তহীদ মনি: যশোরের বাজার ও বিপনী বিতানগুলোতে আগুন লাগলে সহসা নির্বাপনের সুযোগ নেই। অগ্নিকাণ্ডে আটকা পড়াদের নিরাপদ উদ্ধারের ব্যবস্থা নেই অধিকাংশ ভবনে। যশোর শহরের বিপনী বিতানগুলোর কোনটির নেই ফায়ার এক্সিট। বরং ফায়ার বিধি পাশ কাটিয়ে আবাসিকের অনুমোদন নিয়ে চলছে বাণিজ্যিক কাজ।
খোজ নিয়ে জানা গেছে, যশোরের কোনো বিপণী বিতান ‘ফায়ার কোড’ সম্পূর্ণ মেনে তৈরি হয়নি। পৌরসভার মধ্যে ৬তলা পর্যন্ত আবাসিক ভবন তৈরিতে ফায়ার কোড মানার বাধ্যবাধকতা নেই। তবে বাণিজ্যিক হলে একতলা থেকে ফায়ার কোড মানা বাধ্যতামূলক। এ কারণে আবাসিক এর অনুমোদন নিয়ে ভবনগুলোকে ধীরে ধীরে বাণিজ্যিকে রূপান্তরিত করছেন অনেক ভবন মালিক। দিন দিন বাজারের গুরুত্বপূর্ণ ও জনাকীর্ণ এলাকার প্রতিটি ভবনে ব্যবসা চললেও উপেক্ষিত ফায়ার কোড। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বা পৌরসভার পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপও গৃহীত হয় না। ফলে যশোরের বড় বাজার এলাকা অর্থনৈতিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ হলেও অগ্নি ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। কোনো কারণে অগ্নির মতো ভয়াবহ দুর্ঘটনার সৃষ্টি হলে নির্বাপণের গাড়ি প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ নেই। এ সব অনিয়মের বিরুদ্ধে ফায়ার সার্ভিস বিভাগ শুধু নোটিশ দিয়ে দায়িত্ব পালন করছে আর অনুমোদন বর্হিভুত ভবন চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিয়েছে পৌরসভা। যদিও এগুলো পালন করলে অগ্নি ঝুঁকিতে এখনই মুক্তি পাবে না যশোরের বড় বজারসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।
ফায়ার কোডের প্রধান শর্তই হলো অগ্নি নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় পানির উৎস ও ব্যবস্থ রাখা। বহুতল ভবনে আন্ডার ওয়াটার রিজার্ভার রাখা, হাইডেনসহ এক্সটিংগুইসার রাখা, জরুরি নির্গমনের পথ বা সিঁড়ি রাখা, ছাদ খোলা রাখা, দমকল বাহিনীর আসা যাওয়ার পথ রাখাসহ এ সংক্রান্ত যাবতীয় নীতি মানা।
প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুম এলে সারাদেশে আগুনর দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়। প্রতিদিন খবরের কাগজ বা টেলিভিশনে অগ্নি দুর্ঘটনার খবর এখন স্বাভাবিকে পরিণত হচ্ছে। গতমাসে ঢাকার বেইলি রোডের কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টের অগ্নিকাণ্ডে ঝরেগেছে নারী—শিশুসহ ৪৬টি তাজা প্রাণ। হোটেলের ২/১ জন কর্মচারী ছাড়া অন্যরা সবাই ওই হোটেলে খাদ্য গ্রহণের জন্যে এসেছিলেন আর কোনো অপরাধ তাদের ছিল না অথচ আগুনে পুড়ে মরতে হলো। অগ্নিকাণ্ডের পর জানাগেছে ওই ভবনের ছিল না অনুমোদন, দেয়া হয়েছিল নোটিশ আরও অনেক ত্রুটি। রাজউকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অভিযান চালিয়ে কোথাও মামলা করছে কোথাও হোটেল বন্ধ করছে কোথাও ভবন বন্ধ করছে। আগুন প্রতিরোধে নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তারপরও সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার দুটি অগ্নিকাণ্ডের খবর ছিল টেলিভিশনের পদার্য়।
আগুন নিয়ে যখন এত কথা তখন যশোর একেবারেই অরক্ষিত। বিশেষ করে বড় বাজারের মতো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও যশোর অর্থনৈতিক জোন একেবারে স্ফুলিঙ্গের মতোই ভয়াবহ অবস্থায় রয়েছে। এত ঘন ও বাণিজ্যিক স্থান এটি যে পা ফেলে গা বাঁচিয়ে চলাচল করা কঠিন। তার ওপর শুরু হচ্ছে রমাজান ও ঈদ কেনাকাটা। যশোরে রমাজানে ও ঈদ উপলক্ষে বড়বাজার এলাকা সকাল থেকে মধ্যরাত অবধি এখানে হাজার হাজার মানুষ বেচাকেনার জন্যে চলাচলে ব্যস্ত থাকবে।
তার ওপর অসংখ্য ইঞ্জিন রিকসা, ভ্যান, ইজিবাইক, ট্রলি, পিকআপ, মালামালবাহী ট্রাক বাজারকে করে তুলেছে ঘিঞ্জি। প্রতিটি দোকানের সামনের চলাচলের রাস্তা ও সরকারি বা পৌরসভার স্থান পূর্ণ থাকে দোকানের মালামালে। চালের বস্তা, গুড়ের কলস, তেল—কেরোসিনের ড্রাম, ফুটপাথের ব্যবসা, ভ্যানে বা এ জাতীয় গাড়িতে ভাসমান ব্যবসা এবং টুলের উপর, ঝুড়িতে, খোলারাস্তায় মালামাল ফেলে রেখে ব্যবসা—রয়েছে ফেরি করে বিক্রেতাদের ব্যবসা। অনেক স্থায়ী দোকানের সামনের জায়গাটুকু ভাসমান বা ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের কাছেও ভাড়া দিচ্ছে দিন চুক্তিতে।
ফলে এমনিতেই সারাদিন মানুষ ও যানবাহনে বাণিজ্যিক এই এলাকার পূর্ব দিকে বরফকল, সেখান থেকে পশ্চিম দিকের আরএন রোড, বরফকলের পশ্চিম—উত্তর কোণায় জেলখানার গেটসহ কাঠের পুল, ওই রাস্তা ধরে দড়াটানা, দক্ষিণে এগিয়ে পশ্চিম দিকে টাউন হল পর্যন্ত এবং শহরের মধ্যে লালদীঘির পাড় ও বেজপাড়া হয়ে মণিহার পর্যন্ত এলাকাটাই পুরো বাণিজ্যিক অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। তবে এর মধ্যে বড় বাজারের চুড়িপট্টির ছোট ছোট কাঠের দোকান ও সরু পথ, ফেন্সিমার্কেট, পাইকারি কাঁচা মার্কেট, মাছবাজার সংলগ্ন এলাকা এত বেশি ঘিঞ্জি ও সরু যে একটা ভ্যান নিয়েই ঢোকা দায়। এমতাবস্থায় অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনা ঘটলে কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা ফায়ার সার্ভিস বিভাগ ও বাজার ব্যবসায়ী সমিতির নেতাসহ অন্যরা কল্পনায় আনতে সাহস পাচ্ছেন না। অথচ এর প্রতিকারের পথও খুেঁজে পাচ্ছেন না।
গতবছর থেকে বাজার এলাকায় অগ্নিঝুঁকি মুক্ত রাখতে ফায়ার সার্ভিস অনেকগুলি সুপারিশ করলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। বাজার ব্যবসায়ী সমিতির উদ্যোগও থমকে আছে। গত বছর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ফায়ার সার্ভিস ও পৌরসভার সহায়তায় অর্ধশতাধিক অপরিকল্পিত ও অগ্নিসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে নোটিশ দেয়া হয়েছিল, একবার শুনানিও হয়েছে তারপর আরতার অগ্রগতি নেই। পৌরসভা ফায়ার কোডসহ অন্যান্য নিয়ম না মানায় শহরের অন্তত ৭টি হাই রাইজ ভবনের অনুমোদন স্থগিতওসহ কাজকর্ম বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। সেটাও দু’বছর হতে চললো। ভবনগুলোতে মানুষ ঠিকই বসবাস করছে।
যশোর পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী সিকদার মকলেচুর রহমান(সিভিল) জানান, ভবনের প্লান পাস করতে হলে আবাসিক ভবনের ৭ম তলা থেকে এবং বাণিজ্যিক ভবনের ক্ষেত্রে একতলা থেকেই ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন বাধ্যতামূলক। বড়বাজারে পুরাতন ভবন নিয়ে এই মুহূর্তে বেশি কিছু বলতে পারব না তবে নতুন অনুমোদনের ক্ষেত্রে আমরা সচেতনতা পালন করছি।
বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মীর মোশাররফ হোসেন বাবু জানান, অগ্নি প্রতিরোধে কিছু উদ্যোগ নেয়া হলেও সম্পূর্ণটা বাস্তবায়িত হয়নি, পৌরসভার অসহযোগিতায়। তবে অনেক ব্যবসায়ী এক্সটিংগুইসারসহ নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করেছেন। অনেকে পুরাতন এস্টিংগুইসারটি রিফিল করেছেন। তবে কোনো বিপণী বিতান বা বাণিজ্যিক ভবনের তলদেশে যেমন পানির রিজার্ভার নেই তেমনি শতভাগ ফায়ার কোড মেনে তৈরিও হয়নি। প্রবেশ ও বাইরের বেরোবার পথ নেই বাজারের থেকে বিশেষত ফেন্সি মার্কেট, চুড়িপট্টিসহ সংশ্লিষ্ট এলাকায় যদি দুর্ঘটনা ঘটে তবে কত ক্ষতি হবে আমরা ভাবতে পারছি না।তারচেয়েও বড় কথা আবাসিকের অনুমোদন নিয়ে বাণিজ্যিক ভবন গড়ে উঠছে ও ব্যবহৃত হচ্ছে। মানা হচ্ছে না কোনো নিয়ম ও নিরাপত্তা। প্রশাসন যদি অভিযান চালায় নিয়মিত তাহলে এর থেকে কিছু স্বস্তির খবর তৈরি হতে পারে না হলে ভয়াবহতার মাত্র আমরা চিন্তাও করতে পারছি না।
জেলা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অফিসের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশিদ জানান, অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইনে বাণিজ্যিক ও বিপণিবিতানগুলোর জন্যে নির্দিষ্ট আইন আছে। যশোরে পরিপূর্ণ ফায়ার কোড মেনে গড়ে উঠেছে এমন প্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে।
তিনি আরো জানান, আমাদের পক্ষ থেকে অগ্নি ঝুঁকি এড়াতে মাঝে মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যে মহড়া, মাইকিং ও নোটিশ দেয়া হয়। জন সচেতনতা ছাড়া এই ঝুঁকি মুক্ত থাকার উপায় নেই এখন। গত বছর থেকে আমরা বার বার চেষ্টা করে যাচ্ছি কিন্তু বলার মতো ফল তৈরি হয়নি। আর বড় বজার এতটাই ঝুঁকিতে যে আমরা কাউকে বোঝাতে পারছি না। যশোরের অর্থনীতির জন্যে এলাকাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু এর অগ্নি নিরাপত্তার বিষয়টি একেবারেই উপেক্ষিত। একবার অগ্নি দুর্গটনা ঘটলে মারাত্মক ট্রাজেডিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিষয়টি আমরা বার বার প্রশাসন, বাজার ব্যবসায়ী ও প্রতিনিধিদের জানিয়েছি।
তবে সম্প্রতি যশোর জেলা প্রশাসন অগ্নি প্রতিরোধের জন্যে হোটেল রেস্তোরাসহ বিপনী বিতান, আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন মালিক, ব্যবসায়ী মালিক সমিতিকে নোটিশ দিয়েছে। অগ্নি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ১০ দিনের মধ্যে অগ্নি নির্বাপন যন্ত্র প্রতিস্থাপন ও হালনাগাদ করণ সম্পন্ন করে অবহিত করার নির্দেনা দিয়েছে।
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কমলেশ মজুমদার জানান, জেলা প্রশাসন ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্টদেরকে নোটিস দিয়েছে। এছাড়া হোটেল—রেস্তোরায় অভিযান শুরু করেছে। ইতোমধ্যে চলতি সপ্তাহে হোটেল ও রেস্তোরা আইন ২০১৪ এর ১৯ ধারায় ৯টি অভিযান হয়েছে। সেখানে ৯টা মামলা হয়েছে এবং জরিমানাও করা হয়েছে।