হুমায়ুন কবির, বাঘারপাড়া (যশোর) : বৃহস্পতিবার রাত থেকেই বদলে গেছে যশোরের বাঘারপাড়া ও নড়াইলের ১১খান এলাকার বাকড়ী। বাড়িতে বাড়িতে চলছে মাতম। পিকনিক ফেরত শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কেউ হারিয়েছেন প্রাণ, কেউ হাসপাতালে বসে কাতরাচ্ছেন যন্ত্রণায়। বাকিরা আছেন আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠায়। নিহত সুদীপ্ত বিশ্বাস ও বিদ্যুৎ বিশ্বাসের বাড়ি ঘর লোক। কারো কাছে নেই সান্ত¡নার ভাষা। কেউ কেউ কেঁদে কেঁদে শোনাচ্ছেন দুর্ঘটনার কাহিনী। শুধু বাকড়ী নয় একই চিত্র দোগাছি, হাতিয়াড়া, মালিয়াট, বেনাহাটি ও কমলাপুরে।
শুক্রবার সকাল ৯টায় দোগাছি গ্রামের সুদীপ্ত বিশ্বাসের বাড়িতে ঢল নামে সাধারণ মানুষের। বাড়ির উঠোনে শুধু মানুষ আর মানুষ। দুরের কাছের আত্মীয়দের আহাজারীতে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠে। স্বজনহারাদের সান্ত¡না দিতে গিয়ে প্রতিবেশীদের চোখও ভিজে যাচ্ছিল। বিয়ের পিড়িতে বসার কথা ছিলো ছেলেটির। এসব নিয়েই বিলাপ করছিলেন নিহতের মা মিনতি রানি ভৌমিক। শুক্রবার দুপুরে ঠাকুরদা ও ঠাকুমার সমাধির পাশে সমাহিত করা হয় সুদীপ্তের মরদেহ।
অন্যদিকে বাকড়ী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অভিভাবক সদস্য বিদ্যুৎ বিশ্বাসের বাড়িতে এ সময় চলছিলো সুনসান নিরবতা। তাঁর শেষকৃত্য স্থানীয় শ্মশানে সম্পন্ন হয়েছে। বিদ্যুৎ বিশ্বাস বাকড়ী গ্রামের মৃত গোকুল বিশ্বাসের ছোট সন্তান।
দুর্ঘটনায় বেঁচে ফেরা আহত ৮ম শ্রেণির ও ৯ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সিমান্ত বিশ্বাস, রাজদীপ বিশ্বাসসহ একাঠিক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা সন্ধ্যায় বাস নিয়ে রওনা হই। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার বরাশুতে আসলে আমাদের বাসটি সামনের বাসের চাকার সাথে ধাক্কা লেগে সড়কের পাশের গাছের সাথে ধাক্কা খায়। দুমড়ে মুচড়ে যায় বাসটি। বাঁচাও বাঁচাও বলে কান্নাকাটি করতে থাকে সবাই। এসময় যাঁদের হুস ছিলো তাঁরা কেউ কেউ বাসের দরজা বা জানালা দিয়ে বাইরে লাফ দেয়। বাসের পিছনে বসা যাত্রীরা সামনের যাত্রীদের সাথে একাকার হয়ে পড়ে। এসময় জানালার কাঁচে অনেকের শরীরের বিভিন্ন স্থান কেটে যায়।
বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানিয়েছে, গত বৃহস্পতিবার (০৯ ফেব্রুয়ারি) সকাল আটটায় উপজেলার বাকড়ী বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা তিনটি যাত্রীবাহী বাস নিয়ে শিক্ষা সফরে বের হয়। তিনটি বাসে শিক্ষক কর্মচারী অভিভাবক সদস্য শিক্ষার্থী মিলে ১’শ ৬৩ জন যাত্রী নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সমাধিস্থল টুঙ্গিপাড়ার যাত্রা শুরু করে। এদিন তারা বঙ্গবন্ধুর সমাধিস্থল টুঙ্গিপাড়ার বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন ও দুপুরের খাবার শেষে সন্ধ্যা ছয়টায় বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে।
আগে পিছে চলা তিনটি বাস সন্ধ্যা ৭টায় গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি উপজেলার ভাটইপাড়া এলাকায় পৌঁছালে মাঝখানের বাসটি সামনের বাসকে ওভারটেক করার চেষ্টা করে। এ সময় সামনের বাসের সাথে পেছনের বাসের ধাক্কা লাগে। পেছনের বাসে দ্রুত গতি থাকার কারনে চালক বাসটির নিয়ন্ত্রণ হারায় এবং সড়কের পাশের গাছের সাথে ধাক্কা খায়। মুহুর্তেই বাসটি দুমড়ে মুচড়ে যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পথে অভিভাবক সদস্য বিদ্যুৎ বিশ্বাস ও ল্যাব সহকারি সুদিপ্ত বিশ্বাস মারা যায়।
স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি রায় বলেন, দুর্ঘটনায় ২জন মারা গেছেন এবং ৪৩জন আহত হয়েছেন। আহত শিক্ষার্থীদের বেশীরভাগ মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত। অনেকের শরীরের বিভিন্ন স্থানে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও কারও হাত বা পা ভেঙ্গেছে। তিনি আরও বলেন, এ পর্যন্ত ২০ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাড়িতে পাঠানো হয়েছে। বাকিরা ঢাকা, খুলনা ও যশোরে চিকিৎসাধীন আছে।
আরও জানা গেছে, আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা সহায়তার জন্য স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ইডিএফ (এগারোখান ডেভেলপমেন্ট ফোরাম) উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তারা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বেলা চারটায় বাকড়ী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে এক জরুরী সভার আয়োজন করেছে।
এছাড়াও আহতদের চিকিৎসায় নগদ অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছেন যশোর জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়র বিপুল ফারাজি। এগারোখানের হতাহতদের বাড়িতে যেয়ে পরিবারের সদস্যদের সান্তনা দেন ও খোজ খবর নেন। বাঘারপাড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ভিক্টোরিয়া পারভিন সাথীও এলাকায় হতাহতদের খোজ খবর নেন ও সমবেদনা জানান।