সমাজের কথা ডেস্ক : ব্যাংক খাতে আমানত প্রবৃদ্ধিতে চলতি অর্থবছরে বেশ গতি এসেছে। একই সময়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রিও বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) ব্যাংকগুলোতে আমানত বেড়েছে ২৩ হাজার কোটি টাকা। আর গত এক বছরে বেড়েছে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। অন্যদিকে এ সময়ে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি প্রায় ১৪ গুণ বেড়েছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে ব্যাংক খাতে আমানত ও সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে এই গতির পেছনে চারটি কারণ চিহ্নিত করেছেন অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা। এগুলো হলো- আমানতের সুদের হার বৃদ্ধি, নির্বাচন সামনে রেখে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে মন্দা, ফ্ল্যাট ও প্লটের রেজিস্ট্রেশন ব্যয় বৃদ্ধি এবং বাসায় টাকা রাখার নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি। যদিও সম্প্রতি ফ্ল্যাট ও প্লটের রেজিস্ট্রেশন ব্যয় কিছুটা কমানো হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, গত জুলাই থেকে নতুন পদ্ধতিতে ঋণের সুদের হার নির্ধারণ করা হচ্ছে। এর পর ঋণের সঙ্গে আমানতের সুদের হারও বাড়তে শুরু করেছে। আবার নির্বাচন সামনে রেখে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা নতুন বিনিয়োগে ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। তাদের টাকা বিনিয়োগে ব্যবহার না হয়ে ব্যাংকে ঢুকতে পারে। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের বাজেটে ফ্ল্যাট ও প্লটের রেজিস্ট্রেশন খরচ বাড়ানো হয়েছে। ফলে মানুষ এসব জায়গায় টাকা না খাটিয়ে ব্যাংকে এফডিআর করে রাখছেন। আর সর্বশেষ হলো- বাসা-বাড়ি ও অফিস-আদালতে নগদ টাকা রাখা নিরাপদ নয়। চুরি-ডাকাতির ঝুঁকি থাকে। ফলে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেও মানুষ ব্যাংকেই টাকা রাখছেন।
একই ধরনের অভিমত দেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামও। তিনি বলেন, আমানত বৃদ্ধির মূল কারণ- এ খাতে সুদের হার আগের চেয়ে বেড়েছে। এখন তো আর নয়ছয় সুদের সীমাবদ্ধতা নেই। ফলে ব্যাংকগুলো আমানতে এখন ৬ শতাংশেরও বেশি সুদ দিতে পারছে। আরেকটি কারণ হলো- সামনে জাতীয় নির্বাচন। এ নির্বাচন সামনে রেখে নতুন বিনিয়োগে কেউ ঝুঁকি নিতে চাইছেন না।
জানা যায়, গত বছরের শেষ দিকে কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ অনিয়মের খবর জানাজানি হওয়ার পর ব্যাংক খাতের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়। এর পর সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো থেকে টাকা তুলে নিতে থাকেন গ্রাহকরা। আবার সেই সময় ব্যাংকগুলোতে নতুন আমানত আসাও কমে যায়। এতে ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার সংকট তৈরি হয়। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এতে জীবনযাত্রার খরচ বেড়েছে। কিন্তু একই সময় মানুষের আয় খুব একটা বাড়েনি। আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে ব্যাংকে আমানতের সুদের হার যেভাবে বাড়ার কথা সেভাবে বাড়েনি। এতে ব্যাংকে টাকা রেখে প্রকৃত অর্থে মুনাফা পাচ্ছিলেন না আমানতকারীরা। ফলে গত বছরের জুন থেকে চলতি বছরের জুনের মধ্যে মানুষের মধ্যে নগদ টাকা হাতে রাখার প্রবণতা ছিল অস্বাভাবিক। তবে চলতি অর্থবছরে এসে সেই প্রবণতা কমে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে- চলতি অর্থবছরের আগস্ট শেষে ব্যাংক খাতের আমানতের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ১৭ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের জুন শেষে ছিল ১৫ লাখ ৯৪ হাজার ৫৯০ কোটি টাকার। এ হিসাবে দুই মাসে আমানত বেড়েছে প্রায় ২৩ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে গত অর্থবছরের আগস্টে এ খাতে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৬৮ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা। ফলে গত এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে আমানত বেড়েছে প্রায় ১ লাখ ৪৯ হাজার ৩৮১ কোটি টাকা।
<< আরও পড়ুন >> পদ্মাসেতু’র এক বছর : যশোরের অর্থনীতিতে নতুন গতি
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত এক বছরে ব্যাংক খাতে আমানতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ১০ দশমিক ১৭ শতাংশ, যা গত জুনে ছিল ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। আর গত জুলাইতে ছিল ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অথচ গত বছরের ডিসেম্বরে আমানতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছিল মাত্র ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশে, যা ছিল ইতিহাসে এ যাবতকালের সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি।
এদিকে চলতি অর্থবছরের (জুলাই-আগস্ট) প্রথম দুই মাসে মানুষের হাতে থাকা অর্থের মধ্যে সাড়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকে ফিরেছে। গত জুন পর্যন্ত ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ ছিল (মানুষের হাতে) ২ লাখ ৯১ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা। আগস্টে সেটি কমে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫৮ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকায়।
কড়াকড়ির পরও সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে লাফ : গেল অর্থবছরজুড়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হোঁচট খেলেও চলতি অর্থবছরে এসে বেশ গতি পেয়েছে। সর্বশেষ আগস্ট মাসে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। এটি গত বছরের একই মাসের চেয়ে প্রায় ২৮৮ গুণ বেশি। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) নিট বিক্রি বেড়েছে প্রায় ১৪ গুণ বেশি। এ সময়ে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৫ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল মাত্র ৪০১ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে গত অর্থবছরের মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকা। তবে বিক্রিতে ভাটা পড়ায় সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৩২ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। কিন্তু গত অর্থবছরের সঞ্চয়পত্র বিক্রির চেয়ে বেশি ভাঙানো হয় প্রায় ৩ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা।