২রা ডিসেম্বর ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৭ই অগ্রহায়ণ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
সড়ক দুর্ঘটনার করুণ আর্তচিৎকার থামবে কবে?

এস.এম. হাফিজুর রহমান : আমাদের দেশে সড়কে মৃত্যু নতুন কিছু নয়, এটা প্রতিদিনকার ঘটনা প্রবাহের অংশবিশেষ। সড়ক দুর্ঘটনার প্রবণতা এতটাই বেশি যে, এটি এখন ভয়াবহ জাতীয় সমস্যায় রূপ নিয়েছে। এগিয়ে যাওয়া পৃথিবীতে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের ব্যস্ততা এতটাই বেশি যে নিজের গতি প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণ আমরা, নিজেরাই হারিয়ে ফেলেছি।

একটি জীবনের গুরুত্ব কতটা বৃহৎ যা শব্দ লিখে সেই জীবনের ইতিবৃত্ত তুলে আনা যায় না। ব্যস্ততা আমাদেরকে এতবেশি তাড়া করেছে যে, আমরা নিজের গুরুত্বপূর্ণ জীবনকে গুরুত্বহীন করে তুলেছি। সচেতনভাবে নিজের ও অপরের জীবনের গুরুত্ব না বোঝার কারণেই প্রতিদিন—ই কর্ণকুহরে ভেসে আসছে বিষাদে ভরা সড়ক দুর্ঘটনার করুণ আত্মচিৎকার।

বিবেকের কাছে প্রশ্ন তুলছি— সড়কে আর কত প্রাণ ঝরলে আমাদের গভীর ঘুমে নিমজ্জিত বিবেক জেগে উঠবে? আর কত স্বপ্নের করুনণ যবনীকাপাত হলে আমরা সচেতন হবো? সড়কে মৃত্যুর মিছিল কবেই বা থামবে? সড়কে ঝরা প্রাণগুলোর দায় নিবেই বা কে? জানি উত্তর আমাদের বিবেকের কাছে একদমই নেই।

প্রয়োজনের দাগিদে কর্মব্যস্ত জীবনে প্রতিদিন ঘর থেকে বের হতে হয় আমাদের। ঘর থেকে বের হয়ে, আবার ঘরে না ফেরা পর্যন্ত পরিবারের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা বিরাজ করে। প্রতিদিন নানান রূপে সড়কে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। সড়ক রীতিমত মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে বহু আগে থেকে।

অপ্রতিরোধ্য এ সড়ক দুর্ঘটনার রশি এখনই টেনে না ধরতে পারলে, সড়ক দুর্ঘটনা যে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে তা জাতীয় সমস্যায় পতিত হয়ে একটা স্থায়ী যন্ত্রণায় পরিণত হবে।

সমস্যার মূলে হাত দিতে হবে। দেখা যায় বেশিরভাগ দুর্ঘটনা চালকদের বেপরোয়া গতি, মুখোমুখি সংঘর্ষ, গতির অসুস্থ প্রতিযোগিতা, মাদক সেবন করে গাড়ি চালানো, গতিসীমা না মানা, সমস্যাগ্রস্ত বাহন রাস্তায় চলাচল, হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো, সড়কে প্রকৃত শিক্ষা সচেতনতা না থাকা, ঘুম চোখে ড্রাইভিং, সড়কের তুলনায় যানবাহনের সংখ্যা বেশি, অন্ধবাঁকে অসতর্কতা, প্রকৃত ঘটনা আলোর মুখ না দেখা, দোষীদের নজিরবিহীন শাস্তি না হওয়া ও সড়কের প্রকৃত আইনের বাস্তবায়ন না করা।

সড়ক নিরাপদ করতে অত্যন্ত জোরালো ও পরিকল্পিতভাবে সকল নিয়ম—কানুন একটা কাঠামোতে এনে দীর্ঘমেয়াদী ও স্থায়ী শৃংখলা আনা এখন সময়ের দাবি।

সম্প্রতি রোড সেফটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে গত সেপ্টেম্বর মাসে সারাদেশে সড়কে ৩৯৮ টি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। ৩৯৮ টি দুর্ঘটনার মধ্যে সড়কে প্রাণ ঝরেছে ৩৯৪ জনের এবং মর্মান্তিকভাবে আহত হয়েছে ৭৭৩ জন। নিহত সংখ্যার মধ্যে ৪৬ জন নারী ও ৫১ জন শিশু।

প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে মোটরসাইকেল। ১৫১ জন নিহত হয়েছে ১৬৭ টি মটর সাইকেল দুর্ঘটনায়, যার হিসাব দাঁড়ায় মোট নিহতের ৪১ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এ দুর্ঘটনায় পথচারী নিহত হয়েছে ৯৭ জন, রেশিও অনুযায়ী মোট নিহতের ২৪ দশমিক ৬১ শতাংশ।

এখানে দেখা যায় ভারী যানবাহনের চালক ও হেলপার নিহত হয়েছে ৪৯ জন, গড়ে ভারী যানবাহনের হিসাব ১২ দশমিক ৪৩ শতাংশ। আমাদের সামনে বাস্তবভিত্তিক সড়ক দুর্ঘটনার যে ভয়াবহ চিত্র তা রীতিমত আতকে উঠার মত। এ ভয়াবহ চিত্রকে সামনে রেখে যৌক্তিক ও কার্যকর উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে।

ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যস্ততম স্থান চিহ্নিত করে সহজ ও নিরাপদভাবে চলাচলের জন্য ফুটপাত, জেব্রাক্রসিং, ফুটওভারব্রীজ, আন্ডারপাস—ওভারপাস নির্মাণ, বিশেষভাবে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নিশ্চিতসহ ইউটার্নের স্থান নির্ধারণ করা। সচেতনভাবে নতুন সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে মাস্টার প্ল্যানের মাধ্যমে সড়ক তৈরি করা। মানসম্মত সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ নিশ্চিত করা।

সড়ক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরকে দক্ষতা উন্নয়ন, দালালমুক্ত, ওয়ানস্টপ সার্ভিস এবং ফাস্টট্র্যাক সেবা নিশ্চিত করা, চালকদের আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে একাডেমিকভাবে প্রতিটি জেলায় ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ স্কুল নির্মাণ করা। রোড লাগোয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ পারাপারে বিশেষ রোড গার্ড সিস্টেম চালু করা।

প্রযুক্তি নির্ভর ট্রাফিক সিগনাল স্থাপন করা, মহানগরগুলোতে নির্দিষ্ট রুটে নির্ধারিত বাহন চলাচলের ব্যবস্থা করা। চালক ও সহকারীদের কর্ম ঘন্টা নির্ধারণ করা, সড়কে চাঁদা, ঘুষ ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন বন্ধ করা। সড়ক সংশ্লিষ্ট সকলকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা। স্ব—স্ব উদ্যোগে গণমাধ্যমে নিরাপদ সড়ক বিষয়ে প্রচারণার ব্যবস্থা করা। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ্যপুস্তকে নিরাপদ সড়ক বিষয়ে সচেতনতামূলক বিষয়ে অন্তভূর্ক্ত করা। সর্বোপরি প্রত্যেক সড়ককে জনবান্ধব সড়কে রূপান্তরিত করা।

সড়ক আমাদের এবং সড়ক নিরাপদ রাখার দায়িত্বটাও আমাদের। সড়ককে নিরাপদ রাখতে শুধু নিজে বা পরিবারের নয় সকলকে সড়কের আইন মেনে চলতে উৎসাহ প্রদান করতে হবে। এটা এখন আমাদের জন্য ভয়াবহ জাতীয় সমস্যা, এ জাতীয় সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকারের পাশাপাশি সকলকে এগিয়ে এসে সমস্যা সমাধানের জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।

লেখক: চেয়ারম্যান, নিসু ফাউন্ডেশন ও
সদস্য সচিব, নিরাপদ সড়ক চাই
মণিরামপুর উপজেলা শাখা ও কেন্দ্রীয় সদস্য

সম্পাদক ও প্রকাশক : শাহীন চাকলাদার  |  ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আমিনুর রহমান মামুন।
১৩৬, গোহাটা রোড, লোহাপট্টি, যশোর।
ফোন : বার্তা বিভাগ : ০১৭১১-১৮২০২১, ০২৪৭৭৭৬৬৪২৭, ০১৭১২-৬১১৭০৭, বিজ্ঞাপন : ০১৭১১-১৮৬৫৪৩
Email : samajerkatha@gmail.com
পুরাতন খবর
Fri Sat Sun Mon Tue Wed Thu
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031  
স্বত্ব © samajerkatha :- ২০২০-২০২২
crossmenu linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram