নিজস্ব প্রতিবেদক : ২৫ টাকা কেজি চাল, ৪০ টাকা কেজিতে ডাল, ৪৫ টাকায় চিনি, ১২০ টাকায় সয়াবিন তেল! শুধু চাল, ডাল, তেল, চিনিই নয়; এমন দামে ৯টি পণ্যের বাজার বসিয়েছে যশোরের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আইডিয়া। গত বছরের মতো এবারও রমজানে মাসজুড়ে লস্ করার প্রকল্প হাতে নিয়েছে তারা। ১২৮৭ টাকা বাজারমূল্যের পণ্য তারা বিক্রি করছে ৫৫০ টাকা দরে। ৫৩৭টি নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মাঝে মাস জুড়ে এভাবেই লসে পণ্য বিক্রি করবে সংগঠনটি।
বৃহস্পতিবার দুপুরে যশোর শহরের খড়কিতে আইডিয়া সমাজকল্যাণ সংস্থার চত্বরে গিয়ে দেখা গেছে, রমজান মাসব্যাপী ব্যবসায় লস করার উদ্দেশ্য নিয়ে ৯টি পণ্যের বাজার বসিয়েছে তরুণ স্বেচ্ছাসেবীরা। ‘আইডিয়া-সানাবিল লস প্রজেক্টে’ বাজারদরে পণ্য ক্রয় করে অর্ধেক বা তারও কম মূল্যে ৫৩৭টি মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের নিকট বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাসেবীরা।
‘মানবকল্যাণে আমরা ঠকতে চাই’ কিংবা ‘ইহলৌকিক লস সমান পারলৌকিক লাভ’ এমন শ্লোগানে বৃহস্পতিবার প্রথমদিনের বাজার বসে। এই বাজারে অর্ধেক দামে ৯ টি পণ্য বিক্রি করছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। একজন ক্রেতা- পরিবার প্রতি ৫৪ টাকা কেজি দরের চাল ২৫ টাকায় ৫ কেজি, ২৫ টাকা কেজি দরের আলু ১০ টাকা করে ২ কেজি ও বাকী ৭ টি পণ্য ১ কেজি করে- ১৪০ টাকা দরের ডাল ৪০ টাকায়, ১২০ টাকা দরের চিনি ৪৫ টাকায়, ১৯০ টাকা লিটারের তেল ১২০ টাকায়, ৪৫ টাকা দরের পেঁয়াজ ২০ টাকায়, ৯৫ টাকা দরের ছোলা ৬০ টাকায়, ৬০ টাকা দরের চিড়া ২০ টাকায়, ৩২০ টাকা দরের খেজুর ১০০ টাকায় ক্রয় করছেন।
প্রতি পরিবার সপ্তাহে একবার করে রমজানে মোট চারবার এই বাজার করার সুযোগ পাবে। বাজারদর পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সমমানের এই ৯টি পণ্য একজনের ক্রয় করতে প্রয়োজন ১২৮৭ টাকা, যা তারা ৫৫০ টাকায় দিচ্ছে আইডিয়া লস প্রজেক্টের বাজারে।
যশোরের আইডিয়া সমাজকল্যাণ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সহকারী অধ্যাপক হামিদুল হক শাহীন বলেন, ‘মধ্যবিত্ত দান চায় না, ত্রাণ চায় না, চায় পরিত্রাণ। আমাদের সাধ্যের মধ্যে আমরা সেই চেষ্টাই করছি। আমরা কিছু মানুষ যোগ হলেই সম্ভব বহু মানুষের পরিত্রাণের ব্যবস্থা। আমার শিক্ষার্থীদের শেখাতে চাচ্ছি সকল লস আসলে লস নয়, মানব সেবায় লস বরং লাভের চেয়েও বেশিকিছু। গতবছর লস প্রজেক্ট এর মাধ্যমে সেই তৃপ্তির স্বাদ আমার শিক্ষার্থীরা পেয়েছে। এ বছর-ও তাই এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।’
হামিদুল হক শাহীন আরও বলেন, পৃথিবীর প্রায় সব মুসলিম দেশেই রমজান মাস আসলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমে। বাংলাদেশে বাড়ে। রমজানে সংযম ও আত্মশুদ্ধির সকল শিক্ষাকে ভুলে গিয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ও মজুতদারির মাধ্যমে সীমাহীন ‘লাভের লোভ’ ই এর জন্যে দায়ী। এ সংকটের নির্মম শিকার সমাজের মধ্যবিত্ত ও নি¤œ মধ্যবিত্তরা। নিম্নবিত্তের মানুষেরা সরকারি/বেসরকারি বিভিন্ন ‘ত্রাণ’ সুবিধার জন্যে মানুষের কাছে হাত পাততে পারলেও চক্ষু লজ্জার খাতিরে ‘মধ্যবিত্ত’ তাদের কান্না লুকিয়েই রাখে। ‘আইডিয়া লস প্রোজেক্ট’ পরোক্ষভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর দাম সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণির সহনশীলতার মধ্যে নিয়ে আসার একটি প্রকল্প।
তিনি আরও বলেন, ‘এটি আমাদের অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি প্রচেষ্টা যেন সমাজের সকলের সামনে এই এলাকা মডেল হয়। আমাদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় যদি ৫৩৭ পরিবার স্বস্তি পায়, তাহলে আরো নানান এলাকায় সংঘবদ্ধভাবে এই চেষ্টা আরো মানুষকে মুক্তি দিতে পারবে। রমজানে বহু অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে মধ্যবিত্তের যে দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়, তার জবাব স্বরূপই তরুণ স্বেচ্ছাসেবী দের এই আয়োজন।’
বাজারে পণ্য কিনতে আসা খড়কি দক্ষিণ পাড়ার হালিমা বেগম জানালেন তিনি ফেরি করে জীবন চালান। রমজানে জিনিসপত্রের দাম নিয়ে চিন্তায় ছিলেন। এখানে এতো কম টাকায় এতো জিনিসপত্র পাওয়া যাচ্ছে; এতে শান্তিতে রোজা রাখতে পারবেন।
রিকসা চালক নজরুল ইসলাম জানালেন, ‘রমজান মাসে এযেন আল্লার রহমত! বাজারের অর্ধেক দামে চাল, ডাল, তেল কিনে নিয়ে যাচ্ছি। রোজার কষ্ট বেশ খানিকটা আছান হবে।’
খড়কি হাজামপাড়া এলাকার বৃদ্ধা মঞ্জুরি বেগম, রেলগেট এলাকার ফাতেমা বেগমও ৯টি পণ্য ক্রয় করে ৫৫০ টাকা দিয়ে কিনে ভীষণ খুশি। তারা বললেন, ‘যারা এই বাজার বসাইচে আল্লা তাগের ভাল করুক। আর রোজার মাসে যারা বেশি লোভ করে আল্লা তাগের হেদায়েত দিক। সারাদেশে এইরাম ছড়ায়ে গেলি আমাগের মতোন গরিব মানষির কষ্ট কোমবে।’
আইডিয়া লস প্রজেক্টের সমন্বয়ক হারুন অর রশিদ জানান, আইডিয়ার স্বেচ্ছাসেবীরা মাসব্যাপী জরিপ করে মধ্যবিত্ত ৫৩৭টি পরিবারকে এই প্রজেক্ট এর আওতায় নিয়ে আসে এবং তাদের মধ্যে কার্ড বিলি করে। এখন তারা মাসব্যাপী এই বাজার করতে পারবে। সত্যিই এই অনুভূতি অভূতপূর্ব।
তিনি আরও জানান, লস প্রজেক্টে বাজার করতে আসা পরিবারগুলোকে ব্যতিক্রমী অভ্যর্থনাও জানানো হয়। প্রবেশপথেই স্বেচ্ছাসেবকরা গোলাপফুল দিয়ে স্বাগত জানিয়ে বসার ব্যবস্থা করেন। এরপর তাদের শরবত ও খেজুর পরিবেশন করা হয়। ধারাবাহিকভাবে বাজারের রশিদ কেটে টাকা নিয়ে পণ্য বুঝিয়ে দেয়া হয়। এখানে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে যে, প্রত্যেক ক্রেতা যেন সম্মানের সাথে তাদের পণ্য ক্রয় করতে পারেন।