সাইফুল ইসলাম : যশোর শহরের বাসিন্দা এক প্রকৌশলীর নবম শ্রেণি পড়ুয়া সন্তান গালিব। পড়ে শহরের একটি সরকারি স্কুলে। যেখানে নিয়মিত ক্লাসের বাইরেও অতিরিক্ত ক্লাস করানো হয়। এরপরেও গালিবের গৃহশিক্ষক রয়েছে ৫জন। যারা পৃথক ৫ টি বিষয় পড়াচ্ছেন। এর বাইরে মায়ের কাছেও পড়ে সে। দুটি কোচিং সেন্টারেও যেতে হয় তাকে। গালিবের ভাষায়, স্যাররা তাদের দায়িত্ব পালন করেন, আমরা শিখছি কি না তা জানার চেষ্টা করেন না। হোম টিউটরের কাছে সহজেই শেখা যায়। তাদের নিজস্ব কৌশল আছে।
গালিবের মত অসংখ্য শিক্ষার্থী স্কুলের চেয়ে কোচিংকে বেশি ভালোবাসে। স্কুল, গৃহশিক্ষক, কোচিং সামাল দিতে যেয়ে তারা অন্য কোনো দিকে নজর দিতে পারছে না, এরপরও কোচিংয়ে পড়া নিয়ে এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলছে। এতে শিক্ষা ব্যয় অসম্ভব বেড়ে যাচ্ছে। যাদের সামর্থ্য কম তারাও সন্তানের ভবিষ্যতের চিন্তা করে কোচিং ও হোম টিউটরের দিকে ঝুঁকছেন।
বিগত ১৫ দিন শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে অপেক্ষমান শতাধিক অভিভাবকদের সাথে আলাপকালে এ চিত্র উঠে এসেছে। অভিভাবকরা জানিয়েছেন, ‘যার টাকা নেই তার শিক্ষা নেই। সন্তানদের প্রাইভেট কোচিং দিতে না পারলে মনটা ছোট হয়ে যায়। মনে হয় সন্তানের ভবিষ্যৎ নষ্ট করছি। প্রাইভেট ছাড়া সন্তানরাও লেখাপড়া করতে চায় না। ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে না পারলে আফসোস করে না, কিন্তু কোচিং করতে চায়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদনেও দেখা যায়, শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ ২৯.১৩ শতাংশ ব্যয় হয় প্রাইভেট ও কোচিংয়ের পেছনে। শহরে এই ব্যয় আরো বেশি ৩২.৮০ শতাংশ আর মফস্বলে ২৬.২০ শতাংশ।
অভিভাকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, স্কুল-কলেজে পড়াশোনা হয় নামমাত্র। শিক্ষার্থীরা এখন পুরোপুরি নির্ভরশীল কোচিং ও প্রাইভেটের ওপর। এই খাতে খরচ করতে করতে দিশাহারা অভিভাবকরা। তাই যে অভিভাবকের আয় যত বেশি তার সন্তান তত ভালোমানের পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য শহরের চেয়ে রাজধানীতে পড়ালেখার ব্যয় প্রায় দেড় গুণ।
নতুন শিক্ষাক্রম চালুর পর শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েছে। তাদের চিন্তা স্কুলে আর লেখাপড়া হবে না। ছেলেমেয়েরা আর কিছু শিখতে পারবে না। ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি কিংবা ভবিষ্যতে চাকরির প্রতিযোগিতায় শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়বে। বিকল্প হিসেবে কোচিংকে গুরুত্ব দিচ্ছেন অভিভাবকরা।
যশোর শিক্ষা বোর্ড মডেল স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থী আয়েশা আক্তার জানায়, বাবা পড়ানোর সময় পাই না। আর তার মায়ের কাছে পড়তে ইচ্ছা করে না, তাই বাসায় স্যারের কাছে পড়ে। এতে করে তার পড়া বুঝে নিতে ভালো হয় । এই শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, তাদের সময়ের পড়াশোনার সাথে এখনকার বেশিরভাগ পড়াশোনার মিল নেই। এই কারণে অনেককিছু জানা নেই তাদের। স্কুলের পাশাপাশি কোচিং করালে বাচ্চারা বেশিকিছু শিখতে পারে। এই অভিভাবক আরো বলেন, তার আরো এক সন্তান আছে এইচএসসি পড়ে। তার ৪ টি বিষয়ে কোচিংয়ে পড়তে খরচ হয় ১৫ হাজার টাকার বেশি।
যশোর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান জানায়, প্রথমে মায়ের কাছে পড়াশোনা শুরু করলেও দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে কোচিং এবং বাসায় স্যারের কাছে পড়াশোনা শুরু হয়। সে আরও জানায়, এখনকার পড়াশোনা বিষয়ে বাবা- মা কম জানে। তাই কোচিং ও বাসায় স্যারের কাছে পড়লে বেশি উপকার হয়। এই শিক্ষার্থীর অভিভাবক জানায়, কোচিংয়ে পড়ানোর একটা আলাদা টেকনিক আছে প্রতিটা বইয়ের আলাদা আলাদা সিট, সাপ্তাহিক ও মাসিক পরীক্ষা এসব বিষয় খেয়াল রেখে তারা কোচিংয়ে পড়াশোনা করান।
যশোর জেলা স্কুলের অষ্টম শ্রেণির নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষার্থী জানায়, স্কুলে যে ক্লাস হয়, এতে তাদের বই শেষ হয় না। তাই কোচিংয়ে বই শেষ করতে হয়। বাবা সময় পান না আর মা সব বিষয় পড়াতে পারেন না । সে আরও জানায়, স্কুল থেকে যা পড়ায় সেটা বাসায় শিক্ষকের কাছে পড়লে ভালোভাবে বোঝা যায়। সোহাগ হোসেনের মা জানায়, ছেলেরা তার কথা শোনে না এবং তার কাছে পড়তেও চায় না। এই কারণে মূলত স্কুলের পর কোচিং ও বাসায় আলাদাভাবে শিক্ষক রেখে পড়াতে হয়।
যশোর কালেক্টরেট স্কুলের শিক্ষার্থী মাহাবুব ইসলাম জানায়, বাবা-মা সময় পান না তাই স্কুলের বাইরে বাসায় শিক্ষক রেখে পড়ে। এতে করে তার পড়া বুঝতে সহজ হয় বলে সে জানায়। তবে এই শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, বাসায় কাজ ও নিজের অসুস্থতার কারণে বাসায় শিক্ষক রেখে বাচ্চাকে পড়াতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, সবাই চায় নিজের বাচ্চারা ভালো করুক। তিনি মনে করেন, বাসায় শিক্ষক রেখে পড়ালে সাধারণত সে ভালো করবে। যেহেতু সে স্কুলের বাইরে আরও সুযোগ পাওয়ায় ভালো করবে।
যশোর শিক্ষা বোর্ড মডেল স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থী রোদেলা সুলতানা জানায়, এখন পড়ালেখার সবকিছু আপডেট তাই কোচিংয়ের শিক্ষকেরা যেভাবে শেখায় এটা থেকে তার শিখতে সুবিধা হয়। আর স্কুলে যেহেতু একসাথে অনেক শিক্ষার্থী থাকে এই কারণে সবসময় স্কুল থেকে পড়া বুঝতে পারে না।
শিক্ষার্থীরা জানায়, স্কুলে ঠিকমতো ক্লাস হয় না। বেশিরভাগ স্কুলের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ক্লাসে মনোযোগের পরিবর্তে অতিরিক্ত কোচিংয়ে ব্যাপারে বেশি মনোযোগ দেয়। তাছাড়া বাবা-মা কাজের কারণে তাদের সময় দিতে পারেন না। এই কারণে কোচিং ও বাসায় শিক্ষক রেখে পড়ান। এতে করে তাদের সন্তানেরা অন্যদের থেকে বেশি শেখবে। এছাড়াও তারা মনে করেন স্কুলে যে ক্লাস বা পরীক্ষার সিস্টেম তাতে তাদের সন্তানেরা স্কুল থেকে সবকিছু শিখতে পারে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কোচিং সেন্টারের পরিচালক বলেন, যেহেতু নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে এতে পরীক্ষার সংখ্যা কমেগেছে। এতে করে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা না থাকায় পড়াশোনা কমিয়ে দিয়েছে। এই কারণে অভিভাবকরা তার সন্তানদেরকে পড়াশোনার চাপে রাখার জন্য কোচিংয়ে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, সচেতন অভিভাবকরা জেনে বুঝেই সবকিছু করে।
এ বিষয়ে যশোর জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক শোয়াইব আহমেদ বলেন, এখন যেহেতু প্রতিযোগিতার সময় তাই সবাই চায় তার সন্তান এগিয়ে থাক আরও বেশিকিছু জানুক। এই কারণে ক্লাসের বাইরে সবাই কোচিং ও বাসায় শিক্ষক রেখে তাদের সন্তানদেরকে পড়াচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, আরও একটি কারণ তা হলো এখন অনেকের বাবা-মা সন্তানদের ঠিকমতো সময় দিতে পারেন না, এ কারণেও অভিভাবকরা বাইরের শিক্ষক দ্বারা পড়াশোনা করান।