১৫ই ফেব্রুয়ারি ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২রা ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
কতটা বিষমুক্ত বাজারের সবজি
বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত সব সবজিতেই দেয়া হয় কীটনাশক


তহীদ মনি : বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত কোন সবজিই বিষমুক্ত নয়। কোথাও কোন কৃষক বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনও করেন না। সবজি ক্ষেতে সব কৃষকই বিষ দেন, কেউ কম আর কেউ বেশি। এ বাস্তবতা জেনেই বাজার থেকে বিষযুক্ত সবজি কিনছেন সবাই। জেনে বুঝেই সচেতন-অসচেতন সবাই একাজ করছেন। তাই প্রতিরোধ ও প্রতিকারেরও কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। বিষ থাকার বিষয়টি মেনে নিয়েই সবজি কাটার পূর্বে ভালোভাবে ধুয়ে নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগ।

খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, ক্রেতাদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকে পোকামুক্ত সবুজ সবজি। এ ধরনের সবজি উৎপাদনে কী পরিমাণ বিষ ছিটানো হয় তা কৃষকরা খুব ভালোই জানেন। তবে জানে না, কোন কীট নাশকের বিষক্রিয়ার মেয়াদ বা কার্যকাল কত দিন থাকে? কৃষকরা শুনে শুনে কার্যকারিতা জেনে বিষ প্রয়োগ করেন। মাত্রা বা বিষক্রিয়া সম্পর্কে তারা তেমন কিছুই জানেন না ।

তাদের চিন্তায় থাকে পোকামুক্ত সবজি উৎপাদন। তারা যখনই ক্ষেতে পোকার আক্রমণসহ অন্যান্য রোগবালাই দেখেন, তখনই কীটনাশক হিসেবে বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন কোম্পানির বিষ বা কীটনাশক প্রয়োগ করেন। সপ্তাহে একবার প্রয়োগে কাজ না হলে একাধিকবারও দেন। বেগুন চাষে কেউ কেউ একদিন পর পর কীটনাশক স্প্রে করেন। অথচ বাজারে পাওয়া সব চেয়ে কম ক্ষতিকারক কীট নাশকের কার্যকাল সর্বনি¤œ এক সপ্তাহ।

কোনো কোনো কীটনাশকের ক্রিয়াকাল ৩ সপ্তাহের অধিক বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। কৃষকরা এটা না জেনেই ফসলে বিষ প্রয়োগ করেন আর প্রয়োগের পরদিনই ঐ ফসল বাজারে তোলেন। বাজার থেকে সেই সবজিই সবাই কিনে নিয়ে যান। যশোর সদর উপজেলার কোদালিয়া অঞ্চলের কৃষক মোহন জানান, তিনি ১০-১২ বিঘা জমিতে বিভিন্ন প্রকার কপি লাগিয়েছিলেন। সে কপি তুলে এখন আলু চাষ করেছেন। তার বিঘা খানেক জমিতে বেগুন চাষ ছিল। বেগুন চাষে নিয়মিত এবং সময় মতো কীটনাশক স্প্রে না করলে ফলন পাওয়া যায় ন।

এক বিঘা জমিতে বেগুন চাষে সাধারণত ২৫-৩০ হাজার টাকা ব্যয় হয়। এই ব্যয়ের বেশিরভাগই সার ও কীটনাশকের জন্য হয়ে থাকে। সপ্তাহে ২ থেকে ৩ বার ক্ষেতে কীটনাশক স্প্রে করা লাগে। তিনি জানান, অন্যান্য সবজি-তরকারির চেয়ে বেগুনে শক্তিশালী কীটনাশক প্রয়োগ করা লাগে। এরপরও পোকার আক্রমণ বেশি থাকলে ঘন ঘন স্প্রে করতে হয়। তিনি সিনজেন্টা কোম্পানির সবিক্রন, প্রাক্সি জাতীয় বিষ বেগুন ক্ষেতে ব্যবহার করেন।

আর কপিতে সেঞ্চুরি কোম্পানির বিসলি, সেনবেন বা আম্ফান জাতীয় কীটনাশক ব্যবহার করেন। এ সব কীটনাশক কোম্পানির প্রতিনিধিদের পরামর্শে বা দোকানদারের পরামর্শেই বেশি কেনেন। কখনো কখনো ব্লক

সুপারভাইজাদের কথামতোও কেনেন। কৃষক মোহন বলেন, যখন তার ক্ষেতে বেগুন থাকে না, তখন তিনি নিজে বেগুন কেনেন না। তার ভাষায়,‘ আমরা তো জানি বেগুন উৎপাদন করতে কতটা বিষ দিতে হয়, সেটা খাওয়া আমাদের জন্যেই বিপজ্জনক। তাই বাজার থেকে আমি বেগুন কিনে খাই না।’ তিনি বলেন, ‘শীত বেশি হলে বেগুনে স্প্রে কম করতে হয় বা একটু কম শক্তির কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। কিন্তু একটু গরম পড়লে কীটনাশকের ব্যবহার না বাড়ালে সে বেগুনে টাকা আসবে না।’

তার মতো প্রায় একই ধরনের কথা বলেন, করোলা চাষি মনিরুজ্জামান এবং সবজি চাষি আব্দুল মান্নান। তারা জানান, সবজি চাষে প্রচুর খরচ। খরচ ওঠাতে গেলে ফসল ভালো করতে হয়, ভালো ফসল না হলে ভালো দাম পাওয়া যায় না। আর এ জন্য প্রয়োজন সার ও কীটনাশকের ব্যবহার।

বিষমুক্ত সবজি আন্দোলনের একজন কৃষক নাম প্রকাশ না করে জানান, ‘একটি গুলি দিয়ে একজন মানুষকে সহজে মারা যায় কিন্তু বিষযুক্ত সবজি খাওয়ায়ে প্রতিদিন শত শত মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে’। তিনি আরও জানান, ‘বাজারে বাহারি সব ফল ও সবজি দেখা যায়। এ সবজি উৎপাদন করতে কৃষকরা অনেক কষ্ট করেন। তবে অবশ্যই এই প্রতিযোগিতায় টিকতে তাদের অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয় এবং অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। এই অতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের জন্যে কতটা ক্ষতিকর তা প্রত্যেকটি ডাক্তারের চেম্বারে গেলে বোঝা যায়। নানাবিধ রোগ নিয়ে প্রতিদিনই মানুষ আসছে চিকিৎসকের কাছে। আপত দৃষ্টিতে যাই মনে হোক, প্রতিনিয়ত খাবারের সাথে যে বিষ যাচ্ছে এটা তার দীর্ঘস্থায়ী কুফল।’

তার সাথে যশোরের রাজাপুর, কোদালিয়, লেবুতলা এলাকার অনেক কৃষকই একই মত পোষণ করেন কিন্তু এর থেকে ভোক্তাদের সহসা মুক্তির কোনো পথও নেই বলে তারা মত দেন। অনেকেই মনে করেন এটা দেখারও কেউ নেই।

যশোর বাজারের ক্রেতা তুহিন, সাব্বির ও রহমান জানান, তরকারি ছাড়া কোনো কিছুই তো খাওয়া হয় না। চুড়ামনকাটিতে সবজি ক্ষেতে তারা বিষ দিতে দেখেন তবুও খাবারের জন্যে পছন্দনীয় বেগুন করোলা ও শাক-সবজি কিনতে হয় । তাদের মতে, ‘বিষতো সরাসরি ক্ষতি করছে না আর এর প্রতিকারও সরকারিভাবে বা কৃষি বিভাগ কেউ করছে না। আমরা তো ভালো ও টাটকা দেখে কিনে নিয়ে যাচ্ছি।’

বিষক্রিয়ার বিষয়ে জেলার ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. নাজমুস সাদাত রাসেল বলেন, বিষক্রিয়া প্রতিরোধে ভালোভাবে ফল বা সবজি ধুয়ে খেতে হবে, বাজার থেকে এনেই কোন সবজি সে দিনই না খাওয়া ভালো, তাতে বিষক্রিয়া কিছুটা কমবে। তিনি সর্বস্তরে সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়ে বলেন, বিষের নির্দিষ্ট মেয়াদ আছে প্রয়োগ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে ওই নির্দেশনা মানতে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বাজার মনিটরিংসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে বিষাক্ত ফল-সবজি বাজারজাত বন্ধ করতে হবে। এ সব তরিতরকারি ও ফল খাওয়ার পর যে বিষ শরীরের যায় তার দুটো ক্রিয়া রয়েছে। তাহলো , একটা অ্যাকুইট ও অন্যটি করোনিক। কোনো কোনোটা স্থায়ী নানাবিধ রোগের জন্ম দেয়, কোনোটা কম স্থায়ী রোগের সৃষ্টি করে।

যশোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মঞ্জুরুল হক বলেন, এটি দেখার কিছু দায়িত্ব কৃষিবিভাগের রয়েছে। এছাড়া প্রশাসন, বাজার মনিটরিং কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট বিভাগ এবং বিএসটিআইয়ের দায়িত্ব রয়েছে । তিনি জানান, বাজারে প্রচলিত ফসলের বিষের ক্ষেত্রে তার বোতলের গায়ে ৩ ধরনের সতর্ক চিহ্ন রয়েছে। রেড মার্ক করা বিষ কমপক্ষে ৩ সপ্তাহ কার্যকরী থাকে, ইয়েলো মার্ক করা কীটনাশক ২ সপ্তাহ এবং গ্রিন মার্ক করা বোতলের কীটনাশক এক সপ্তাহের অধিক কার্যকরী নয়। এই মেয়াদকাল পার হলে প্রয়োগকৃত বিষ মানব শরীরে কোনো প্রতিক্রিয়া বা রোগের সৃষ্টিকারী হয় না। তবে তিনি স্বীকার করেন, কৃষকরা অনেক সময় নির্দেশনা অমান্য করে ফসল বাঁচাতে কীটনাশক প্রয়োগ বেশি করেন বা শক্তিশালী কীটনাশকও প্রয়োগ করে থাকেন।

এগুলো দেখার কি কেউ নেই? এমন প্রশ্নের জবাবে জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খান জানান, প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান চালনো হয়, জরিমানা করা হয় তবে সব সময় হয়ে ওঠেনা। কৃষি বিভাগ, খাদ্য ও বাজার কর্মকর্তারা আরও উদ্যোগী হলে এবং সচেতনা সৃষ্টি করতে পারলে এই ভাবে বিষ ক্রিয়ার শিকার হওয়া থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।

সম্পাদক ও প্রকাশক : শাহীন চাকলাদার  |  ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আমিনুর রহমান মামুন।
১৩৬, গোহাটা রোড, লোহাপট্টি, যশোর।
ফোন : বার্তা বিভাগ : ০১৭১১-১৮২০২১, ০২৪৭৭৭৬৬৪২৭, ০১৭১২-৬১১৭০৭, বিজ্ঞাপন : ০১৭১১-১৮৬৫৪৩
Email[email protected]
পুরাতন খবর
FriSatSunMonTueWedThu
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28 
স্বত্ব © samajerkatha :- ২০২০-২০২২
crossmenu linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram