লাবুয়াল হক রিপন : ঝিনাইদহের ব্যবসায়ী মফিজুর রহমানের মা চিকিৎসাধীন ছিলেন যশোর পঙ্গু হাসপাতালে। সেখান থেকে নিখোঁজ হন তিনি। দুই দিন পর হাসপাতালের লিফটের নিচ থেকে তার গলিত লাশ উদ্ধার হয়। ২০২২ সালের ২ এপ্রিলের এ ঘটনার পর ১৪ মাস। এরই মধ্যে থানা পুলিশ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে এটা স্রেফ দুর্ঘটনা। পরে বাদির নারাজিতে মামলাটির পুনঃতদন্ত করছে পিবিআই।
এ তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে বদি পক্ষের রয়েছে অসন্তোষ। তাদের জিজ্ঞাসা- দুর্ঘটনায় মরলে লিফটের ভেতরে মরবে, নিচে কেন? সুরতহাল রিপোর্টে শরীরে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন কেন? দুর্ঘটনা কবলিত যানবহনের বিরুদ্ধে যদি মামলার বিধান থাকে লিফট মালিক নির্দোষ হয় কী ভাবে?
২০২২ সালের ২৭ মার্চ ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার আড়পাড়া গ্রামের ব্যবসায়ী মফিজুর রহমান যশোর পঙ্গু হাসপাতালে আসেন ৯০ বছর বয়সী মা আছিয়া বেগমের পায়ের চিকিৎসার জন্য। হাসপাতালের সপ্তমতলার ৭০৩ নম্বর কেবিনে ভর্তি রাখা হয় তার মাকে। ২৮ মার্চ মায়ের ডান পায়ের হাটুতে অপারেশন করেন হাসপাতালের মালিক ডা. আব্দুর রউফ।
নিয়মিত দেখভালের অংশ হিসেবে ৩১ মার্চ বেলা সাড়ে ১২টার দিকে মফিজুর রহমান শেখ ও তার স্ত্রী রোমানা বেগম হাসপাতালে খাবার নিয়ে আসেন। আসার পরই জানতে পারেন হাসপাতালের পরিচালক ডাক্তার এইচএম আব্দুর রউফ রোগীর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছেন। এই কথা শোনার সাথে সাথেই মাকে হাসপাতাল থেকে ছাড় করিয়ে নেয়ার ব্যাপারে চেষ্টা করেন।
এ সময় তাকে জানানো হয়, তিনদিনে তার মায়ের চিকিৎসার বিল হয়েছে ৮০ হাজার টাকা। বিল অস্বাভাবিক মনে হওয়ায় মফিজুর রহমান আরো দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। বিলের বিষয়ে কথা বলার জন্য হাসপাতাল পরিচালকের কক্ষে যান। পরিচালক তার উপর ক্ষীপ্ত হয়ে স্টাফদের সাহায্যে তাকে কক্ষ থেকে বের করে দেন।
এরপর থেকে নিখোঁজ ছিলেন মফিজ। বিষয়টি পুলিশকে জানানো হয়। নিখোঁজের দিন পুলিশ মোবাইল ট্রাকিং করে জানতে পারেন মফিজের অবস্থান চাঁচড়া রায়পাড়ায়। এর দুদিন পর হাসপাতালের লিফটের নিচ থেকে মফিজের লাশ উদ্ধার হয়। লাশের বুকে ১৮ ইঞ্চি লম্বা ও গভীরসহ বিভিন্নস্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিল।
এই ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে কোতোয়ালি থানায় মামলা করা হয়। মফিজুরের মরদেহ সুরতহাল রিপোর্টে এসআই সাইদুর রহমান উল্লেখ করেন, লাশের বুকের উপরে ১৮ ইঞ্চি লম্বা গুরুতর ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাতের রক্তাক্ত চিহ্ন রয়েছে। এছাড়া বুক, পেট, কোমর হতে হাটু পর্যন্ত জখম ও ভাঙ্গা রয়েছে।
এই মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালি মডেল থানার এসআই কাজী আবু জুবাইর, তিনি ওই বছরে হজে যাওয়ার কারণে মামলাটি তদন্ত করেন এসআই সালাউদ্দিন খান।
থানার দুই কর্মকর্তার তদন্ত বাদীর পছন্দ না হওয়ায় ওই বছরের ২৮ জুন আদালতে মামলা করেন নিহতের স্ত্রী রোমানা বেগম। কিন্তু থানার মামলাটি তদন্তাধীন থাকার কারণে আদালতের মামলাটির কার্যক্রম স্থগিতের আদেশ দেন বিচারক। পরে মামলাটি তদন্ত শেষে ফাইনাল রিপোর্ট দেন আইও এসআই সালাউদ্দিন খান। তিনি রিপোর্ট উল্লেখ করেন এটি স্রেফ দুর্ঘটনা। এজন্য কর্তৃপক্ষের কোন দায় নেই। এই মামলার দ্বিতীয় তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার এসআই সালাউদ্দিন খান বলেছেন, উর্ধ্বতন মহলের সাথে আলোচনা করেই ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া হয়েছে।
পরে আদালতের মামলাটি তদন্ত কার্যক্রমের আদেশ দেয়া হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই ) কে।
গত কয়েক মাস ধরে ওই মামলাটি তদন্ত করছেন পিবিআইয়ের পুলিশ পরিদর্শক শামীম মুসা।
বর্তমান কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক শামীম মুসা বলেছেন, তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত আছে।
যশোরের বিজ্ঞ আইনজীবী কাজী ফরিদুল ইসলাম বলেছেন, এই ঘটনার মামলা থেকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের রেহাই পাওয়ার কোন সুযোগ নেই। যদিও অভিযুক্ত ব্যক্তি দায় এড়াতে নানা কলাকৌশল অবলম্বন করছে বলে শুনেছি। কিন্তু ওখানে যদি দুর্ঘটনাও ঘটে থাকে তাহলে প্রতিষ্ঠান মালিকের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি আইনের ৩০৪(ক) ধারায় বিচার হতে পারে। ফলে ওই ধারায়ও আসামির বিরুদ্ধে জেলজরিমানা হতে পারে।