বিএম রুহুল কুদ্দুস শাকিল,সাড়াতলা(শার্শা,যশোর):
এই যশোরের মাটিতে ঘুমিয়ে আছেন সাত বীর শ্রেষ্ঠের একজন শহীদ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ। তিনি ও তাঁর ৬ সহযোদ্ধার সমাধিস্থলে একটি জাদুঘর তৈরির দাবি স্থানীয়দের। একই সাথে অবহেলিত সমাধি প্রাঙ্গণ নিয়মিত পরিচ্ছন্ন রাখা ও দেখভালে জন্যে একজন বেতনভুক্ত কর্মচারী নিয়োগেরও দাবি তাদের।
যশোর জেলা শহর হতে পশ্চিমে ৩০ কিলোমিটার দূরে সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম কাশিপুর। গ্রামটি শার্শা উপজেলার ডিহি ইউনিয়নে অবস্থিত। গ্রামটি বাঙ্গলার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের পাতাকে সমৃদ্ধ করেছে। এখানেই ছয় সহযোদ্ধা সিপাহী এনামুল হক, সিপাহী আব্দুস ছাত্তার, বাহাদুর গেরিলা, এমসিএ সৈয়দ আতর আলী, সুবেদার মনিরুজ্জামান ও আব্দুল আহাদসহ চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ।
সমাধিস্থলে সংরক্ষিত সংক্ষিপ্ত জীবনী হতে জানা যায়, ১৯৫৯ সালের ১৪ মার্চ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ তৎকালীন ইপিআর (বর্তমান বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, বিজিবি) এ যোগদান করেন। তিনি চাকরিরত অবস্থায় দিনাজপুর সেক্টর থেকে ১৯৭০ সালের ১ জুলাই যশোর সেক্টরে হেড কোয়ার্টারে বদলি হয়ে আসেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙ্গালীদের ওপর নির্যাতন, হত্যা আর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালালে স্থির থাকতে পারেননি তিনি। যশোর ৮ নং সেক্টরের অধীনে ৪ রাইফেল ব্যাটালিয়নে (ইপিআর এর সাবেক ৪র্থ উইং) বাঙ্গালী সেনাদের নিয়ে গঠিত কোম্পানিতে ৫ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যোগদান করেন। এ সময় তিনি কর্মস্থলে অফিসিয়ালি নৈমিত্তিক ছুটিতে ছিলেন। ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ ছুটিপুর-গোয়ালহাটি পাকহানাদার বাহিনীর ঘাঁটিতে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আক্রমণ করেন। তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে তুমুল লড়াই করছিলেন। ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখের পাশেই এলএমজি নিয়ে যুদ্ধরত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হন সহযোদ্ধা নান্নু মিয়া। তিনি গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হন। সাথে সাথে নান্নু মিয়াকে চিকিৎসার জন্যে অন্য যোদ্ধাদের তিনি সরিয়ে নিতে নির্দেশ দেন। আর নান্নুর অস্ত্র নিজ হাতে নিয়ে যুদ্ধ করতে থাকেন। তুমুল যুদ্ধের এক পর্যায়ে শত্রæ পক্ষের মর্টার শেলের আঘাতে আহতাবস্থায় নূর মোহাম্মদ শেখ পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। শত্রæ সেনারা নির্যাতন করে তার সমস্ত শরীর ক্ষতবিক্ষত করে। বেয়নেট দিয়ে ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখের দুইটি চোখ উপড়ে ফেলে হত্যা করে হানাদার বাহিনী। এই শহীদের মরদেহ সহযোদ্ধারা রণাঙ্গন থেকে নিয়ে সীমান্তবর্তী কাশিপুর গ্রামে সমাহিত করেন। পরে সিপাহী এনামুল হক, সিপাহী আব্দুস ছাত্তার, বাহাদুর গেরিলা, এমসিএ সৈয়দ আতর আলী, সুবেদার মনিরুজ্জামান ও আব্দুল আহাদ নামে স্বাধীনতা যুদ্ধে ছয় শহীদকে নূর মোহাম্মদ শেখের সমাধির পাশে কবর দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর এই বীরযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বীরশ্রেষ্ঠ সম্মানে ভ‚ষিত করা হয়।
স্থানীয় জায়েদা বেগম ও তার পরিবারের সদস্যরা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বীরশ্রেষ্ঠের সমাধি প্রাঙ্গণ তাদের পরিবারের সদস্যরা পর্যায়ক্রমে দেখভাল করে আসছে। জায়েদা বলেন, তিনি নিজে গত ৪-৫ বছর ধরে মাজার দেখভালসহ সপ্তাহে একদিন পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করছেন। একাজে কোনো পারিশ্রমিক পান না। তার অসুস্থ স্বামী সন্তানকে নিয়ে অভাবের সংসারেও দেশের স্বাধীনতা ও শহীদ বীরশ্রেষ্ঠসহ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ থেকে একাজ করছেন। তিনি জানান, তবে কষ্টের বিষয় হচ্ছে সমাধি প্রাঙ্গণ উন্মুক্ত থাকায় স্থানীয় ও বাইরে থেকে আগত দর্শনার্থীরা সমাধি দেখতে বা বেড়াতে গিয়ে অসম্মানিতসহ পরিবেশ নষ্ট করছে। আবার এখানে কোনো ওয়াশরুমের ব্যবস্থা না থাকায় আগতদের প্রকৃতির ডাকে স্থানীয়দের বাসাবাড়িতে যেতে হয়। স্থানীয়দের দাবি, সমাধির সৌন্দর্য ও পবিত্রতা রক্ষার্থে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, সর্বসাধারণের জন্য নির্দেশনামূলক সাইনবোর্ড, ওয়াশরুম-বাথরুমের ব্যবস্থা করার দাবি জানান। একই সাথে সরকারিভাবে নিয়মিত একজন বেতনভুক্ত দেখভাল ও পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিয়োগ কররও দাবি জানান।
স্থানীয় একাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধা দৈনিক সমাজের কথাকে বলেন, শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে অনন্য ভ‚মিকা রেখে গেছেন। অথচ স্বাধীন দেশে তারই সমাধিস্থল রয়েছে চরম অবহেলিত। আগামী প্রজন্ম ও সমাধিস্থলে আগত দর্শনার্থীদের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মাদসহ মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, রণাঙ্গনের ইতিহাস জানতে হবে। তাই, এর রক্ষণাবেক্ষণ করে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখের সমাধিস্থলে একটি স্মৃতি জাদুঘর গড়ে তোলার দাবি জানান মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয়রা।