নিজস্ব প্রতিবেদক : মহাকালের কৃষ্ণগহ্বরে হারিয়ে গেলো বঙ্গাব্দ ১৪২৯। আজ শুরু হলো নতুন বর্ষ ১৪৩০। পুরাতনকে বিদায় দিয়ে নববর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত যশোর। করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) করাল গ্রাস মোকাবেলায় গত দুই বছর গৃহবন্দী থাকার পর গতবছর সংক্ষিপ্ত পরিসরে হয়েছিল উৎসব আয়োজন।
এবার করোনা ভীতি না থাকায় ধর্ম-বর্ণ ধনী-গরিব নির্বিশেষে মিলবে মিলন মেলায়। তাই বর্ণাঢ্য আয়োজনে উৎসব উদযাপন প্রস্তুতি নিয়েছে যশোরের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। তবে পহেলা বৈশাখের দু’দিন আগে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সুকুমার দাসের প্রয়াণে শোকের আবহে নববর্ষ বরণ করবে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। সকল উৎসব আয়োজন উৎসর্গ করা হয়েছে সুকুমার দাসের প্রতি।
করোনাকাল পেরিয়ে এবার পুরো উদ্যমে বাংলা নতুন বর্ষ ১৪৩০কে বরণ করে নিতে প্রস্তুত যশোর। পুরাতনকে বিদায় দিয়ে নববর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখকে স্বাগত জানাতে ধর্ম-বর্ণ ধনী-গরিব নির্বিশেষে মিলবে মিলন মেলায়। তাই বর্ণাঢ্য আয়োজনে উৎসব উদযাপন প্রস্তুতি নিয়েছে যশোরের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। বিশেষ করে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের অন্যতম অনুসঙ্গ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। এখন মঙ্গল শোভাযাত্রা ছাড়া বাংলা নববর্ষ উৎসব কল্পনা করা যায় না।
সারা দেশের এই মঙ্গল শোভাযাত্রার সূতিকাগার সাংস্কৃতিক রাজধানী খ্যাত ঐতিহ্যের শহর যশোরে। আর আজ এই মঙ্গল শোভাযাত্রার পরিচিতি ছড়িয়ে গেছে বিশ্বময়। ইউনেস্কোও দিয়েছে এঁকে ঐতিহ্যের স্বীকৃতি। প্রতিবছরের মত এবারও পহেলা বৈশাখের সকালে মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্যে দিয়ে নববর্ষকে বরণ করে নেবে যশোর তথা গোটা দেশবাসী।
নববর্ষ উদযাপনের অন্যতম অনুসঙ্গ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। সারাবিশ্বের বাঙালিরা নেচে গেয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রায় উদ্যাপন করেন পহেলা বৈশাখ। ইউনেস্কোর ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’ স্বীকৃতি পাওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রার শুরু হয়েছিল যশোর থেকেই।
সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো জানিয়েছে, এবছর পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে বিকেলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থাকছে না। তবে বাংলা নববর্ষের প্রথম প্রহরে বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ যশোরের সাংস্কৃতিক সংগঠনের আয়োজনে শহরের বিভিন্ন স্থানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বসবে মানুষের মিলন মেলা। তবে মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ সকল আয়োজনে থাকবে প্রয়াত সুকুমার দাসের ব্যানার-প্রতিকৃতি। তাঁকে উৎসর্গ করেই সব আয়োজন সম্পন্ন হবে।
শুক্রবার পহেলা বৈশাখ নতুন বছরে সূর্যোদয়ের পরপরই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ঐতিহাসিক টাউন হল ময়দান থেকে সকাল ৯টায় বের হবে বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা। যশোর জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে জেলা প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় হবে এ শোভাযাত্রা।
যশোরের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কর্তাব্যক্তিরা জানান, বাংলা বর্ষবরণে যশোরের ঐতিহ্য পাঁচ দশকের। করোনা সংক্রমণের কারণে ১৪২৭ ও ২৮ এই দুই বছর নববর্ষের উৎসব ছিল অনেকটা ঘরবন্দি। ১৪২৯ সনে সংক্রমণ কমলেও রমজান মাসে হওয়ায় সংক্ষিপ্ত পরিসরের উৎসব আয়োজন করা হয়। এবারও রমজানে উপলক্ষে দুপুরের মধ্যেই সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষ করার নির্দেশনা রয়েছে জেলা প্রশাসনের। তারপরও পহেলা বৈশাখে বর্ণিল সাজে ঢাক-ঢোলের বাদ্যে মাততে প্রস্তুত সংগঠনগুলো। যশোরের ৩০টির বেশি সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রায় ৫০০ সাংস্কৃতিক কর্মী উৎসবকে সামনে রেখে প্রস্তুতি নিয়েছেন।
মঙ্গল শোভাযাত্রার সূতিকাগার যশোরের চারুপীঠ আর্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট। মঙ্গল শোভাযাত্রার নৌকা, দোয়েল, কচ্ছপ, বড় আকৃতির সাপ, কুমির, বাঘ, পুতুলসহ নানা রঙের মুখোশ তৈরি করেছেন চারুশিল্পীরা। জেলার চারুপীঠ আট রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং চারুতীর্থের শিল্পীদের তুলির রঙিন আঁচড়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে শোভাযাত্রার এসব অনুসঙ্গ। এছাড়া রং তুলিতে আল্পনা আঁকা হয়েছে সংগঠনগুলোর আঙিনায়।
চারুপীঠের সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশিদ বলেন, ‘দেশে মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা হয় ১৯৮৫ সালে যশোরে। সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী মাহবুব জামাল শামীম দুই সহপাঠীকে নিয়ে যশোরে প্রতিষ্ঠা করেন চারুপীঠ। এই প্রতিষ্ঠানই মঙ্গল শোভাযাত্রার সূতিকাগার। এর চার বছর পরই ঢাকায় মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়, যা পরে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পায়। সামনে নববর্ষ উপলক্ষে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। বিশেষভাবে উপস্থাপনের জন্য শোভাযাত্রার নৌকা, দোয়েল, কচ্ছপ, বড় আকৃতির সাপ, কুমির, বাঘ, পুতুলসহ নানা রঙের মুখোশ তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবারেই ন্যায় এবারও জাতি বর্ণ ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাবো।
বরাবরের মত পৌর উদ্যানে সকাল ৭টা ১ মিনিটে উদীচী যশোরের আয়োজনে হবে প্রায় আড়াই ঘণ্টার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদুর রহমান খান বিপ্লব জানান, উদীচী হত্যাকা-ের দুই যুগ পেরিয়ে গেলেও বিচার না হওয়ায় এবারের নববর্ষ উৎসব স্লোগান করা হয়েছে- ‘বৈশাখের এই তীব্র দহনকাল-ছিন্ন করুক বিচারহীনতার জাল’। স্লোগানের সাথে মিল রেখে আমন্ত্রণ পত্রে ব্যবহার করা হয়েছে মিছিলের প্ল্যাকার্ড-পোস্টার। বাঁশের চাটাইয়ের উপর লালকাগজে সাদা রঙে লেখা হয়েছে আমন্ত্রণপত্র।
উদীচী হত্যাকা-ের বিচার কার্যকর করার আহ্বান জানিয়ে যশোরবাসীকে আনন্দে মাতিয়ে দেবে যশোরে ‘নববর্ষ উৎসবের পথিকৃৎ’ উদীচী যশোর। এছাড়া শিশু-কিশোরসহ প্রায় তিনশ’ সংগীত, নৃত্য ও অভিনয় শিল্পী বৈচিত্র্যময় নানা আয়োজনে নববর্ষ উৎসবের ৪৮ বছরে পা রাখছে এ সংগঠন। সংগঠনের সব শিল্পীর মৌলিক পোশাক এ অনুষ্ঠান বর্ণিল করে তুলবে। যা বাস্তবায়নে ব্যস্ত সময় পার করছে সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও কলাকুশলীরা।
তির্যক যশোরের সাধারণ সম্পাদক দিপাঙ্কর দাস রতন বলেন, ‘নববর্ষকে ঘিরে যশোরের যে ঐতিহ্য নিমন্ত্রণপত্র সেটি ইতোমধ্যে বিলি করা শুরু করেছি। এবার আমাদের নিমন্ত্রণপত্র হলো বাঙালির ঐতিহ্য চরকা। নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে অর্ধশতাধিক কর্মী নিয়ে তারা নাচ, গান কবিতা আবৃত্তির প্রস্তুতি নিয়েছে।
যশোরের সবচেয়ে পুরোনো সাংস্কৃতিক সংগঠন সুরবিতান সংগীত একাডেমি যশোরের উদ্যোগে সকাল সাড়ে ছয়টায় ঐতিহাসিক টাউন হল ময়দানের শতাব্দী বটমূলের রওশন আলী মঞ্চে ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও’ স্লোগানকে সামনে রেখে নববর্ষকে আহ্বান জানানো হবে। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব বিশ্বাস জানান, ‘প্রতিবছরের মত এবারও ভিন্ন আঙ্গিকে বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানানো হবে। শিল্পকলা একাডেমি সকাল ৭টায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। বিবর্তন যশোরে সকাল ৭টায় সংগঠন চত্বরে আবৃত্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন নিজস্ব বলয়ে সাংস্কৃতিক আয়োজনে নববর্ষকে বরণ করবে।