মেহেরপুর প্রতিনিধি : খনন শেষ হতে না হতেই মেহেরপুর অংশে ফের মরে যাচ্ছে ভৈরব নদ। সীমান্তের ওপারে ভারতের পশ্চিম বাংলার নদীয়া জেলার করিমপুর থানা। ওই থানার নন্দনপুর গ্রামের জলঙ্গি নদের সেতুর নিকট থেকে বেরিয়ে এসেছে নদ। হিন্দু দেবতা শিব রুদ্রমূর্তি ধারণ করলে তাঁর ভৈরব রুপ থেকে এপারে জলঙ্গি‘র নাম হয় ভৈরব। বৃটিশ শাসনামলে বড় বড় বজরা চলতো এই প্রমত্ত ভৈরবে। কোলকাতার সাথে ছিলো এই নদের পানি পথে যোগাযোগের পথ। ব্যবসা বাণিজ্য হতো এই ভৈরবের পানিপথ ধরে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী ৮০র দশকে ভারত অংশে জলঙ্গিতে বাঁধ দিয়ে ভৈরবের পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেয়। ফলে প্রমত্ত ভৈরব হারায় তার গতি। ১৬০ কিলোমিটার ভৈরবের কোথাও নেই সেই রুদ্রমূর্তি। ৮০ শতাংশই প্রায় স্রোতহীন, প্রাণহীন। মেহেরপুর অংশ ভৈরবের দৈর্ঘ ২৯ কিলোমিটার।
ভৈরব নদের যতদুর চোখ যায় সবুজ কচুরিপানাতে ঢাকা পড়ে নদের তলদেশে থাকা পানি। এতে নদে দেখা দিয়েছে অক্সিজেনের স্বল্পতা। ফলে ব্যাহত হচ্ছে মাছের বংশ বিস্তার। ২০১১ সালের ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগরে ‘মুজিবনগর দিবসের’ সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভৈরব নদ পুনঃখননের প্রতিশ্রæতি দেন। মুজিবনগর উপজেলার রশিকপুর থেকে গাংনী উপজেলার কাথুলী পর্যন্ত ২৯ কিলোমিটার নদ ২০১৬ সালের ২৩ এপ্রিল পুনঃখনন শুরু হয়। ২০১৭ সালের এপ্রিলের শেষ হয়। খনন করতে ১২৯ কোটি টাকার খরচ হয়। ভৈরব পুনঃখননের সময় জেলা প্রশাসন ও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী মেহেরপুরের এমপি ফরহাদ হোসেন বলেছিলেন- নদের দুইপাড় দিয়ে বৃক্ষ রোপন এবং ওয়াকওয়ে করা হবে। কিন্তু এরপর কয়েক বছর পার হলেও ঘোষিত পরিকল্পনার কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। বলা যায় পুনখননের মাটি ফেলা হয় নদ পড়ে কৃষকের জমিতে। এতে করে তিন থেকে চার হাজার বিঘা নদপাড়ের জমি অনাবাদি হয়ে পড়ে আছে মাটির পালাতে। অনেক স্থানে ক্ষমাতাসীন দলের লোকজন সেই মাটি বিক্রি করে লাখপতি হয়েছেন।
আঠারশতকের কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের ‘আমার সন্তান’ কবিতায় পাওয়া যায়, দেবী অন্নপূর্ণা মানবীর রূপে ঈশ্বরী পাটনির নৌকায় মুজিবনগরের বাগোয়ান অংশে ভৈরব নদ পার হন। খুশি হয়ে বর হিসেবে মাঝিকে সোনা-রূপা, মুক্তা-পান্না এমন কি রাজ্য চাওয়ার সুযোগ দেন। কিন্তু ঈশ্বরী পাটনি ছোট্ট প্রার্থনা করেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।’ বলা যায় ভৈরব খননের কারনে অনেক জমি অনাবাদি হওয়াতে নদপাড়ের কৃষক চাষাবাদ থেকে বঞ্চিত হয়ে জাতীয় খাদ্য ভাÐারে অবদান ব্যহত হচ্ছে।
ভৈরব নদের থানাঘাটে জোড়া নৌকার মাঝি ছিলো গোভিপুর গ্রামের কামরুল হোসেন। এখন বয়োবৃদ্ধ। তিনি স্মৃতিরোমন্থন করে বলেন, বর্ষার সময় পারাপার করতে গিয়ে কতদিন তার নৌকা ¯্রােতের টানা ভেসে গেছে। এখন সেই নদে বর্ষার সময় মাজাপানি থাকে।
১৫৮৯ সালে মোঘল সেনাপতি মানসিংহ যশোরের প্রতাপাদিত্যকে দমন করার জন্য নদীপথেই মেহেরপুরের বাগোয়ানে এসে ভবানন্দ মজুমদারের সহযোগিতা গ্রহণ করেন। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে এ তথ্যের সমর্থন মেলে। কিংবদন্তী আছে ১৭৫০ সালে নবাব আলীবর্ন্দী খাঁ নদীপথে শিকারে আসেন এই বাগোয়ান পরগনায়। তখন ভৈরব তীরবর্তী এক নারীর আতিথ্যে মুদ্ধ হয়ে তাকে ‘রাজা’ উপাধি দেন।
ভৈরব ধরেই এ অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠির মাঝে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে আসেন খ্রিস্টান মিশনারি পাদ্রিরা। পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য কুঠি এবং নিষ্ঠুর নীলকরদের বহু কুঠিও গড়ে ওঠে ভৈরব তীরবর্তী গ্রামগুলোতে। এ অঞ্চলে সংগঠিত কৃষকদের শোষণ-বঞ্চনা এবং লড়াই-সংগ্রামের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে ভৈরব।
দেশভাগের পরেও এই ভৈরবের বুক দিয়ে বড়বড় বজরা চলতো। জেলা শহরের উপকণ্ঠে ‘বন্দর’ নামে একটি গ্রামের নামকরণ হয়েছে সেখানে বড় বড় বজরা বন্দর করতো বলে। সেখান থেকে ভেঁপু বাজিয়েই ছেড়ে যেত মালবাহি জলযানগুলো। ১৯৭১ সালে প্রমত্ত ভৈরব সেই চিরচেনা মূর্তির মধ্যেও নদকে সহায় করে গড়ে উঠে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের পরাক্রমশালী প্রতিরোধ।
পুনঃখনন করার পর বছর পার না হতেই ভৈরব নদে পানিতে এমন কচুরিপানা ভরে যায়। যা দেখে মর্মাহতর কথা শোনান বুড়িপোতা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মো. শাহ জামাল চৌধুরী । তিনি বলেন- ‘নদে পানিপ্রবাহ না থাকার কারণেই কচুরিপানাতে ভরে গেছে নদের পানির উপর অংশ। পানির উৎসমুখে বাঁধ না সরালে কোনভাবেই পানিপ্রবাহ হবেনা’। কিন্তু ভারত কী সেই বাঁধ অপসারণ করবে?