বিশেষ প্রতিনিধি: সিনেমা যদি দেখতে হয় তবে ‘মুজিব’ দেখা উচিৎ। বার বার দেখা উচিৎ। ঘটনা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্বাধীনতা ও সংগ্রাম, চেতনার উন্মেষ এবং বাস্তবতার অনুভূতি সেই সাথে অভিনয় নৈপূন্য, দৃশ্যায়ন, শিল্পায়ন এবং কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ সর্বশেষ ক্যানভাস সাইজ সব মিলিয়ে এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে সিনেমাটিতে।
শুক্রবার যশোরের মণিহার সিনেমা হলে যারা দর্শক হিসেবে গিয়েছিল তারা সবাই এমন কথা বলেছেন। শুক্রবারের প্রথম প্রদর্শনী থেকেই হলে উপচে পড়া ভিড়। তৃষ্ণার্ত দর্শকদের অনেকেই বহু বছর হলে সিনেমা দেখেননি কিন্তু শুক্রবার প্রথম শোতে এসেই তারা অবাক হয়েছেন এ জন্যে যে এখনো সিনেমা হলে এত লোক আসে।
হল বিমুখ যে দর্শক—শ্রোতা এতদিন দূরে ছিলেন তারা ‘মুজিব’ দেখতে এসে জেনে গেলেন এখনো মানুষ হলে গিয়ে বড় পর্দায় সিনেমা দেখতে চায়। যশোরের অগণিত মানুষ, বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ মণিহার প্রেক্ষাগৃহে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে সিনেমা দেখার জন্যে অপেক্ষা করেছেন। আর সিনেমা শুরু হলে পিনপতন নীরবতায় সে সিনেমাটি গ্রহণ করেছেন।
সিনেমার শেষ দৃশ্যে ‘৭৫ এর ১৫ আগস্ট রাতে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের সদস্যদের যখন এক এক করে হত্যা করা হচ্ছিল এবং সব শেষে শিশু রাসেলের বুকে যখন গুলি চালানো হলো হলের মধ্যে থাকা অজ¯্র দর্শক তখন কেঁপে—কেঁপে উঠলেন, অনেকেই কেঁদে ফেললেন। অনেকের মতে ,‘সব কিছু শেষ হয়ে গেল’..অনেকেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে হল ত্যাগ করলেন।
দর্শকদের মতে, সিনেমার শুরুটা রাজকীয় দৃশ্যায়নের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে রয়েল এয়ার লাইনের একটি বিমানে যখন দেশে ফিরছিলেন, বিমানের মধ্যে বসে জানালা দিয়ে বাংলাদেশের যে অপূর্ব দৃশ্য পর্দায় পরিবেশিত হয়েছে এবং পাইপ টানতে টানতে বাঙ্গালীর চেনা ও প্রাণের বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে উপস্থাপন করা হলো সেটিকে রাজসিকই বললেন দর্শকরা।
তারপর বিমান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখে হাতে এদেশের মাটি নিয়ে যেভাবে চুম্বন করে কপালে ঠেকালেন এটি দর্শকরা কোনো দিনই ভুলতে পারবেন না বলেও জানিয়েছেন তারা। চোখের জল ফেলতে ফেলতে যে দর্শকরা ফিরে যাচ্ছিলেন, তারা অনেকেই জানান, সিনেমাটি আবার দেখতে হবে, বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস ও সংগ্রাম, পাকিস্তানিদের অসহযোগিতা, দেশ চালানোর অদক্ষতা এবং বাঙ্গালীদেরকে মেনে না নেয়ার যে ধৃষ্ঠতা পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার অন্যতম কারণ সব কিছু শিখতে ও জানতে ‘মুজিব’ দেখা দরকার।
জানার জন্যে, বোঝার জন্যে, শেখার জন্যে এবং রাজনীতি করার জন্যে, নেতৃত্বের দৃঢ়তার বাস্তবায়ন শিখতেও ‘মুজিব’ দেখা দরকার। হলের দর্শকদের অনেকেই এ পর্যন্তও বললেন, যারা আওয়ামী লীগ করে তারা যেমন দেখবে যারা অন্য দল করেন তাদেরও ‘মুজিব’ সিনেমাটি একবার হলেও দেখা উচিৎ।
সরেজমিন ঘুরে, সিনেমাটি দেখে এবং দর্শক শ্রোতাদের অনুভূতি থেকে এটি পরিষ্কার যে, বহুদিন পর একটি সিনেমা দেখা হলো যা অনেক দিন মানুষের মনের ভেতর আলাদা জায়গা দখল করে রাখবে। ইতিহাস ভিত্তিক সিনেমাও যে এত ভাল নির্মাণ হতে পারে তা সিনেমাটি না দেখলে বিশ্বাসই করা যেতো না।
এ জাতীয় অনুভূতি শার্শা থেকে আসা পঞ্চাশোর্ধ শ্রমজীবী রহমত আলী, নওয়াপাড়া থেকে আসা সুধীর, শহরের যুবমহিলা লীগ নেত্রী মিতা, বসুন্দিয়ার মেহেদী, নীলগঞ্জের সানজিদা, গৃহবধূ ফিরোজা, শিক্ষার্থী সাজিদ, চৌগাছার যুবক শামীম, সাংবাদিক নেতা মনোতোষ বসু অথবা আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তাক সবারই।
রাজনীতিতে না জড়ানো অনেক দর্শকই জানিয়েছেন, মাওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খন্দকার মোস্তাক, তাজ উদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে কাহিনীর প্রয়োজনে এনে সিনেমাটিকে যেমন গ্রহণযোগ্যতা দেয়া হয়েছে তেমনি, একাত্তরের বিভিন্ন প্রামাণ্য চিত্র থেকে শরণার্থী শিবির পর্যন্ত সে সময়ে ধারণকৃত কিছু দৃশ্য সংযোজন, ভারতের সাকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রা গান্ধীর সাক্ষাতকার দৃশ্যটি সিনেমাটিকে আরও বাস্তবমুখি ও দৃঢ়তা দিয়েছে।
সিনেমার কাহিনী ও পটভ’মি থেকে জানাযায়, বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের যৌথ প্রযোজনায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনীনির্ভর 'মুজিব: একটি জাতির রূপকার' সিনেমাটি শুক্রবার সারা দেশের সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে। ভারতের খ্যাতিমান পরিচালক শ্যাম বেনেগালের পরিচালনায় 'মুজিব’ সিনেমাটিতে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চিত্রনায়ক আরিফিন শুভ, শেখ হাসিনার একটি চরিত্রে চিত্রনায়িকা নুসরাত ফারিয়া ও বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছার বড় বেলার চরিত্রে অভিনয় করছেন নুসরাত ইমরোজ তিশাসহ শতাধিক অভিনয়শিল্পী। সিনেমাটি তিন বছরের চেষ্টা দর্শকদের সামনে হাজির করা হয়েছে। সিনেমাটি একযোগে সারা দেশের ১৫৩ সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে।
২০২১ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে মুম্বাইয়ের দাদা সাহেব ফালকে স্টুডিওতে সিনেমাটির প্রথম ধাপের শুট শুরু হয়। সিনেমাটিতে সহযোগী পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন দয়াল নিহালানি। চিত্রনাট্য লিখেছেন অতুল তিওয়ারি ও শামা জায়েদি। শিল্প নির্দেশনার দায়িত্বে রয়েছেন নীতিশ রায়। কস্টিউম ডিরেক্টর হিসেবে আছেন শ্যাম বেনেগালের মেয়ে পিয়া বেনেগাল।