সমাজের কথা ডেস্ক : ১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১। এদিন অকুতোভয় তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকায় ঢুকে পড়ে। নিরস্ত্র জনতা রাস্তায় নেমে আসে। তাদের রক্তে শুধু সশব্দ গর্জন। পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে লড়ছে, মরছে তবুও প্রতিশোধ চাই মা, বাবা ও সন্তান হারানোর প্রতিশোধ। আকাশ, জলে—স্থলে সবদিকে হানাদাররা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ায় জেনারেল নিয়াজি রাওয়ালপিন্ডিতে আরজি পাঠান, ‘আরও সাহায্য চাই।’
একাত্তরের এই দিন চারদিকে উড়তে থাকে বাঙালির বিজয় নিশান। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় শত শত পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে। শুধু ময়নামতিতেই আত্মসমর্পণ করে এক হাজার ১৩৪ জন। আর সৈয়দপুরে আত্মসমর্পণ করে ৪৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়কসহ ১০৭ পাকিস্তানি সেনা। খুলনা, বগুড়া ও চট্টগ্রামে হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনী ও স্থানীয় মানুষের অবিরামযুদ্ধ চলে। মুজিবনগরে তখন চরম উত্তেজনা।
এদিন থেকে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্টুডিওতে বসে বার্তা বিভাগীয় প্রধান কামাল লোহানী, আলী যাকের ও আলমগীর কবির ঘন ঘন সংবাদ বুলেটিন পরিবর্তন ও পরিবেশন করেন। প্রতি মুহূর্তে খবর আসছে— ঢাকা ছাড়া বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা মুক্ত।
এদিন যুদ্ধ জয়ের নিশ্চয়তা জেনেই বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘের যেসব কর্মী, কূটনৈতিক, প্রতিনিধি ও বিদেশি নাগরিক নিরাপদে সরে আসতে চান বাংলাদেশ সরকার তাদের সম্ভাব্য সব ধরনের সুযোগ—সুবিধা দেবে।’
এ দিন শান্তি কমিটি, গভর্নর ডা. মালিক মন্ত্রিসভা ও স্বাধীনতাবিরোধী দালালরা তৎকালীন গভর্নর হাউসে জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে বৈঠক চলাকালে মিত্রবাহিনীর বিমান গভর্নর হাউসে বোমাবর্ষণ করে— গভর্নর ডা. মালিক তখনই পদত্যাগ করেন এবং মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে রেডক্রসের গাড়িতে করে নিরপেক্ষ এলাকা বলে ঘোষিত হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এসে আশ্রয় নেন।
এদিনে পূর্ব ও উত্তর দিক থেকে মিত্রবাহিনী ঢাকার প্রায় ১৫ মাইলের মধ্যে পৌঁছে যায়। অকুতোভয় তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকায় ঢুকে পড়ে। ৫৭ নম্বর ডিভিশনের দুটো ব্রিগেড এগিয়ে আসে পূর্বদিক থেকে। উত্তর দিক থেকে আসে জেনারেল গন্ধর্ব নাগরার ব্রিগেড এবং টাঙ্গাইলে নামা ছত্রীসেনারা। পশ্চিমে ৪ নম্বর ডিভিশনও মধুমতি পার হয়ে পৌঁছে যায় পদ্মার তীরে।
রাত ৯টায় মেজর জেনারেল নাগরা টাঙ্গাইল আসেন। টাঙ্গাইলে মেজর জেনারেল নাগরা মুক্তিবাহিনীর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা যদি আমাদের বিনা বাধায় এতটা পথ পাড়ি দিতে সাহায্য না করতেন, তাহলে আমাদের বাহিনী দীর্ঘ রাস্তায় যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ত। পথে পথেই আমাদের অনেক শক্তি ক্ষয় হয়ে যেতো।’
এদিন মুক্তি—মিত্রবাহিনী জয়দেবপুর, টঙ্গী ও সাভার হয়ে ঢাকার উপকণ্ঠে এসে উপস্থিত হয়। লে. কর্নেল শফিউল¬াহর ‘এস’ ফোর্স ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়ে ঢাকার উপকণ্ঠে ডেমরা পৌঁছায়। যৌথ বাহিনীর অগ্রবর্তীসেনাদল শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী অতিক্রম করে ঢাকার ৫—৬ মাইলের মধ্যে পৌঁছে যায়। বাংলাদেশের নিয়মিত বাহিনীর সর্বপ্রথম ইউনিট হিসেবে ঢাকার শীতলক্ষ্যার পূর্বপাড়ে মুরাপাড়ায় পৌঁছায়। বাসাবো ও খিলগাঁও এলাকার চারদিকে আগে থেকেই পাকিস্তান বাহিনী ফিল্ড ডিফেন্স বা আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থাসহ অবস্থান নেয়। কিন্তু ঢাকার আকাশ মিত্রবাহিনীর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে থাকায় পাকিস্তানি বাহিনী তেমন সুবিধা করতে পারেনি। মিত্রবাহিনী পাকিস্তানী সামরিক অবস্থানের ওপর তীব্র বিমান আক্রমণ চালায়। অবস্থা বেগতিক দেখে জেনারেল নিয়াজি বোমাবর্ষণ বন্ধ রাখার জন্য ভারতের জেনারেল মানেকশ’র প্রতি আহ্বান জানান।
এ বিষয়ে জাতীয় সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধা ফাউন্ডেশনের মহাসচিব মুক্তিযোদ্ধা জি.কে বাবুল বলেন, ‘আমি মেজর হায়দার আলী ও গিয়াস উদ্দিন বীর প্রতীকের নেতৃত্বে ২ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করি। আমি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়ে আমার মাথায় গুলি লাগে। তবে আমি গর্ববোধ করি আমি দেশের জন্য লড়াই করেছিলাম।’
১৩ ডিসেম্বর কি ঘটেছিলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘১৩ ডিসেম্বর আমরা নারায়ণগঞ্জ ক্যাম্পে ছিলাম। এদিন সকালে মেসেজ এলো মেঘনার পাড় থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী আসবে, আর তাদেরকে আমাদের রিসিভ করতে হবে। এদিন আমরা পুরো বন্দর থানা ঘেরাও করে রেখেছিলাম। আর এই বন্দর থানার নেতৃত্ব দেন গিয়াস উদ্দিন বীর প্রতীক। তার নেতৃত্বে আমরা পাকিস্তানি ৩৯জন সেনাবাহিনীকে এদিন হত্যা করি। এরপর আমরা বন্দর স্বাধীন করি। অতপর আমরা অপেক্ষা করি ভারতীয় সেনারা কখন আমাদের কাছে রিপোর্ট করবে।’
তিনি সেদিনের স্মৃতিচারণ করে আরও বলেন, ‘এদিন মেজর হায়দার ২—৩টি গ্র“প নিয়ে রূপগঞ্জে প্রবেশ করে ডেমরা দিয়ে। আর এদিন ঢাকা শহরের চারপাশ পুরো মুক্তিযোদ্ধার ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডারদের আওতায় যারা যুদ্ধ করে তারা ঘেরাও করে রাখে। লক্ষ্য একটাই ঢাকাকে মুক্ত করা। চারিদিক দিয়ে ঢাকাকে ঘেরাও করে রাখা হয়। অপরদিকে টাঙ্গাইল থেকে প্যারাসুট বাহিনী নিয়ে কাদের সিদ্দিকী তার বাহিনী নিয়ে ঢাকার দিকে আসতে থাকে। চতুর্দিক দিয়ে ১৩ তারিখ ব¬ক করে রাখা হয়। এরপর পাক বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তারা রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে। এভাবেই শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীদের আত্মসমর্পণ।’