সমাজের কথা ডেস্ক : পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র সমাজের ডাকে ‘নবান্ন অভিযান’ ঘিরে মঙ্গলবার দুপুর থেকে রণক্ষেত্র পরিস্থিতি তৈরি হলো পশ্চিমবঙ্গে সচিবালয় এলাকায়। সকাল থেকেই একেবারে রণসজ্জায় ছিল পুলিশ। নবান্ন একেবারের দুর্গের চেহারা। জলকামান, টিয়ার গ্যাসের সেল তো বটেই, রাস্তায় গর্ত খুঁড়ে ব্যারিকেড ভেঙে ঢালাই করে দেওয়া হয়েছিল, আনা হয়েছিল বড় বড় কনটেইনার। বেলা সাড়ে বারোটার কিছুটা সময় পর থেকে মিছিল আসতে শুরু করে।
একটার পর থেকে পরিস্থিতি তপ্ত হতে থাকে। অ্যাকশন শুরু ১টায়। প্রথমে সাঁতরাগাছি, তারপর হাওড়া ব্রিজ। তপ্ত হতে থাকে পরিস্থিতি। পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে এগোতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। রীতিমতো ব্যারিকেড উপড়ে ফেলা হয়। পুলিশ ছুড়তে থাকে জল কামান, ফাটাতে থাকে টিয়ার গ্যাসের সেল। এ পর্যন্ত ছবিটা আর পাঁচটা নবান্ন অভিযানের মতোই। কিন্তু এরপর ক্যামেরায় ধরা পড়ে জাতীয় পতাকা হাতে এগিয়ে আসছেন দলে দলে আন্দোলনকারীরা। পুলিশ যখন জলকামান ছুড়ছে, তখনও পতপত করে উড়ছে জাতীয় পতাকা। আর সেটাই কার্যত ‘শেল্টার’!
একেবারে নবান্নের কাছাকাছি পৌঁছে যান আন্দোলনকারীরা। শেষ কবে কোনও রাজনৈতিক দলের নবান্ন অভিযান এতটা কাছাকাছি পৌঁছতে পেরেছে, তা বলা কষ্টকর, বলছেন রাজনীতির কারবারিরাই।
পশ্চিমবঙ্গ ছাত্রসমাজের আন্দোলনে এদিন দেখা গেলো বিভিন্ন বয়সের মানুষকে। তাদের কারোর হাতেই কোনও রাজনৈতিক পতাকা নেই। কেবল জাতীয় পতাকা। পুলিশ সেভাবে পুশ ব্যাক করতে বাধা দিতে পারছিল না, কারণ আন্দোলনকারীদের হাতে জাতীয় পতাকা।
কোনও কোনও জায়গায় আন্দোলনকারীদের জমায়েত হঠাতে সমর্থ হয় প্রশাসন। কিন্তু যতক্ষণে এক দিকের পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে, ঠিক উল্টো দিক থেকে আরও এক দল এগিয়ে আসতে থাকে। এক পক্ষকে সামলাতে গিয়ে যে তখনই অনেকটা কসরত করতে হয়েছে পুলিশকে। ফলে অপরপক্ষ এগিয়ে আসতে পেরেছে অনেকটাই।
বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, পিছু হটছে পুলিশই। আক্রান্ত হতে হয়েছে তাদেরই। হাওড়া ব্রিজে ইটের আঘাতে মাথা ফেটে যায় পুলিশের। পুলিশকে মাটিতে ফেলে লাঠিপেটা করা হয়, লাথি মারা হয়। আবার কখনও দেখা গেছে, আন্দোলনকারীরাই উদ্ধার করছেন আক্রান্ত পুলিশকে। একদিকে যখন আন্দোলনকারীদের সরাচ্ছে পুলিশ, তখন দেখা গেছে, অন্যদিক থেকে ভিড় এগোতে থাকে। ‘গ্রুপ করে করে’ কৌশল এগিয়ে এসেছেন আন্দোলনকারীরা, হাতে জাতীয় পতাকা।
হাওড়ার ফোরশোর রোড ক্রসিংয়ে ব্যারিকেড তৈরি করে আন্দোলনকারীদের রুখে দেওয়া হয়। কিন্তু ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন আন্দোলনকারীরা। তাদের ঠেকাতে জল কামান-কাঁদানে গ্যাস ও স্মোক বোম্ব চার্জ করে পুলিশ। সাময়িকভাবে পিছু হটলেও নতুন করে শুরু হয় মিছিল। হঠাৎ উত্তেজিত আন্দোলনকারীরা ফোরশোর রোড ক্রসিংয়ে কন্যাশ্রী পার্কে ব্যাপক ভাঙচুর শুরু করে। টিন দিয়ে ঘেরা ছিল পার্ক। সেই টিন ভেঙে ফেলে দেয়। পুলিশের বাধা টপকেই নবান্নমুখী হয় জনতা। তাদের রুখতে এখানেও জল কামান ছুড়তে শুরু করে পুলিশ। বিক্ষোভকারীদের হঠাতে লাঠি নিয়ে তেড়ে যায় তারা। ঘটনাস্থল থেকে আটক করা হয় বেশ কয়েকজনকে। নবান্নের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেলো বিক্ষোভকারীরা। ভিড় হটাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে দেখা গেলো পুলিশকে।
এদিন দুপুর তিনটা নাগাদ হাওড়ার চ্যাটার্জি হাটের দিকে থেকে প্রায় পাঁচশো লোককে এগিয়ে আসতে দেখা গেছে। নবান্নের উত্তর গেটের দিকে এগিয়ে যেতে দেখা যায় আন্দোলনকারীদের। উড়লো জাতীয় পতাকা। নবান্ন থেকে মাত্র একশ মিটার দূরেই তাদের আটকে দেয় পুলিশ। শুরু হয়ে যায় তুমুল ধস্তাধস্তি। লাগাতার মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে উঠতে থাকে স্লোগান।
তুমুল উত্তেজনা ছড়ায় সাঁতরাগাছিতেও। বেলা একটার কিছু আগে আন্দোলনকারীদের একটি দল নবান্নের দিকে ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করে। এই ঘটনা ঘিরে রীতিমতো রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় গোটা এলাকা। আন্দোলনকারীদের রুখতে সোমবার থেকেই রাস্তা খুঁড়ে ব্যারিকেড বসিয়েছিল পুলিশ। পাকাপোক্ত সেই ব্যারিকেডও উপড়ে ফেলেন আন্দোলনকারীরা। পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাথর ছুড়তে দেখা যায় তাদের। তবে তারা নবান্নমুখী হতেই লাঠি নিয়ে তাড়া করে পুলিশ।
নবান্ন অভিযান ঘিরে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয় হাওড়া ব্রিজেও। এখানে আন্দোলনকারীদের সামাল দিতে জল কামান ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটাতে শুরু করে পুলিশ। ধোঁয়া ও জলের তোড়ে কিছুটা ছত্রভঙ্গ হলেও পরক্ষণেই ফের এককাট্টা হয়ে ব্যারিকেড ভাঙতে উদ্যত হয় জনতা।
বুধবার পশ্চিমবঙ্গে ১২ ঘণ্টার ধর্মঘট ডাকলো বিজেপি। সাংবাদিক বৈঠক করে জানালেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। ছাত্রদের ওপর পুলিশি অত্যাচারের অভিযোগ। সাংবাদিক বৈঠকে বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হোক। নবান্ন অভিযানকে কেন্দ্র করে রণক্ষেত্র পরিস্থিতি হাওড়া ও কলকাতায়। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে তৎপর পুলিশ। চলছে লাঠিপেটা। কাঁদানে গ্যাস। জলকামান। আহত দু’পক্ষই। সব থেকে খারাপ পরিস্থিতি হাওড়া ময়দান, হাওড়া স্টেশন চত্বরে। একদিকে যেমন পুলিশ লাঠিপেটা করছে। পাল্টা আবার তাদের আটকাতে ইট ছুড়ছে ক্ষিপ্ত জনতা। প্রত্যেকের এক দাবি ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগ’।