নিজস্ব প্রতিবেদক : পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর নেশা ‘ডেভিলস ব্রেথ’ ব্যবহৃত হচ্ছে যশোরেও। এ নেশার মাধ্যমে ব্যক্তিকে হিপনোটাইজ বা বষীকরণ করে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে ‘শয়তানের নিঃশ্বাস’ নামের চক্রটি। এ চক্রের পাঁচ সদস্যকে গতকাল আটক করেছে পুলিশ। যাদের মধ্যে তিনজন ইরানী নাগরিকও আছেন।
জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) ও অভয়নগর থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে সিসি টিভির ফুটেজ দেখে ওই চক্রের ব্যবহৃত প্রাইভেটকারের নম্বর সংগ্রহ এবং জাতীয় সেবা ৯৯৯ নম্বরে পুলিশের সহযোগিতায় তাদের সনাক্ত করা হয়।
গতকাল সোমবার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে প্রেসব্রিফিং করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অসপ্) বেলাল হোসাইন সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান। এসময় ডিবির ওসি রূপণ কুমার সরকার ও অভয়নগর থানার এসআই বিমান তরফদার উপস্থিত ছিলেন। এদিনই অভয়নগর থানার একটি মামলায় তাদের আদালতে সোপর্দ করা হয়ছে।
আটককৃতরা হলো, ইরানের খরাজগহরদস্ত জেলার বল ইনগাভ কে. ইনফানিয়ারির ৬ নম্বর ব্লকের নাদের মাহবুবীর ছেলে খালেদ মাহাবুবী (৫৪), তার ছেলে সালার মাহবুবী (১৬), এবং রাজধানী তেহরানের বোলভার ও আজাদী এলাকার ৬ নম্বর রোডের ৩৫ নম্বর বাড়ির লতিফ মাসুফির ছেলে ফারিরোরয মাসুফি (৫৭)। বাংলাদেশের বরিশালের গৌরনদী উপজেলার পশ্চিম ডুমুরিয়া গ্রামের আব্দুল মান্নানের ছেলে সাইদুল ইসলাম বাবু (৩৫) ও গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার ঘ্যানাসুর গ্রামের মৃত সরোয়ার হোসেনের ছেলে খোরশেদ আলম (৫৩)।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বেলাল হোসাইন জানান, গত ৮ এপ্রিল অভয়নগর উপজেলার বর্নি হরিশপুর বাজারে যায় ওই প্রতারকচক্র। তারা বাজারের জালাল মার্কেটে শরিফুল ইসলামের মরিয়ম স্টোর নামক দোকানে যায়। আদের মধ্যে ফারিবোরয মাসুফি ওই দোকান থেকে নারিকেল তেল কেনার কথা বলে ভেতরে প্রবেশ করেন। নারিকেল তেল নিয়ে একটি মার্কিন ডলার দেন দোকানে থাকা শরিফুল ইসলামের পিতা শহিদুল ইসলামের মুখের কাছে নিয়ে যান। সাথে সাথে শহিদুল ইসলাম জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েন।
এরই মধ্যে দোকানের ড্রয়ারে থাকা ৬ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে চম্পট দেয় ওই চক্রটি। ১০ থেকে ১৫ মিনিট পরে স্বাভাবিক হন শহিদুল ইসলাম। কিন্তু তিনি ক্যাশ বাক্সের দিকে তাকিয়ে দেখেন সেখানে থাকা ৬ লাখ টাকা নেই। সাথে সাথে ছেলে শরিফুল ইসলামকে ফোন দিয়ে বিষয়টি জানান। শরিফুল ইসলাম বিষয়টি ৯৯৯ নম্বরে কল করে জানান।
ওই দোকানে এবং আশপাশের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসি ক্যামেরায়) ধরা পড়ে তাদের কাছে থাকা (ঢাকা মেট্রো-গ-২৭-৭০১১) প্রাইভেটকারটির নম্বর। চারিদিকে মোবাইল কল করে জানানো হয়। এই ঘটনায় গত ৫ মে অভয়নগর থানায় মামলা করেন শরিফুল ইসলাম। ডিবি পুলিশের সহায়তায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অভয়নগর থানার এসআই বিমান তরফদার প্রতারকচক্রের কাছে থাকা প্রাইভেটকারের মালিকের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করেন। পরে গত রোববার রাতে ঢাকা থেকে তাদের আটক করেন।
তবে প্রতারকচক্রের ব্যবহৃত প্রাইভেটকারের মালিক আটক খোরশেদ আলম বলে পুলিশের কাছে তারা স্বীকার করেছে। কিন্তু সাইফুল ইসলাম বাবু নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ঢাকার বনানী একটি আবাসিক হোটেলের কর্মচারির মাধ্যমে ভাড়া করে গাড়িটি।
উল্লেখ্য ২০০৯ সালে ফেসবুকের মাধ্যমে ফারিবুরযের সাথে সাইদুল ইসলামের পরিচয় হয়। তারপরই তিনি বাংলাদেশে আসেন।
প্রেসব্রিফিংয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরো জানিয়েছেন, আটককৃতরা আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্র। তারা বাংলাদেশ, নেপাল, ভারত ও ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশে ফাঁদ পেতে প্রতারনা করে থাকে বলেও প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পুলিশের কাছে তারা স্বীকার করেছে।
তবে আটকের পর তাদের কাছ থেকে রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো দুইটি তরল জাতীয় পদার্থ, মার্কিন ডলার, ভারতীয় রুপি, ইরান, ইরাক, নেপালি ও ভিয়েতনামের মুদ্রা এবং বাংলাদেশি টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়াতিনটি পাসপোর্ট, ৭টি মোবাইল ফোনসেট ও দুইটি পারফিউমড উদ্ধার করা হয়। তবে ওই পারফিউমড দিয়েই তারা মানুষকে হিপনোটাইজ করে টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরো জানিয়েছেন, ওই পারফিউম ব্যবহারে তাদের (প্রতারকচক্রের) কোন ক্ষতি হয় না। তাদের শরীরের এন্ট্রি চেতনানাশক দেয়া আছে। তারা খুলনায়ও একাধিক নারীর কাছ থেকে সোনার গহনাসহ মুল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে গেছে বলে তাদের কাছে সংবাদ আছে। বিষয়টি বাংলাদেশের বৈদেশিক বিভাগের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।
তিনি আরো বলেছেন, আসামি ফারিবোরযের পাসপোর্টে লাগানো ভিসার মেয়াদ দুই মাস আগেই শেষ হয়ে গেছে। গত জানুয়ারিতে তিনি বাংলাদেশে আসেন। বর্তমানে তিনি অবৈধভাবে বাংলাদেশের অবস্থান করছেন। তার বিরুদ্ধে আলাদাভাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া ৫জনের বিরুদ্ধে প্রতারনা মামলা হবে।
জানা গেছে প্রতারক চক্রের পারফিউমের নাম স্কোপোলামিন। এটি একটি হেলুসিনেটিক ড্রাগ। এটি হায়োসিন, ডেভিলস ব্রেথ, শয়তানের নিঃশ্বাস, বুরুন্ডাঙ্গা, রোবট ড্রাগ, জম্বি ড্রাগ বা কলম্বিয়ান ডেভিলের নিঃশ্বাস নামেও পরিচিত। এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রয়োজনীয় ওষুধের তালিকায় রয়েছে। রোগীকে অপারেশনের আগে অজ্ঞান করতে এটা ব্যবহার করা হয়।
এটি মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। এর প্রভাব এতটাই ভয়ংকর যে, কোনো ব্যক্তিকে সেকেন্ডেই নিজের নিয়ন্ত্রণে অনায়াসেই আনা যায়। অন্যের আদেশ পালন করতে বাধ্য করানোই হলো এ মাদকের মূলমন্ত্র। ভুক্তভোগীরা হেপনোটাইজ হয়ে অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যান।
নানাভাবে ও নানা কৌশলে এটি প্রয়োগ করা হয়। যেমন, হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে, ঘ্রাণের মাধ্যমে, খাবারের সঙ্গে, চিরকুটের মাধ্যমে, কোমল পানীয়র সঙ্গে, বাতাসে ফুঁ দিয়ে। স্কোপোলামিন তরল ও শুকনো দুই ফরমেটেই পাওয়া যায়। এ ড্রাগটি ৬ থেকে ১২ ইঞ্চি দূরত্ব থেকে শ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে, যার প্রতিক্রিয়া থাকে ২০ থেকে ৬০ মিনিট। খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ালে এর প্রতিক্রিয়া থাকে দু-তিন দিন।
মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণে শয়তানের নিঃশ্বাসের প্রভাবে স্কোপোলামিন বা শয়তানের নিঃশ্বাস শরীরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মস্তিষ্কের প্রাথমিক স্মৃতি ব¬ক হয়ে যায়। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি আক্রমণকারীকে দেখতে পেলেও চিনতে পারেন না এবং কিছু মনে রাখতে পারেন না। এর প্রভাবে শরীরে কোনো প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে না বা বাইরের কোনো আক্রমণে শরীর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর মতো অবস্থায়ও থাকে না।
এ অবস্থায় ভুক্তভোগীর আচরণ হয়ে যায় বশীভূত বা সুতায় বাঁধা পুতুলের মতো। তীব্র হেলুসিনেশন শুরু হয়। অন্যের দেওয়া আদেশকে যান্ত্রিকভাবে অনুসরণ করতে বাধ্য করে। মানে আপনি নিজে কিছু করতে পারবেন না, শুধু সামনের লোক যা বলবে তাই করবেন রোবটের মতো। ভয়ংকর এ সংস্পর্শে এলে ভুক্তভোগী নিজ ইচ্ছায় কোনো প্রতিবাদ ছাড়াই সবকিছু তুলে দেয় প্রতারকের হাতে।