নিজস্ব প্রতিবেদক : পদক নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে কিংবদন্তী গীতিকবি—চিত্রনাট্যকার মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় স্বীকৃতি নিয়ে তিনি প্রকাশ্যেও সমালোচনা করেছেন। বলেছেন, অযোগ্যদের চাপে কেমন করে এসব পদক হাতছাড়া হয়ে যায় যোগ্যদের। পদক প্রাপ্তি—প্রদান এবং এর প্রক্রিয়া নিয়ে সবসময় কঠোর সমালোচনা করা মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান এবার মনোনীত হয়েছেন স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য।
সংস্কৃতিতে জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানকে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রদান করার গেজেট প্রকাশ করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ১৫ মার্চ প্রকাশিত এই গেজেটে জানানো হয় বিভিন্ন অঙ্গনের এমন আরও ৯ জন কৃতী সন্তানের নাম।
শুক্রবার (১৫ মার্চ) এই গেজেট প্রকাশের পর মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, খুশি হয়েছি খবরটি পেয়ে। খুশি হওয়ার কারণ, পদক পাচ্ছি সেটা কিন্তু নয়। মূল খুশির কারণ, সরকারের কাছে আবেদন না করেও যে এমন পদক পাওয়া যায়, সেটা ভেবে। আমি এ পর্যন্ত কোনও পদক ও প্রাপ্তির জন্য আবেদন করিনি। আমি জানি না, আমার হয়ে অন্য কেউ করেছেন কিনা। সেটাও জানি না। এই না জানার মধ্যে অপ্রত্যাশিতভাবেই পদকটির খবর পেলাম। এটা সত্যিই ভালো লাগার বিষয়।’
মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান পরিবেশ বদলাতে প্রায়শই ঢাকার চার দেয়াল থেকে বেরিয়ে সস্ত্রীক চলে আসেন যশোরে, পৈত্রিক নিবাসে। পদকপ্রাপ্তির খবরটি যশোরে বসেই পেয়েছেন। তবে সরকারিভাবে কেউ এখনও তার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ করেননি বিষয়টি নিয়ে।
রফিকউজ্জামান বলেন, ‘এই প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তি প্রসঙ্গে আরও বিস্তারিত বলতে পারবো, আনুষ্ঠানিকভাবে কথা হলে। আমাকে দ্রুত ঢাকায় যেতে বলেছেন কেউ কেউ। ভাবছি কালই (১৬ মার্চ) ঢাকায় যাবো। এরপর নিশ্চয়ই দাফতরিকভাবে সংশি¬ষ্টরা যোগাযোগ করবেন। তবে তার আগে ধন্যবাদ জানাতে চাই বাংলাদেশ সরকারকে, তারা আমাকে নিজ দায়িত্বে এই পদকের যোগ্য মনে করেছেন বলে।’
গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান তিনবার (১৯৮৪, ১৯৮৬, ২০০৮) জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। অনেকেই মনে করেন এই সংখ্যাটা কমপক্ষে দ্বিগুণ হতে পারতো। মূলত কেন হয়নি সেই প্রশ্নের জবাবে গীতিকবি বেশ আক্ষেপ নিয়ে বলেন তার বেদনার কথা। সাম্প্রতিক এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে তিনি একটি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘৯৫ সাল। তখন আমার পেনশন কেসটা ঝুলছিল। বিএনপি সরকার ক্ষমতায়। আমার বন্ধু তরিকুল ইসলাম তথ্যমন্ত্রী ছিল। তারপরও আমার পেনশন হচ্ছিল না।
ওই হয়, হয় না। ঘুরতে থাকলাম। একদিন পেনশনের খোঁজ নিতে গেছি মন্ত্রণালয়ে। যাওয়ার পরে অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি দৌড়ে এসে বললো, ‘আরে রফিক ভাই, আপনার তো দারুণ সুখবর আছে’। আমি বললাম, আমার পেনশনের ফাইল সই হয়েছে ? সে বললো, ‘আরে না না, আসেন’। একেবারে টেনে নিয়ে গেছে ভেতরে। দেখালো, ফিল্ম জুরি বোর্ড তিন বছরের পুরস্কার একসঙ্গে দিচ্ছে। গান আর চিত্রনাট্য মিলিয়ে আমি একসঙ্গে সাতটা পুরস্কার পাচ্ছি! জুরি বোর্ড থেকেই এই রায় এসেছে। তারপর যখন পত্রিকায় চূড়ান্ত তালিকা দেখলাম, কোথাও নেই আমি! একটি পদকও পাইনি।’
মূলত সেই ঘটনার পরই কবি সিদ্ধান্ত নেন জাতীয় কোনো পদক না গ্রহণের। তিনি বলেন, এসব ঘটনার পরেই আমি ঘোষণা দিয়েছি, জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় কোনও পুরস্কার বা পদক আমি পেলেও গ্রহণ করবো না। কখনোই না। সেটা যে সরকারই হোক, যে কারণেই হোক। এসব অনেক কিছু হয়, অনেক কিছুই ঘটে জীবনে। এগুলো নিয়ে আমার কিন্তু কোনও ক্ষোভ নেই। শেষবার ২০০৮ সালে যখন পুরস্কার নিয়ে বের হই, আমাকে কয়েকজন সাংবাদিক বললেন, ‘রফিক ভাই আপনার অনুভূতি বলেন’। বললাম, ভাই গরিব মানুষ আমি। টাকা পয়সার খুব অভাব। এক লাখ টাকা পেয়েছি, খুব কাজে লাগবে। এটার জন্য ধন্যবাদ। ওরা বললো, ‘আর ট্রফি?’ তখন আমি এগিয়ে দিয়ে বললাম, নিয়ে যান এটা। আমার কোনও দরকার নেই।
১৯৬৫ সাল থেকে বাংলাদেশে বেতারে নিয়মিত গীতিকার হিসেবে লিখছেন মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান। তার প্রকাশিত গানের সংখ্যা দুই হাজারের বেশি। ১৯৭৩ সাল থেকে তিনি নিয়মিত চলচ্চিত্রের জন্য গান লিখছেন। শতাধিক চলচ্চিত্রের জন্য গান লিখেছেন তিনি। ১৯৬১—১৯৮৭ সাল পর্যন্ত মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান মঞ্চ, বেতার ও টেলিভিশনের জন্য শতাধিক নাটক লিখেছেন ও অভিনয় করেছেন।
তার লেখা উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে, সেই রেললাইনের ধারে মেঠো পথটার পারে দাঁড়িয়ে, বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম, দুঃখ আমার বাসর রাতের পালঙ্ক, আমার মতো এত সুখী নয়তো কারও জীবন, ভালোবাসা যত বড় জীবন তত বড় নয়, আমার মন পাখিটা যায়রে উড়ে যায়, পদ্ম পাতার পানি নয়, মাঠের সবুজ থেকে সূর্যের লাল, কিছু কিছু মানুষের জীবনে ভালোবাসা চাওয়াটাই ভুল, মনটা সবাই দিতে পারে আমি তোমায় প্রাণটা দিতে চাই প্রভৃতি।
এদিকে, জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য এ বছর ১০ বিশিষ্টজনকে স্বাধীনতা পুরস্কার দিচ্ছে সরকার। সংস্কৃতিতে স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান। মনোনীত ব্যক্তিদের মধ্যে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পাচ্ছেন তিন জন। তারা হলেন—কাজী আব্দুস সাত্তার, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফ্লাইট সার্জেন্ট মো. ফজলুল হক (মরণোত্তর) এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আবু নঈম মো. নজিব উদ্দীন খাঁন (খুররম) (মরণোত্তর)।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে স্বাধীনতা পুরস্কার পাচ্ছেন ড. মোবারক আহমদ খান; চিকিৎসাবিদ্যায় ডা. হরিশংকর দাশ; ক্রীড়ায় ফিরোজা খাতুন। সমাজসেবা বা জনসেবা ক্যাটাগরিতে অরণ্য চিরান, বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা. মোল¬া ওবায়েদুল্লাহ বাকী ও এস.এম. আব্রাহাম লিংকন। স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ১৮ ক্যারেট স্বর্ণের ৫০ গ্রাম ওজনের একটি পদক, তিন লাখ টাকা এবং সম্মাননাপত্র দেওয়া হয়।