৬টি বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষাকার্যক্রম চলমান আছে। এখন যেসব বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকার্যক্রম চালু করব সেসব বিদ্যালয়ে অবকাঠামো থাকতে হবে। আমাদের শিক্ষক রয়েছে, তবে তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এটা আরও এক দশক আগে হওয়ার কথা ছিল। সরকারের নানা নীতির কারণে হয়নি। তারপরও সরকার আবারও শুরু করতে যাচ্ছে। এটাকে স্বাগত জানাই।’

‘এসডিজিতে বলা আছে, সরকার দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়ালেখা করাবে। সরকার সেখানে স্বাক্ষর করেছে। এখন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক ব্যবস্থা চালু করতে পারলে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত এটি উন্নীত করার পথ সুগম হবে।’

#

সম্পাদক ও প্রকাশক : শাহীন চাকলাদার  |  ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আমিনুর রহমান মামুন।
১৩৬, গোহাটা রোড, লোহাপট্টি, যশোর।
ফোন : বার্তা বিভাগ : ০১৭১১-১৮২০২১, ০২৪৭৭৭৬৬৪২৭, ০১৭১২-৬১১৭০৭, বিজ্ঞাপন : ০১৭১১-১৮৬৫৪৩
Email : samajerkatha@gmail.com
পুরাতন খবর
FriSatSunMonTueWedThu
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31 
স্বত্ব © samajerkatha :- ২০২০-২০২২
crossmenu linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram