সমাজের কথা ডেস্ক : ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়েছে দেশের দক্ষিণ উপকূলীয় ছয় জেলা। সব মিলিয়ে মোট ১৯ জেলার ৩৭ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রাণহানি হয়েছে অন্তত ১৪ জনের। এর মধ্যে ভোলায় তিনজন, পটুয়াখালীতে তিনজন, বরিশালে দুজন, চট্টগ্রামে দুজন এবং সাতক্ষীরা, খুলনা, লক্ষ্মীপুর ও কুমিল্লায় একজন করে প্রাণ হারিয়েছেন।
সোমবার (২৭ মে) বিকেলে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ১ লাখ ৫০ হাজার ৪৭৫ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এর মধ্যে ৩৬ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। নিচু এলাকাগুলোতে পানি জমে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র জলাবদ্ধতা।
ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল, খুলনা ও চট্টগ্রাম বিভাগে অন্তত ১৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। নিহতের মধ্যে অধিকাংশেরই গাছ ও ঘর ধসে মৃত্যু হয়েছে। তবে সরকারি হিসাবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে ১০ জনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছে।
ভোলা: ভোলা জেলায় নারী-শিশুসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার ভোররাতের দিকে লালমোহন, দৌলতখান ও বোরহান উদ্দিন উপজেলায় ঘরচাপায় তাদের মৃত্যু হয়। নিহতরা হলেন মনেজা খাতুন (৫৪), মাইসা (৪) ও জাহাঙ্গীর (৫০)।
জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বে থাকা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘রবিবার রাতে লালমোহন উপজেলার চরউমেদ ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডে তীব্র বাতাসে ঘরচাপায় মনেজা খাতুন মারা যান। এ ছাড়া একই সময় দৌলতখান পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডে ঘরের ওপর গাছচাপায় মাইশা নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়। বোরহান উদ্দিন উপজেলার সাচরা ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাথানবাড়ী গ্রামের জাহাঙ্গীরের মৃত্যু হয় ঘরের ওপর গাছ চাপা পড়ে। নিহত প্রত্যেক পরিবারকে সরকারিভাবে ২৫ হাজার টাকা করে প্রদান করা হবে।’
পটুয়াখালী: ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে পটুয়াখালীতে দুজন নিহত হয়েছেন। সোমবার সকাল ৮টার দিকে জেলার দুমকী উপজেলার পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড নলদোয়ানি স্লুইস গেট এলাকায় গাছচাপায় জয়নাল হাওলাদার (৭০) নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিকে জেলার বাউফলে পরিত্যক্ত টিনশেড দোতলা ঘরের চাপা পড়ে করিম (৬৫) নামের এক ভিক্ষুক মারা গেছেন। তার বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফলের নাজিরপুর ইউনিয়নের ধানদি গ্রামে। এ ছাড়া রবিবার (২৬ মে) বিকেলে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে প্লাবিত এলাকা থেকে বোনকে রক্ষা করতে গিয়ে মো. শহীদুল ইসলাম (২৭) নামে একজনের মৃত্যু হয়।
বরিশাল: বরিশাল নগরীর রূপাতলী এলাকায় সোমবার ভোর ৪টার দিকে একটি ভবনের ছাদের ওপরের নির্মাণাধীন দেয়াল পাশের খাবারের হোটেলের ওপর ধসে পড়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা হলেন হোটেলের মালিক লোকমান হোসেন (৫৮) ও কর্মী মোকসেদুর রহমান (২৮)।
চট্টগ্রাম: সোমবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে নগরীর বায়েজিদের চন্দ্রনগর কলাবাগান এলাকায় নির্মাণাধীন ভবনের দেয়ালধসে সাইফুল ইসলাম হৃদয় (২৬) নামে এক যুবক প্রাণ হারিয়েছেন। তিনি নির্মাণাধীন ভবনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ধসে পড়া দেয়ালের নিচে চাপা পড়েন। এ ছাড়া সোমবার নগরের খাতুনগঞ্জ থেকে অজ্ঞাত এক পুরুষের (২২) লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে তার নাম-ঠিকানা এখনো পাওয়া যায়নি। খাতুনগঞ্জ এলাকায় খালে ভাসছিল ওই ব্যক্তির লাশ। স্থানীয়রা দেখতে পেয়ে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। নগরীর কোতোয়ালি থানার ওসি এস এম ওবাইদুল হক জানান, পুলিশ তার পরিচয় উদ্ধারে কাজ করছে।
সাতক্ষীরা: রবিবার রাত ৮টার দিকে সাতক্ষীরার নাপিতখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সময় হোঁচট খেয়ে পড়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শওকত আলী মোড়ল (৬৫) নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। তিনি সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের নাপিতখালী এলাকার মৃত নঈম আলী মোড়লের ছেলে।
খুলনা: খুলনার বটিয়াঘাটায় ঘূর্ণিঝড়ে গাছচাপা পড়ে লালচাঁদ মোড়ল (৩৬) নামে এক যুবক মারা গেছেন। সোমবার সকালে সুরখালী ইউনিয়নের গাওঘরা গরিয়ারডাঙ্গা গ্রামে স্থানীয় লোকজন গাছ কেটে ঘরের ভেতর থেকে মৃত অবস্থায় লালচাঁদকে উদ্ধার করে। তিনি গ্রামের গহর মোড়লের ছেলে।
কুমিল্লা: কুমিল্লা নগরীতে নির্মাণাধীন একটি ভবনের দেয়ালধসে সাইফুল ইসলাম সাগর (১২) নামে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। সোমবার বেলা ১১টার দিকে নগরীর শাকতলা এলাকায় নূর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে এ ঘটনা ঘটে। নিহত স্কুলছাত্র সাইফুল ইসলাম সাগর ওই প্রতিষ্ঠানের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ছিল। সে শাকতলা এলাকার অলী আহমেদের ছেলে।
লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ চাঙ্গিরগাঁও গ্রামে বসতঘর চাপাপড়ে নিস্পা (৭) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। একই ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে রামগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন শিশুটির নানি হোসনে আরা বেগম (৬৫)।
জলোচ্ছ্বাস ও দমকা হাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত দেড় লাখ ঘরবাড়ি
ঝড়ের তাণ্ডবে বহু ঘরবাড়ি ও দোকানপাট তছনছ হয়ে গেছে। উপকূলীয় বহু এলাকা তলিয়ে গেছে সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসে। বিভিন্ন জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে গবাদিপশু, মাছের ঘের ও ফসলি খেত। বিভিন্ন এলাকায় সড়কে গাছ পড়ে যোগাযোগ বন্ধ হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক তথ্যানুসারে, ১৯ জেলায় ৩৭ লাখ ৫৮ হাজার ৯৬ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং ১ লাখ ৫০ হাজার ৪৭৫ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে, যার মধ্যে ৩৫ হাজার ৪৬৩ ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলার সংখ্যা ১০৭ এবং ইউনিয়নের ও পৌরসভার সংখ্যা ৯১৪।
খুলনার বিভাগীয় কমিশনার হেলাল মাহমুদ বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানান, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে খুলনা বিভাগে অন্তত ১ লাখ ২৩ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া পটুয়াখালীর কলাপাড়া ও রাঙ্গাবালীর দুটি বেড়িবাঁধ এবং বাগেরহাটের তিনটি স্থানের বাঁধ ভেঙে লোকালয় প্লাবিত হয়েছে। বাগেরহাটের ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. খালিদ হোসেন।
চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার জানিয়েছেন, প্রবল বাতাস ও ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকার কারণে রবিবার থেকে অন্তত ৪০ হাজার মানুষ বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। এ ছাড়া রিমালের প্রভাবে ভোলা জেলার নদীগুলো স্বাভাবিকের তুলনায় ৬-৭ ফুট উচ্চতায় বয়ে যাচ্ছে। চরফ্যাশন উপজেলার চরপাতিলা ও ঢালচর ইউনিয়নের সবগুলো গ্রাম জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। প্রশাসনের সহায়তায় তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া মনপুরা উপজেলার বেড়িবাঁধ ভেঙে চার ইউনিয়নের বেশ কিছু গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
অন্যদিকে দেশের প্রধান নদীবন্দর চাঁদপুরে প্রবল বাতাস ও বৃষ্টিপাতের কারণে চাঁদপুর-ঢাকাসহ সব নৌরুটে নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। চাঁদপুর বন্দর ও পরিবহন কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাহিদ হোসেন জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে শনিবার দিনগত রাত ১২টার পর চাঁদপুর থেকে লঞ্চসহ সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। বৃষ্টির কারণে বন্ধ রয়েছে জেলার বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।