৪ঠা অক্টোবর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৯শে আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
যবিপ্রবি : নিয়োগ বাণিজ্য—অনিয়ম নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে

নিজস্ব প্রতিবেদক : যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (যবিপ্রবি) ফের নিয়োগ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি কয়েকটি নিয়োগ নিয়ে নানামুখী প্রশ্ন ওঠায় এই বিতর্কের সূত্রপাত হয়। এই বিতর্কের নেপথ্যে নিয়োগে অনিয়ম ও নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। অনুমোদনহীন পদে নিয়োগ, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ‘নজিরবিহীন’ উচ্চমাধ্যমিকের যোগ্যতা শিথিল করাসহ দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকেও লিখিত আবেদনের ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগকারীদের দাবি, নিয়োগে এসব অনিয়মের পেছনে রয়েছে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য। দু’একটি ঘটনা ধরা পড়লেও এই বাণিজ্যে লাগাম টানার মতো কেউ নেই।

যবিপ্রবি সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিভিন্ন সময়ে যবিপ্রবিতে নিয়োগ অনিয়ম—নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি কয়েকটি নিয়োগ নিয়ে নানামুখী প্রশ্ন ওঠায় নতুন করে বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে।

সূত্র অনুযায়ী, গত ২২ আগস্ট’২৩ যবিপ্রবিতে ‘ল অফিসার’ হিসেবে একজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও যোগদানপত্র অনুযায়ী তাকে সহকারী রেজিস্ট্রার (লিগ্যাল) পদের বিপরীতে অস্থায়ী নিয়োগ দেখানো হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, ‘ল অফিসার’ নিয়োগের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কোনো অনুমোদন নেই। এর আগে যবিপ্রবি’র ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন বিভাগের প্রভাষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘নজিরবিহীনভাবে’ উচ্চমাধ্যমিকের যোগ্যতাকে শিথিল করা হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী উচ্চমাধ্যমিকে ন্যূনতম ‘এ’ গ্রেড বা প্রথম বিভাগ থাকার কথা। সেখানে আন্তর্জাতিক ট্রেনিংকে যোগ্যতা গণ্য করে উচ্চমাধ্যমিকে ছাড় দেয়া হয়েছে। অভিযোগকারীদের দাবি, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী যোগ্যপ্রার্থী বাছাই করা হয়নি; বরং মনোনীত প্রার্থীর যোগ্যতা অনুযায়ী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি তৈরি করা হয়েছে।

এর আগে ২০১৮ সালে পিএ পদে মনজুরুর রহমান নামে একজনকে রিজেন্ট বোর্ড চূড়ান্ত নিয়োগ প্রদান করে। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই তাকে যোগদান করতে না দিয়ে পরবর্তী রিজেন্ট বোর্ডে তার নিয়োগ বাতিল করা হয়। বিষয়টি নিয়ে মনজুরুর উচ্চ আদালতে মামলা করলে বিষয়টি এখনও ঝুলে রয়েছে।

যশোর সদর উপজেলার বানিয়ালী গ্রামের মনজুরুর রহমান অভিযোগ করেন, ২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় তিনিসহ মোট ছয়জন নিয়োগের জন্য উত্তীর্ণ হন। ০৮ সেপ্টেম্বর তাকে যোগদান করতে বলা হয়। কিন্তু নির্ধারিত দিনে যোগদান করতে গেলে উপাচার্যের তৎকালীন পিএস ১৭ লাখ টাকা দাবি করেন। এ নিয়ে উপাচার্যের সাথে দেখা করতে গেলে তাকে দেখা করার সুযোগ দেয়া হয়নি। বরং পিএস কামরুল হাসান বলেন, ‘স্যার তোমাকে ঘাড় ধরে বের করে দিতে বলেছেন।’ এরপর টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় পরবর্তী রিজেন্ট বোর্ডে তার নিয়োগ বাতিল করে দেয়া হয়।

মনজুরুর রহমান জানান, এরপর তিনি দুদকে অভিযোগ করেন এবং উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হন। উচ্চ আদালত মামলাটি গ্রহণ করে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এটি শূন্য রাখার নির্দেশ দেন। মামলাটি এখনো চলমান।

এছাড়া লিফটের জন্য ১৪টি লিফট অপারেটর নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ১১ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে যে ১৪টি লিফটের কথা বলা হয়েছে তার ৬টি এখনও স্থাপনই করা হয়নি।

যবিপ্রবিতে এর আগেও একাধিক নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক ও অভিযোগ রয়েছে। অবৈধভাবে নিয়োগের মাধ্যমে ৬১ লাখ ৩১ হাজার ৭৩২ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গত ২১ আগস্ট যবিপ্রবি’র প্রাক্তন উপাচার্য, যবিপ্রবির পূর্ত দপ্তরের উপপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মো. আব্দুর রউফসহ তিনজনের বিরুদ্ধে যশোর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতের অধীনে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) যশোর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলা করেছে।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, যবিপ্রবির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) পদে আবেদন করেন মো. আব্দুর রউফ। কিন্তু অবৈধভাবে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার (গ্রেড—১) (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) পদে নিয়োগ দেয়া হয়। যে পদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করা হয়নি; এবং প্রার্থী ওই পদে আবেদনও করেননি। এই নিয়োগের মাধ্যমে তাকে অক্টোবর/২০০৯ হতে জুন/২০২২ পর্যন্ত বেতনভাতা বাবদ সর্বমোট ৬১ লাখ ৩১ হাজার ৭৩২.৫২ টাকা সরকারি কোষাগার হতে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করার সুযোগ করে দিয়ে সরকারের ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। এটি দন্ডবিধি ৪০৯/১০৯ ধারা তৎসহ ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

এ প্রসঙ্গে দুদক যশোর জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. আল আমিন জানান, প্রাথমিক অভিযোগ পাওয়ার পর গতবছর থেকে দুদক যশোর অফিসের পক্ষ থেকে অনুসন্ধান ও রেকর্ডপত্র যাচাই করা হয়। এ সময় এজাহারে উল্লেখিত দুর্নীতি, অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতসহ বিভিন্ন অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় মামলা হয়েছে।

সূত্র আরও জানায়, আব্দুর রউফ ছাড়াও আরও কয়েকটি নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান অব্যাহত রেখেছে। সর্বশেষ তথ্য কর্মকর্তা নিয়োগ পরীক্ষার পরই নাম নির্দিষ্ট করে একজন প্রার্থীকে মোটা টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে বলে দুদকে অভিযোগ করা হয়। অভিযোগের দু’সপ্তাহ পর সেই প্রার্থীকেই নিয়োগ প্রদান করা হয়।

অভিযোগকারীদের দাবি, অনিয়মের অভিযোগ ওঠা ছাড়াও যবিপ্রবি’র সিংহভাগ নিয়োগের ক্ষেত্রে লাখ লাখ টাকার লেনদেন হয়। এই লেনদেনে জড়িত অভিযোগে যবিপ্রবির সম্প্রতি একজন কর্মকর্তাকে লঘুদন্ড দিয়েছে এবং একজন টেলিফোন অপারেটরকে চাকরিচ্যুতও করেছে। যবিপ্রবি প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই বিভিন্ন পদে এসব অনিয়ম হচ্ছে। গতবছর ৮ জানুয়ারি যবিপ্রবি ক্যাম্পাসেই কর্মকর্তা ও কর্মচারী সমিতি নিয়োগ বাণিজ্য ও অনিয়মের প্রতিবাদে মানববন্ধন কর্মসূচিও পালন করে। এর আগে পরে এসব অভিযোগে প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলনও হয়েছে। এমনকি যবিপ্রবি রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী আহসান হাবীবকেও প্রশাসনিক যোগ্যতার শর্ত পূরণ ছাড়াই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

নিয়োগ অনিয়ম—অভিযোগ নিয়ে যবিপ্রবি রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী আহসান হাবীবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ ব্যাপারে বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তথ্য কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।

তথ্য কর্মকর্তা নাজমুল হোসাইনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নিয়োগ—অনিয়ম নিয়ে প্রশ্ন শুনে পরে বক্তব্য দেবেন বলে জানান। পরবর্তীতে তিনি যোগাযোগ করে বক্তব্যের জন্য ‘তথ্য অধিকার আইনে’ লিখিত আবেদনের পরামর্শ দেন।

সার্বিক অভিযোগের ব্যাপারে যবিপ্রবি উপাচার্য প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, রিজেন্ট বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সহকারী রেজিস্ট্রার’র (লিগ্যাল) বিপরীতে অস্থায়ী পদে ল অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আর ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন বিভাগের প্রভাষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছিল না বলে উচ্চমাধ্যমিকের যোগ্যতা শিথিল করা হয়েছে।

তবে এটি সচরাচর হয় বলে স্বীকার করে তিনি বলেন, শিক্ষক নিয়োগে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিন্ন নীতিমালা বজায় রেখে রিজেন্ট বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

পিএ পদে মনজুরুর রহমানের নিয়োগ প্রদান ও বাতিল নিয়ে তিনি বলেন, মনজুরুর একেক সময় একেক জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। তার ব্যাপারে তদন্ত করা হয়েছে। তবে সে আদালতে গেছে। আদালত থেকে যে জবাব চেয়েছিল তা দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে আদালতের আর কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি।

আব্দুর রউফসহ পূর্বের নিয়োগ নিয়ে উপাচার্য বলেন, ওইসব নিয়োগ নিয়ে প্রাক্তন ভিসি বলতে পারবেন। তিনি দাবি করেন, তিনি যোগদান করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য বন্ধ হয়েছে। এ কারণে শহরের রাজনীতিকরা সবসময় পেছনে লেগে থাকেন, কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা অঘটন ঘটাবেন। তারাই এ ধরণের অভিযোগ—অপপ্রচার করছেন।

সম্পাদক ও প্রকাশক : শাহীন চাকলাদার  |  ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আমিনুর রহমান মামুন।
১৩৬, গোহাটা রোড, লোহাপট্টি, যশোর।
ফোন : বার্তা বিভাগ : ০১৭১১-১৮২০২১, ০২৪৭৭৭৬৬৪২৭, ০১৭১২-৬১১৭০৭, বিজ্ঞাপন : ০১৭১১-১৮৬৫৪৩
Email[email protected]
পুরাতন খবর
FriSatSunMonTueWedThu
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031
স্বত্ব © samajerkatha :- ২০২০-২০২২
crossmenu linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram