১০ই অক্টোবর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৫শে আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শ্রমিক অধিকার হরণে ড. ইউনূসকে সাজা
116 বার পঠিত

সমাজের কথা ডেস্ক : শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার তিন সহযোগীর প্রত্যেককে শ্রম আইনের ৩০৩ (ঙ) ধারা অনুযায়ী ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা এবং ৩০৭ ধারা অনুযায়ী পঁচিশ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন আদালত। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর কর্তৃক শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফুল হাসান, পরিচালক নূর জাহান বেগম ও পরিচালক মো. শাহজাহানের বিরুদ্ধে ২০২১ সালে ৯ সেপ্টেম্বর দায়েরকৃত মামলায় সোমবার (১ জানুয়ারি) এই রায় প্রদান করেছেন তৃতীয় শ্রম আদালতের বিচারক শেখ মেরিনা সুলতানা। একইসঙ্গে আদালত গ্রামীণ টেলিকমে যেসব শ্রম আইন লঙ্ঘন হয়েছে সেগুলোর যথাবিহিত প্রতিবিধানপূর্বক অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটির শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ীকরণ, কল্যাণ ফান্ড গঠন, ছুটি নগদায়ন এবং কোম্পানির লভ্যাংশের ৫ শতাংশ শ্রমিকদের প্রদানপূর্বক আদালতকে অবহিত করার নির্দেশনা প্রদান করেছেন।

তবে রায় ঘোষণার পর আদালত চার আসামির প্রত্যেককে পাঁচ হাজার টাকা বন্ডের বিনিময়ে এক মাসের জামিন প্রদান করায় ড. ইউনূসকে আপাতত জেলে যেতে হচ্ছে না। তথাপি এই রায় শ্রম আইন লঙ্ঘনকারীদের প্রতি একটি কঠোর বার্তা হয়ে থাকবে বলে আশা করা যায়। একইসঙ্গে গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিকরা এতদিন শ্রম আইন অনুযায়ী যেসব ন্যায্য অধিকার হতে বঞ্চিত হচ্ছিলেন সেগুলো পাওয়ার পথও সুগম হয়েছে এই রায়ের মাধ্যমে। শ্রম অধিকার রক্ষায় এই রায়কে একটি মাইলফলক হিসেবে উল্লেখ করলেও অত্যুক্তি হবে না।

এই মামলার শুরু থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আইনজীবী এবং দেশে—বিদেশের তার কতিপয় শুভাকাঙ্ক্ষীরা বারবার বলে এসেছে যে, একজন নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে এবং তার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার জন্যই মামলাটি দায়ের করা হয়েছে। এই বিষয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে বিবৃতি প্রদান করেছেন দেশে—বিদেশের অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গও। দেশে—বিদেশে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে নানা বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদন। তবে আজকের রায়ে আদালত পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছে যে, আদালত কোনো নোবেল বিজয়ীর বিচার করেনি, বরং গ্রামীণ টেলিকমে শ্রম আইন লঙ্ঘনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার করেছেন। আইনের চোখে একজন নোবেল বিজয়ী কিংবা একজন শ্রমিকের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। তাছাড়া নোবেল জয় কোনভাবেই একজনকে তার অপরাধ থেকে দায়মুক্তি দিতে পারে না। কোনো সভ্য সমাজেই এটি কাম্য নয়।

এই পর্যায়ে আসুন জেনে নেয়া যাক, কি ছিল এই মামলা কিংবা কোনো পরিপ্রেক্ষিতে দায়ের করা হয়েছিল এই মামলা। মামলাটির বিস্তারিত জানলে সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব সহজেই দূর হবে। কলকারখানা এবং প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পরিদর্শক এস এম আরিফুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি পরিদর্শন টিম ২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি গ্রামীণ টেলিকম পরিদর্শন করে ওই প্রতিষ্ঠানে শ্রম আইনের কিছু বড় ধরনের লঙ্ঘন দেখতে পান। তারা দেখেন যে, প্রতিষ্ঠানটিতে শ্রমিকদের শিক্ষানবিশ কাল অতিক্রম করার পরেও স্থায়ী না করে তিন বছর অন্তর অন্তর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা হয় যা শ্রম আইনের লঙ্ঘন। আইনানুযায়ী স্থায়ী না করায় শ্রমিকরা বিভিন্নভাবে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন।

এছাড়া ওই প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের শ্রম আইন অনুযায়ী বাৎসরিক ছুটি প্রদান করা হতো না, গঠন করা হয়নি কোনো কল্যাণ তহবিল এবং শ্রমিকদের দেয়া হতো না কোম্পানির লভ্যাংশ থেকে প্রাপ্য ন্যায্য অংশ। পরিদর্শন শেষে এসব ব্যত্যয়ের বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দিয়ে চিঠি প্রদান করা হয় গ্রামীণ টেলিকম কর্তৃপক্ষকে। পরবর্তী সময়ে ২০২১ সালের ১৬ আগস্ট পুনরায় গ্রামীণ টেলিকম পরিদর্শনে যায় পরিদর্শন টিম। তখনো এই প্রতিষ্ঠানে পূর্বোক্ত শ্রম আইনসমূহের লঙ্ঘন পরিলক্ষিত হওয়ায় পুনরায় নোটিস প্রদান করা হয়।

গ্রামীণ টেলিকম থেকে প্রাপ্ত জবাবে সন্তুষ্ট না হয়ে অবশেষে ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তৃতীয় শ্রম আদালতে মামলাটি দায়ের করা হয়। অর্থাৎ এটি পরিষ্কার যে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন গ্রামীণ টেলিকম কর্তৃপক্ষ একাধিকবার সুযোগ পেয়েও ওই প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার প্রদানে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি বরং শ্রম আইন লঙ্ঘন অব্যাহত রাখায় প্রথম পরিদর্শনের প্রায় দেড় বছর পর শ্রমিকদের স্বার্থে ওই মামলাটি দায়ের করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আইনজীবী বিচারকার্য চলাকালীন বারবার গণমাধ্যমে বলে এসেছেন যে, আদালত অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বিচারকার্য পরিচালনা করছে। আসুন জেনে নেয়া যাক এই মামলার ঘটনাক্রম। ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর শ্রম আদালতে মামলা দায়ের হওয়ার পর ওই মামলা বাতিলের দাবিতে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ওই রিট পিটিশন খারিজ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টে আপিল আবেদন করেন। সেটিও খারিজ হওয়ার পর শ্রম আদালতে মামলার কার্যক্রম তথা চার্জ গঠন করা হয়। ওই চার্জ গঠনের বাতিল চেয়ে পুনরায় উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন এবং সেটি খারিজ হওয়ার পর সুপ্রিম কোর্টে আপিল আবেদন করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

সেটিও চূড়ান্তভাবে খারিজ হওয়ার পর ২০২৩ সালের ২২ আগস্ট অর্থাৎ মামলা দায়ের প্রায় দুই বছর পর শ্রম আদালতে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম শুরু হয়। ওই মামলা বাতিলের দাবিতে ড. ইউনূস একাধিবার উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করেছেন। যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় সেগুলো সুরাহা হওয়ার পরেই মামলাটির নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রম চালু হয়। অর্থাৎ যে অবিশ্বাস্য দ্রুততার কথা ড. ইউনূসের আইনজীবী বলছেন, তা নির্জলা মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়।

ওই মামলায় সর্বমোট ২১ কার্যদিবসের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আইনজীবী মামলার বাদীকে সর্বমোট ৭ কার্যদিবস জেরা করেন, যা নজিরবিহীন। এছাড়াও তিনি ৮ কার্যদিবস যুক্তি তর্ক উপস্থাপন করেন। এত দীর্ঘসময় যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের নজির শ্রম আইন সংক্রান্ত কোনো মামলায় কখনো দেখা যায়নি। অর্থাৎ এটি প্রতীয়মান যে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আইনজীবী আদালতে ন্যায্য সুযোগ নয় বরং প্রয়োজনের চেয়ে অধিক সুযোগ পেয়েছেন তাদের বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য। কিন্তু তিনি আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহ খণ্ডনে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছেন, যার ফলশ্রুতিতে এসেছে এই যুগান্তকারী রায়।

এই রায় শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আমরা আশা করব, ড. মুহাম্মদ ইউনূস আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী তার সব প্রতিষ্ঠানসমূহের শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার প্রদান করবেন। আর কোনো শ্রমিককে তাদের ন্যায্য পাওনা পেতে আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে না। একজন নোবেল বিজয়ীর ভাবমূর্তির চাপে পিষ্ট হতে হবে না। সবার প্রতি আহ্বান থাকবে সব ইস্যুতে দ্বিধাবিভক্ত না হয়ে প্রকৃত বিষয় জেনে মতামত প্রদান করুন। অবাধ তথ্য প্রবাহের এই সুযোগে সত্য অন্বেষণ করা কঠিন কিছু নয়। সত্যের অনুসন্ধান করুন, কেননা, সত্যই সুন্দর। সৌজন্যে : ভোরের কাগজ

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, ফ্রিল্যান্সার।

সম্পাদক ও প্রকাশক : শাহীন চাকলাদার  |  ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আমিনুর রহমান মামুন।
১৩৬, গোহাটা রোড, লোহাপট্টি, যশোর।
ফোন : বার্তা বিভাগ : ০১৭১১-১৮২০২১, ০২৪৭৭৭৬৬৪২৭, ০১৭১২-৬১১৭০৭, বিজ্ঞাপন : ০১৭১১-১৮৬৫৪৩
Email[email protected]
পুরাতন খবর
FriSatSunMonTueWedThu
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031
স্বত্ব © samajerkatha :- ২০২০-২০২২
crossmenu linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram