মোতাহার হোসেন, মণিরামপুর (যশোর) : মণিরামপুর উপজেলার মাহাতাবনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অতিরিক্ত শ্রেণিকক্ষ নির্মাণে ৭৯ লাখ ৪৩ হাজার ৬১৪ টাকা চুক্তি ও ৮৩ লাখ ৬১ হাজার ৬৯৯ টাকা প্রাক্কলন মূল্যে জিসান বিল্ডার্স নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ পায়। নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার দিন ধার্য্য ছিল ২০২২ সালের ১৯ মে। ওই সময়ে মধ্যে নির্মাণ কাজ শুরুই করেনি ঠিকাদার। এরপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ২২ জুন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান জিসান বিল্ডার্সকে পত্র দেন উপজেলা বিভাগ।
প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার দাস সাক্ষরিত ওই পত্রে নির্মাণ কাজের ভিত্তি ঢালাইয়ে অনুরোধ করা হয়। চিঠি পেয়ে ভিত্তি ঢালাইয়ের ৪ দিন পর ওই নির্মাণ কাজের ৯০ শতাংশ সম্পন্নের বিল জমা দেয় জিসান বিল্ডার্স। প্রকৌশল অফিস সে বিল প্রদানও করে। বিল প্রদানের ১৫ মাস অতিবাহিত হলেও আজও মাহাতাবনগর স্কুলের নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। বিলের বিপরীতে প্রকৌশল অফিস ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ৩৭ লাখ টাকা বিডি(ব্যাংক ডিপোজিট) করে। কাজের শুরুতেই বিডির টাকা উত্তোলন করে নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার। এ কাজে উপজেলা প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার দাসের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তদন্ত করছে দুদক। সম্প্রতি দুদক অভিযানও চালিয়েছে এই অফিসে।
অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। এই ঘটনার পর উপজেলা প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার দাসসহ সংশ্লিষ্ট অনেকেই আতংকে রয়েছেন।
জানাযায়, ২০১৯ সালের ২৫ এপ্রিল উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় হতে ৯ টি প্যাকেজ কাজের দরপত্র আহবান করা হয়। যার ই—টেন্ডার নোটিশ: ০১/১৮—১৯। টেন্ডারে মের্সাস পারিজাত এন্টার প্রাইজ ও মেসার্স হীরা কনস্ট্রাকশন যৌথভাবে অংশ নেয়। যার রেজি: নং—১৪৬৩ এবং তারিখ ১৮—০৫—২০১৯ ইং। যৌথ উদ্যোগের স্ট্যাম্পের কল নম্বর—২৬৮২৩১৮,২৬৮২৩১৯ ও ২৬৮২৩২০।
এই দরপত্র বিজ্ঞপ্তির প্রায় তিন বছর পর উপজেলা খালবাটবিলা ও দূর্গাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণে ২০২২ সালের ৩১ মে উপজেলা প্রকৌশলী কার্যালয় হতে ০১টি প্যাকেজ কাজের দরপত্র আহবান করা হয়। এ নির্মাণ কাজের প্রাক্কলন মূল্য ১ কোটি ৫৯ লাখ ৯৪ হাজার ৭০৮ টাকা ও চুক্তি মূল্য ১ কোটি ৪৫ লাখ ২৪ হাজার ৩৯১ টাকা। যার ই—টেন্ডার নোটিশ: ০৭/২১—২২ এবং প্যাকেজ নম্বর—ডব্লিউ১.০৩৮৯১(আইডি নম্বর.৭০৫৬২৮)।
টেন্ডারে মেসার্স পারিজাত এন্টার প্রাইজ ও হীরা কনস্ট্রাকশন নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যৌথ উদ্যোগে টেন্ডারে অংশ নেয়। কিন্তু যৌথ উদ্যোগের এই স্ট্যাম্পটি নকল। যা ২০১৯ সালের ২৫ মে ই—দরপত্র বিজ্ঞপ্তির নম্বর—০১/১৮—১৯ এর বিপরীতে করা যৌথ উদ্যোগের স্ট্যাম্প। এটি স্ক্যানার মেশিনে স্ক্যান করে নতুনভাবে প্রিন্ট দিয়ে ই—দরপত্র বিজ্ঞপ্তি: ০৭/২১—২২—এ দাখিল করে। যার রেজি:নম্বর—১৪৬৩ এবং তারিখ—১৮—০৫—২০১৯ ইং। অভিযোগ রয়েছে, প্রকৌশলী দুই লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে নকল কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও এই যৌথ উদ্যোগের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেয়। এ ব্যাপারে মেসার্স পারিজাত এন্টার প্রাইজের কর্ণধর উত্তম কুমার পারিজাত বলেন, তার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ২০১৯ সালের পর মেসার্স হীরা কনস্ট্রাকশন নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথ উদ্যোগে আর কোন কাজে অংশ নেয়নি।
জেলার অন্যান্য উপজেলায় উন্নয়ন তহবিল ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) প্রকল্পের কাজ এলটিএম—এ (লিমিটেড টেন্ডারিং মেথড) দরপত্র আহবান করা হলেও উপজেলা প্রকৌশলী এনওটিএম—এ (ন্যাশনাল ওপেন টেন্ডারিং মেথড) দরপত্র আহবান করেছেন। এতে কাজের মান খারাপ হয়েছে বলে অভিযোগ। এসব সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক যশোর সমন্বিত সম্মিলিত জেলা কার্যালয়ের একটি দল গত ২৪ সেপ্টেম্বর উপজেলা প্রকৌশল অফিসে অভিযান পরিচালনা করে।
এ ব্যাপারে ে উপ—পরিচালক মো. আল—আমিন বলেন, অভিযানে প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে।
এদিকে মনিরামপুর উপজেলা উন্নয়ন প্রকল্প (জেএমপি), গ্রাম সড়ক পুনর্বাসন প্রকল্প (ভিআরআরপি) ও বৃহত্তর খুলনা অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের (কেডিআরআইপি) —এর আওতায় প্রায় ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে মেসার্স বনান্তর নামের এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান উপজেলার উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে রাস্তা নির্মাণের কাজ করছে। জেএমপি—এর অধীন ৩ কোটি ১০ লাখ ২২ হাজার ৮৪০ টাকা ব্যয়ে উপজেলার গালদা মানিকতলা—দিঘিরপাড় বাজার রোড (২ হাজার ৮২ মিটার) ও পাড়ালা সাতগাতী—পাড়ালা রাস্তা নির্মাণ (৯৬০ মিটার) এবং একই প্রল্পের অধীন ২ কোটি ৩৫ লাখ ৮৪ হাজার ১৮০ টাকা ব্যয়ে মথুরাপুর মোল্লাপাড়া—মথুরাপুর রাস্তা (১৪৭৫ মিটার) ও পানিচ্ছত্র রাইস মিল—ঘিবা প্রাইমারী স্কুল রাস্তা নির্মাণ (৯৪০ মিটার), ভিআরআরপি—এর আওতায় ৮০ লাখ ৬৩ হাজার ৪৬৮ টাকা ব্যয়ে কাশিমপুর— বটতলা—রোহিতা ইউপি রাস্তা ও পলাশী রাজবাড়ী—এড়েন্দা রাস্তা এবং কেডিআরআইপি—আওতায় ১ কোটি ৬৮ লাখ ২ হাজার ৬০ টাকা ব্যয়ে খেদাপাড়া ইউপি কাশিপুর মান্দারতলা রাস্তা (২৩৯০ মিটার) নির্মাণ কাজ চলছে। এসব কাজ নিয়ে অভিযোগ উঠছে ।
উত্তরাঞ্চলের রাস্তা কাজে পার্শ্ববর্তি স্মার্ট ভাটায় নিন্মমানের ইট ও বালি মিশিয়ে ট্রলিযোগে এনে বেজ দেওয়া হয়েছে। এ সময় রাস্তার নির্মাণ শ্রমিক আব্দুল মান্নান কবির হোসেন, শাহাদাৎ হোসেন বলেন,এই ইটের খোঁয়া দিয়ে বেজ, সাববেজ করা হয়েছে, যা বেশি দিন টিকবে না। ইঞ্জিনিয়ার অফিসের স্যারদের সামনে এসব করা হলেও তারা কিছু বলেন না। এক প্রশ্নের জবাবে রাস্তা নির্মাণের কর্তব্যরত উপসহকারি প্রকৌশলী আব্দুল খালেক বলেন, ব্যস্ততার কারনে কয়েক দিন যাওয়া হয়নি। এজন্য এমনটি করা হয়েছে।
আর উপজেলার দক্ষিণের রাস্তার কাজের সব ইটের খোঁয়া ভাঙ্গা হচ্ছে তারা নামের এক ইটভাটায়। এ সময় ভাটার ম্যানেজার মোঃ কওছার আলী বলেন, সাইদ সাহেব (ঠিকাদার) ৮০ হাজার ইট কিনে খোঁয়া ভাঙ্গাচ্ছেন। ইকবাল ও সালাম নামের দুই শ্রমিক জানান, নিন্মানের ইট ভাঙ্গছেন। তারা বলেন, মালিক ভাঙ্গালে তাদের কি করার আছে?
এসব ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার আবু সাঈদ বলেন, কোন ধরনের নিন্মমানের ইট—বালি ব্যবহার করা হয়নি।
এসব অনিয়ম—দুর্নীতি বিষয়ে উপজেলা প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার দাস দুদক’র অভিযানের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, কোন ধরনের অনিয়ম হয়নি। আর একটা কাগজের জন্য ঠিকাদারকে বঞ্চিত করা যায় না। অপর এক প্রশ্নের জবাবে মাহাতাবনগরের স্কুলের কাজ ১০/১২ দিনের মধ্যে শেষ হবে জানান।
এলজিইডির জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী শরিফুল ইসলাম বলেন, দুদক’র অভিযানসহ সার্বিক বিষয় উপজেলা প্রকৌশলী ভাল বলতে পারবেন। তিনি এ ব্যাপারে আর মন্তব্য করতে চাননি।