হিজরি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মুহাররমুল হারাম। এখানে হারাম শব্দের অর্থ সম্মানিত। পবিত্র এ মাসের সম্মান, মর্যাদা ও শারাফাতের কারণেই মাসটিকে ‘মুহাররমুল হারাম’ আখ্যয়িত করা হয়। একই সঙ্গে কোরআনুল কারিমে যে চারটি মাসকে ‘হারাম’ তথা সম্মানিত আখ্যা দেওয়া হয়েছে, সর্বসম্মতিক্রমে তার প্রথম মাসটি এই পবিত্র মুহাররম। বাকি তিনটি হারাম মাস হলো- রজব, জিলকদ ও জিলহজ।
অন্য মাসগুলোর চেয়ে ইসলামে এই চারটি মাসের গুরুত্ব তুলনামূলক বেশি। হাদিস শরিফে পবিত্র মুহাররম মাসের মর্যাদা বর্ণনা করে আল্লাহর রাসুল (সা.) এটিকে ‘শাহরুল্লাহ’ তথা আল্লাহর মাস আখ্যা দিয়েছেন। মুহাররমের এই মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের কারণেই রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘রমজানের পর সব মাসের রোজার চেয়ে মুহাররমুল হারামের রোজা বেশি ফজিলতপূর্ণ...।’ (সহি মুসলিম)
সম্মানিত এই মাসটির দশম অর্থাৎ আশুরার দিন অতিসম্মানিত। এ দিনটিকে ঘিরে পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটেছে নানা ঘটনা। হজরত আদম (আ.)-এর জন্ম থেকে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত মানব ইতিহাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সম্পৃক্ততা এই মাস ও আশুরার দিনের সঙ্গে।
মুহাররমের এই সম্মান ও মর্যাদা আদি ও চিরন্তন। এই মাসের শান ও সম্মান কোনও স্থান ও সময়ের সঙ্গে আবদ্ধ নয়। এই মাসে করণীয় মহানবী (সা.)-এর কাছ থেকে বিশেষ দু’টি সুন্নত আমল প্রমাণিত। এই আমল দু’টি পরিপালনে তিনি তাঁর উম্মতকে উৎসাহমূলক নির্দেশনা দিয়েছেন। আমল দু’টি হলো-
এক. এই মাসের ১০ তারিখ তথা আশুরার দিনে রোজা রাখা। এ প্রসঙ্গে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসুল (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করলেন, তখন তিনি দেখলেন- সেখানকার আহলে কিতাবরা আশুরার দিনে রোজা রাখে। যখন তিনি এর কারণ জানলেন, তখন বললেন, এই দিনটিতে বনি ইসরাইল হজরত মুসা (আ.)-এর সঙ্গে ফেরাউনের জুলুম থেকে মুক্তি পেয়েছিল। আর ফেরাউন তার সঙ্গীদের নিয়ে নীল নদে ডুবে মরেছিল। এজন্য শুকরিয়া স্বরূপ আল্লাহর নবী হজরত মুসা (আ.) এই দিনটিতে রোজা পালন করতেন।
মুসা (আ.)-এর অনুসরণে এই দিনে ইহুদিদের রোজা রাখার প্রসঙ্গ টেনে রাসুল (সা.) বললেন, আমরা এই রোজা রাখার ক্ষেত্রে তাদের (ইহুদি) চেয়ে বেশি অধিকার রাখি। কারণ, আমরা হজরত মুসা (আ.)-এর বেশি নিকটবর্তী। যাইহোক, এই ঘটনার পর আল্লাহর রাসুল (সা.) নিজে এই দিনে রোজা রাখলেন এবং সাহাবিদেরও রোজা রাখার প্রতি উদ্বুদ্ধ করলেন। (সহি বুখারি)
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে এ-ও বর্ণিত আছে যে যখন রাসুল (সা.) নিজে আশুরার দিনে রোজা রাখার আমলটি শুরু করলেন এবং সাহাবাদেরও এর প্রতি উদ্বুদ্ধ করলেন, তখন কয়েকজন সাহাবি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! এই দিনটিকে তো ইহুদি ও খ্রিস্টানরা ‘বড়দিন’ জ্ঞান করে পালন করে (মনে হয়- এটি তাদের জাতীয় ও ধর্মীয় নিদর্শন), তখন রাসুল (সা.) বললেন, ইনশাআল্লাহ আগামী বছর আশুরার দিন এলে আমরা মুহাররমের নবম দিনেও রোজা রাখবো (যাতে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সঙ্গে সাদৃশ্য না হয়)। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, কিন্তু পরের বছর মুহাররম মাস আসার আগেই রাসুলুল্লাহ (সা.) ইন্তেকাল করেন। (সহি মুসলিম)
উপরের ঘটনার ওপর ভিত্তি করে ইসলামি ফকিহরা লেখেন যে এজন্য মুহাররমের দশম তারিখের সঙ্গে নবম তারিখেও রোজা রাখা উচিৎ এবং এটি উত্তম। তবে কোনও কারণে যদি নবম দিন রোজা রাখা সম্ভব না হয়, তাহলে ১০ তারিখের সঙ্গে ১১ তারিখকে মিলিয়ে দুই দিন রোজা রাখতে হবে। যাতে এক্ষেত্রে মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকে এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে সাদৃশ্য না হয়।
তবে আকাবির আলেমদের অনেকে অভিমত পেশ করেছেন যে বর্তমান যুগের ইহুদি-খ্রিস্টানরা সাধারণত রোজা রাখে না এবং চান্দ্র হিসাব অনুসারে তারা কোনও উপাসনাও করে না- এজন্য শুধু আশুরা দিনটিতে রোজা রাখলেও তাদের সঙ্গে সাদৃশ্যতা হওয়ার আশঙ্কা তেমনটি নেই। তাই শুধু ১০ তারিখ রোজা রাখাতেও কোনও সমস্যা হবে না।
আশুরার দিনে রোজা রাখার ফজিলত সম্পর্কিত সহি হাদিস বর্ণিত রয়েছে। হজরত আবু কাতাদাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, আমি আল্লাহর কাছে আশা রাখি যে- এই দিনের রোজার কল্যাণে তিনি বিগত এক বছরের গোনাহ মাফ করে দেবেন। (সহি মুসলিম)
দুই. এই দিনের আরেকটি আমল হলো- সামর্থানুযায়ী পরিবারের জন্য ভালো ও উন্নত খাবারের আয়োজন করা। পবিত্র হাদিস শরিফের মাধ্যমে এই আমলটিও প্রমাণিত। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) হুজুর (সা.)-এর বাণী নকল করে বলেন, যে ব্যক্তি আশুরার দিনে আপন পরিবারের খাবারের খরচ বর্ধিত ও প্রশস্ত করবে, আল্লাহ তায়ালা আগামী এক বছরে তার ধন-সম্পদের মধ্যে বরকত দান করবেন। (মেশকাত) বুজুর্গ আলেমদের মধ্যে হজরত সুফিয়ান সাওরি (রহ.) বলেন, আমি এটি যাচাই করে দেখেছি এবং সত্য পেয়েছি।
উপরের আলোচনার মাধ্যমে জানা গেল যে- আশুরার দিনে সহি হাদিসের আলোকে দু’টি আমল প্রমাণিত এবং আমল দু’টি আল্লাহর রাসুল (সা.) থেকে সাব্যস্ত। প্রথমত, আশুরার দিনে রোজা রাখা এবং দ্বিতীয়ত যাদের খাবার-খরচার ব্যবস্থা করা নিজের ওপর আবশ্যক, এই দিনে তাদের জন্য ভালো খানাপিনার আয়োজন করা। আল্লাহ আমাদের আশুরা সম্পর্কিত সঠিক জ্ঞান দান করেন এবং তাঁর এবং তাঁর রাসুলের দেখানো পথে জীবন পরিচালনার তাওফিক দান করেন। আমীন।
লেখক : বেলায়েত হুসাইন
গণমাধ্যমকর্মী; শিক্ষক, মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়্যাহ, ঢাকা।