এস হাসমী সাজু : নাম বক্ষব্যাধি হাসপাতাল। যক্ষা ছাড়া অন্য বক্ষ রোগের চিকিৎসা হয় না এখানে। ৬০ বছরের পুরাতন এ হাসপাতালে গত তিন মাসে চিকিৎসা নিয়েছেন মাত্র ৩২ রোগী। রোগী কম হওয়ায় এদিকে কেউ তেমন নজর দেন না। এজন্য হাসপাতাল এলাকায়র অবাধে ঘোরে গরু-ছাগল। দিনে-রাতে রাজত্ব করে নেশাখোররা।
যশোর শহরের বকচর এলাকায় তিন একর জমির উপরে ১৯৬১ সালে স্থাপিত হয় যক্ষা হাসপাতাল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ১৯৯৭ সালে যক্ষা হাসপাতালের নাম পরিবর্তন করে করা হয় ‘যশোর বক্ষব্যাধি হাসপাতাল’। কিন্তু এখানে যক্ষা ছাড়া বক্ষের অন্য কোন রোগের চিকিৎসা করা হয় না।
অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালে যক্ষা বাদে শ্বাসকষ্টের, ক্রনিক ব্রংকাইটিস এজমার রোগী আসলে কর্মচারী-কর্মকর্তারা জেলা সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। এই হাসপাতালটিতে যক্ষা রোগী থাকলেও রোগ নির্ণয়ের কোন যন্ত্রপাতি ও মেশিনারিজ নেই। ফলে রোগীদের চিকিৎসা পরবর্তি অগ্রগতি দেখার জন্য শহরে এসে বেসরকারি সংস্থা ব্রাকে বা ক্লিনিক থেকে শরীরের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়।
১৬ মার্চ কথা হয় হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার সরিফা খাতুনের সাথে। তিনি বলেন, ‘হাসপাতাল থেকে এক কিলোমিটার দুরে শহরের বেজপাড়ায় টিভি ক্লিনিক আছে। রোগীরা সেখানে প্রথমে চিকিৎসককে দেখান। পরে ব্রাকের সহযোগিতায় যক্ষা রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। ধরা পড়লে প্রথমে বাড়িতে চিকিৎসা ও পরে দ্বিতীয় ধাপে রোগীরা এই হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়। ভর্তির পরে রোগীকে যক্ষার নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হয়। কিন্তু চিকিৎসা পরবর্তী অগ্রগতি জানা সম্ভব হয় না। ফলে রোগীদের কফ, রক্ত, এমটি ও এক্স-রে করতে শহরের ক্লিনিকে বা ব্রাক সেন্টারে পাঠানো হয়। তিনি আরও জানান, চিকিৎসাধীন অবস্থায় কোন রোগী খারাপ হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্যত্র রোগীকে স্থানন্তর করার (অ্যাম্বুলেন্স) বহনের ব্যবস্থা নেই।’
২০ শয্যার হাসপাতালে ১৫ মার্চ ভর্তি ছিলেন ৭ জন। এদের একজন যশোর সদর উপজেলার ঝুমঝুমপুর এলাকার মুরাদ হোসেনের স্ত্রী হাজেরা বেগম। তিনি জানান, ‘হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরে ওষুধ নিয়মিত পান। সকালে চিকিৎসক একবার রাউন্ড দিয়ে চলে যান। পরে এখানে সেবিকারা দেখা শুনা করেন। খাবার নিজেরই তৈরি করে খান। হাসপাতাল থেকে সকালে একটু চিড়া ও কলা দেওয়া হয়। একই কথা বলেন, রূপদিয়া এলাকার সিরাজুল ইসলামের ছেলে মাসুদুর রহমান, কেশবপুর এলাকার আছিয়া বেগম।
হাসপাতালের সেবিকা সাবু বেগম জানান, হাসপাতালে আগে নিরাপত্তা ছিলো না। বাউন্ডারি ওয়াল হওয়ার পরে এবং সন্ধ্যার সময় পুলিশ প্রশাসন থেকে হাসপাতাল চত্বরে পরিদর্শন করে মাদক সেবিদের তাড়িয়ে দেন। ফলে গত ৪/৫ মাস থেকে রাতে মাদক সেবিরা হাসপাতালে নেশা করে না। তবে সকালে ও দুপুরে তারা হাসপাতালের পেছনে অবস্থান করে।
হাসপাতালের কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান বিল্লাল জানান, হাসপাতালের জন্য দু’জন চিকিৎসক, পাঁচজন সেবিকা, তিনজন ওয়ার্ড বয়ের মধ্যে আছে দু’জন, বাবুর্চি দুজনের মধ্যে আছেন একজন। এ ছাড়াও নেই আয়া, নিরাপত্তা প্রহরি, দারোয়ান। হাসপাতালে ফার্মাসিষ্ট অবসরে যাওয়ার পরে তিন বছর থেকে সেই পদ শূন্য রয়েছে। ফলে জোড়া তালি দিয়ে চলছে হাসপাতালটি। তিনি আরও জানান, যক্ষাসহ ৪/৫ প্রকারের ওষুধ ছাড়া অন্য কোন ওষুধ নেই। কর্তৃপক্ষ যদি এ প্রতিষ্ঠানের যথাযথ ব্যবস্থা নিলে হাসপাতালের সেবার মান বাড়ানো সম্ভব বলে তিনি জানান।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, হাসপাতালটি ২০ শয্যার হলেও দীর্ঘ মেয়াদী চিকিৎসায় রোগী ভর্তি রয়েছে ১০জন। করোনা পরবর্তী ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে প্রতিষ্ঠান থেকে চিকিৎসা নিয়েছে ৩২ জন যক্ষার রোগী।
এদিকে স্থানিয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম জানান, হাসপাতালে বেশি রোগী আসে না। যা আসে তার সংখ্যাও অনেক কম। তিনি আরও জানান প্রতিদিন গড়ে এখানে ১০ জন রোগী থাকে। ফলে হাসপাতালের কর্মরত কর্মকর্তা- কর্মচারীদের তেমন কোন কাজ করতে হয় না। এই সুযোগে অনেক হাসপাতালে এসে চলে যান। রাতে ও বিকেলে একজন সেবিকা ও রোগী ছাড়া কাউকে দেখা যায় না।
এ ব্যাপারে হাসপাতালের প্রধান যশোরের সিভিল সার্জন ডাক্তার বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস জানান, এনজিওর মাধ্যমে যক্ষা রোগ নিরাময়ের সরকারি কর্মসূচি মানুষের বাড়িতে পৌঁছে গেছে, এ কারণে হাসপাতালে তেমন রোগী হয় না। এ বাদেও বক্ষ রোগের অন্যান্য চিকিৎসা জেলা সদর হাসপাতালে থাকায় রোগী সেখানে বা টিবি ক্লিনিক থেকে প্রাথমিক সেবা পায়। তবে হাসপাতালে বিদ্যমান সমস্যার কথা স্বীকার করে তিনি জানান, যতদ্রুত সম্ভব এসব সমস্যা সমাধান করে হাসপাতালে যক্ষ্মা ও বক্ষব্যাধি রোগীদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে