নিজস্ব প্রতিবেদক : সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে চিরবিদায় নিলেন যশোরের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যশোরের সভাপতি সুকুমার দাস। বৃহস্পতিবার যশোরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রাণকেন্দ্র টাউন হল মাঠ থেকেই সর্বস্তরের মানুষ তাকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানান। এরপর নীলগঞ্জ মহাশ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
শেষ শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজনে ছিলেন স্থানীয় সরকার ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য এমপি, আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। ছিলেন যশোর শহর ও বিভিন্ন উপজেলার সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের নেতাকর্মীসহ জেলা ও পুলিশ প্রশাসন, সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠন।
এসময় স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দ বলেন, সাংস্কৃতিক সংগ্রামী সুকুমার দাস জীবনের সিংহভাগ সংগ্রাম করেছেন সংস্কৃতি, অসাম্প্রদায়িকতা ও মুক্তচিন্তার পক্ষে। তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ ও পরিপূর্ণ একজন মানুষ।
পুনশ্চ যশোরের প্রতিষ্ঠাতা সুকুমার দাস বুধবার রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হন। এরপর তাকে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে আইসিইউতে থাকা অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বৃহস্পতিবার সকালে সুকুমার দাসের মরদেহ প্রথমে নেয়া হয় তার প্রতিষ্ঠিত পুনশ্চ যশোর প্রাঙ্গণে। এরপর সকাল ১০টায় মরদেহ টাউন হল ময়দানে রওশন আলী মঞ্চে রাখা হয়। শোকাবহ পরিবেশে সেখানে প্রথিতযশা এ সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এসময় শোকাহত হয়ে ওঠেন তার সতীর্থ, সহকর্মী ও বন্ধুরা। কাঁদতে দেখা যায় অনেককে। শতাধিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান তাদের প্রিয় ব্যক্তিত্বকে অন্তিম শ্রদ্ধা জানান।
শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন স্থানীয় সরকার ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য, যশোরের জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খান, পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ারদার, যশোর শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আহসান হাবীব, যশোর জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষে জেলা সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম মিলন, খুলনা বিভাগীয় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক নার্গিস বেগম, যশোর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল, যশোর সদর উপজেলার চেয়ারম্যান মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী, সভাপতি মোহিত কুমার নাথের নেতৃত্বে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ, সভাপতি আসাদুজ্জামান আসাদ ও সাধারণ সম্পাদক এসএম মাহমুদ হাসান বিপু’র নেতৃত্বে পৌর আওয়ামী লীগ, যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মর্জিনা আক্তার, জেলা জাসদ, বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি, বাসদ মার্কসবাদী, বৃহত্তর যশোর ছাত্র ইউনিয়ন, জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগ, শ্রমিকলীগ, যশোর শিল্পকলা একাডেমি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, প্রেসক্লাব যশোর, যশোর সাংবাদিক ইউনিয়ন, দৈনিক লোকসমাজ, দৈনিক গ্রামের কাগজ, দৈনিক স্পন্দন, দৈনিক রানার, ফটো জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন, যশোর ইনস্টিটিউট, উদীচী যশোর, সুরবিতান যশোর, কিংশুক যশোর, বিবর্তন যশোর, যশোর সাহিত্য পরিষদ, তির্যক যশোর, স্পন্দন যশোর, চারুতীর্থ, নৃত্যবিতান, নন্দন যশোর, বাউলিয়া সংঘ, প্রথম আলো বন্ধু সভা, সনাক-টিআইবি যশোর, জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থা, বাঘারপাড়া কলেজ, জয়তী সোসাইটি, নান্নু চৌধুরী ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট, শেকড় যশোর, দ্যোতনা সাহিত্য পরিষদ, উপশহর কলেজ, শিশু একাডেমি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ঝিকরগাছা, প্রত্যয় থিয়েটার, মা নৃত্যালয়, ব্যঞ্জন যশোর, থিয়েটার ক্যানভাস, জনউদ্যোগ, আব্দুর রাজ্জাক কলেজ, সম্মিলন স্কুল প্রাক্তন ছাত্র পরিষদ, নাসিব, হোটেল শ্রমিক ইউনিয়ন, চারুপল্লী শিক্ষালয়, আরআরএফ, সিটি ক্যাবল, মহিলা পরিষদ, উৎকর্ষ যশোর, সদর উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদ, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যশোর, পুলিশ লাইন স্কুল, সপ্তর্ষী অভয়নগর, বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি, যশোর শাড়ি কাপড় ব্যবসায়ী সমিতি যশোর বাজার শাখা, যশোর জিলা স্কুলসহ আরো বেশ কয়েকটি সংগঠন।
টাউন হল ময়দানে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সুকুমার দাসের মরদেহ যশোর নীলগঞ্জ মহাশ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে শোকাবহ পরিবেশে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
এরআগে সুকুমার দাস গত ৫ এপ্রিল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন। চিকিৎসকরা তাকে খুলনায় স্থানান্তর করেন। খুলনা সিটি হাসপাতালে তার হার্টে একটা রিং স্থাপন করা হয়। ৯ এপ্রিল যশোরে ফিরে আসেন তিনি। ওইদিনই আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে সন্ধ্যায় যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এরপর সুস্থ হওয়ায় ১১ এপ্রিল দুপুরে তাকে বাড়িতে নেওয়া হয়। ১২ এপ্রিল রাত ৯টার দিকে বাড়িতে খাট থেকে পড়ে তিনি গুরুতর অসুস্থ হন। দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সুকুমার দাস ১৯৭৩ সালে যশোর উদীচীর সাথে যুক্ত হন এবং ২০১১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত একাধিকবার এ সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১১ সালের শেষ দিকে তিনি গড়ে তোলেন আরেক সাংস্কৃতিক সংগঠন পুনশ্চ। সাংস্কৃতিককর্মী হিসেবে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। যশোরে জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, পদ্ধতিগত সঙ্গীত শিক্ষার বেসরকারি সঙ্গীত শিক্ষাবোর্ড ধ্রুব পরিষদ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যশোরে দীর্ঘ ২৮ বছর তিনি মূল দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে কেন্দ্রীয় জোটের সদস্যসহ যশোরের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। এছাড়া বর্তমানে টিআইবি যশোর সনাকের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। একইসাথে যশোর শিল্পকলা একাডেমির সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি।
তার সুর করা গান ‘আয় আয় দিন বদলের প্রত্যয়’ গানটি যশোর জেলা প্রশাসনের ওয়েলকাম টিউন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তারই সুর করা আরেকটি গান ‘আরশীর সামনে একা একা দাঁড়িয়ে’ আজ উদীচীর সংগঠন সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তার সুর করা মাইকেল মধুসূদন দত্তের রচিত ব্রজাঙ্গনা কাব্য সনেট ও নাটকের অসংখ্য গান বাংলাদেশ বেতারসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একাধিকবার পরিবেশিত হয়েছে ও হচ্ছে । তিনি অসংখ্য দেশের গান, গণসঙ্গীত, ছড়া গান ও আধুনিক গানের সুর করেছেন। গণসঙ্গীতের প্রশিক্ষক হিসেবে তিনি ঢাকা, খুলনা, রাজশাহীসহ সারাদেশে কাজ করেছেন।
পেশায় কলেজ শিক্ষক সুকুমার দাস ১৯৮৪ সালে যশোরের বাঘারপাড়া ডিগ্রি কলেজে অর্থনীতি বিভাগে যোগ দেন। ২০১৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর তিনি শিক্ষকতা থেকে অবসর নেন।
সুকুমার দাসের মৃত্যুতে শোক
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যশোর জেলার সভাপতি অধ্যাপক সুকুমার দাসের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন।
এক শোক বার্তায় অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, অধ্যাপক সুকুমার দাস সকলের শ্রদ্ধেয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। যবিপ্রবির উপাচার্য হিসেবে তাঁর সঙ্গে আমি কয়েকটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি।
যশোরের মানুষের কাছে তিনি অত্যন্ত সজ্জন মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলে পরিচিত যশোরকে নিজের স্বীয় গুণাবলী দিয়ে আরও সমৃদ্ধ করেছেন, সেবা দিয়ে গেছেন। তাঁর মৃত্যুতে যশোরবাসী একজন অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তমনা মানুষকে হারালো। আমি তাঁর মৃত্যুতে যবিপ্রবির শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করছি এবং তাঁর বিদেহী আত্মার সদ্গতি কামনা করছি। একইসঙ্গে তাঁর পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক সহকর্মীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।
পৃথক বিবৃতিতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার এমপি, জেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক জিয়াউল হাসান হ্যাপী, জেলা নেতা রেজাউল ইসলাম, যশোর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোহিত কুমার নাথ, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান আসাদ, সাধারণ সম্পাদক এসএম মাহমুদ হাসান বিপু, যুবলীগ নেতা শফিকুল ইসলাম জুয়েল, স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা নিয়ামত উল্লাহ, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রওশন ইকবাল শাহী।
এছাড়াও শোক প্রকাশ করেছেন উদীচী যশোরের সভাপতি তন্দ্রা ভট্টাচার্য্য, সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদুর রহমান খান বিপ্লব, মহিলা পরিষদ যশোর, বিবর্তন যশোরসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন।