বিলাল হোসেন মাহিনী : ভাষা আন্দোলনই বাংলাদেশ রাষ্ট্র নির্মাণের প্রথম পদক্ষেপ। যে ভাষার জন্য সালাম, শফিউর, জব্বার, বরকত, রফিকউদ্দিনসহ অনেকেই শহীদ হয়েছেন। যে ভাষায় কথা না বললে আমাদের মন সন্তুষ্ট হয় না, সেই ভাষা শুদ্ধভাবে লেখার অভ্যাস কি ভুলে যাচ্ছি আমরা! বিশেষ করে বর্তমান সময়ের শিশু থেকে তরুণদের মাঝে বাংলা লেখার অভ্যাস দিন দিন অবনতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
বাংলা লেখা অধিকতর মন্দের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে ইত্যাদি জায়গায় ইংরেজি ভাষায় বাংলা লেখা যেটাকে অনেকে বাংলিশ বলে থাকেন। এই বাংলিশের অত্যাধিক ব্যবহার প্রকৃত বাংলা ভাষাকে বিকৃত করে তুলছে। বাংলিশ মূলত: বাংলা কথার মধ্যে ইংরেজি কথা বলা। অর্থাৎ আমাদের মোবাইলে যখন ডাক আসে, আমরা তখন বলি কল আসছে, যখন বলা উচিত ডাকটি গ্রহণ করো, তখন বলি কলটি রিসিভ করো। এমন হাজারও হাজারও খিচুড়ি পাকানো বাংলার মধ্যে ইংরেজি কথা ব্যবহার করে বাংলিশ নামক রোগের বিস্তার করে চলছি আমরা।
<<আরও পড়তে পারেন>> আল্লাহর সেরা নেয়ামত ভাষা
ইংরেজি বলা দোষের নয়, বরং যিনি ইংরেজি ভালো বলতে পারেন তার সম্পর্কে মেধার ইতিবাচক দিক প্রকাশ পায়; কিন্তু সমস্যা এখানে যে, আমরা যখন বাংলা বলি সেই সময় ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করব কেন? যখন কথোপকথন করব, তখন হয় সম্পূর্ণ বাংলায় অথবা শুধু ইংরেজিতে কথা বলব। মোটকথা একটা নির্দিষ্ট সময় কথা বলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত যে ভাষায় কথা বলছি, সে ভাষা চলমান রাখব। তাহলে কোনো ভাষার অসুন্দর হবে না, বিশেষ করে বাংলা ভাষা ব্যবহারের সময় ইংরেজি ভাষার অভ্যাস ত্যাগ হবে।
আজকের আলোচনার আসল চিন্তার বিষয় হচ্ছে এতদিন পর্যন্ত কথা বলার মধ্যেই সমস্যাটি সীমাবদ্ধ ছিল; কিন্তু এখন সমস্যাটি লেখার মধ্যে শতভাগ পৌঁছে গেছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিকমাধ্যম ফেইসবুক থেকে শুরু করে টুইটার, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, লিংডিন ইত্যাদিতে বেশিরভাগ বাংলাদেশিই বাংলা শব্দ বাংলা বর্ণমালায় না লিখে শব্দটি ইংরেজি বর্ণমালা দিয়ে প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
অনলাইন কথোপকথনে বাংলা শব্দ ইংরেজি বর্ণমালা দিয়ে লেখাই দিন দিন খুবই বেড়ে চলছে। উপরিউক্ত আলোচনার দুটাই বাংলিশ। একটি বাংলা শব্দের মধ্যে ইংরেজি শব্দ বা কথা বলা এ অর্থে অন্যটি বাংলা শব্দ ইংরেজি বর্ণমালায় লেখা এ অর্থে বাংলিশ। এ বাংলিশ লেখার জন্য আমরা বাংলা শব্দ সঠিকভাবে লেখা ভুলে যাচ্ছি, লেখার গতি, দক্ষতা, শব্দচয়ন ইত্যাদি হারিয়ে ফেলার পথে।
শুধু তাই নয়, আমি যাই, আমি খাই, ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনেকেই আমি যায়, আমি খায় (অর্থাৎ, শেষে ‘ই’ ব্যবহার না করে অস্তস্থ ‘অ’ ব্যবহার করছেন। আবার সে যায়, সে খায় এর জায়গায় সে যাই, সে খাই ব্যবহার করছেন। কোথায় কোন অক্ষর ব্যবহার হয়, সেটা বহু সার্টিফিকেটধারী শিক্ষতরাও জানেন না।
শুধু আমরা তরুণ—বৃদ্ধরা নয়, শিশু—কিশোরদের এ খারাপ অভ্যাস শিখিয়ে চলছি। ইদানিং প্রাইমারি—নিম্নমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরাও বাংলা শব্দ ইংরেজি বর্ণমালায় লিখতে পছন্দ করে। তাদের ধারণা এটি বাংলার চেয়ে উচ্চতর ভাষা।
তারা মনে করে বাংলিশ বাদ দিয়ে বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করে শব্দ ও বাক্য লেখা পুরোনো বিষয়। ফলাফলস্বরূপ আমাদের ছোট শিক্ষার্থীদের বাংলা লেখা নামক প্রতিভা হারিয়ে যাচ্ছে। আর এমনভাবে চলতে থাকলে বাংলা বর্ণমালায় বাংলা লেখা প্রাচীন অনেক ভাষার ন্যায় একদিন বিলীন হয়ে যাবে।
দেশের সবার কাছে অনুরোধ থাকবে, বাংলা ভাষার প্রতি গুরুত্ব দেয়ার জন্য, অনুরোধ থাকবে আমাদের শিশুদের সুপ্ত প্রতিভার সঠিক রাস্তা দেখানোর জন্য, অনুরোধ থাকবে আমাদের ভাইদের প্রাণের বিনিময়ে যে ভাষা পেয়েছি, সেই ভাষাকে যথাযোগ্য মর্যাদায় ও সম্মানের সঙ্গে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য। ভাষার বিকৃতি রোধে বাংলিশ নামক অপভাষা ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে।
লেখক : লেখক : প্রভাষক, গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, অভয়নগর, যশোর ও নির্বাহী সম্পাদক : ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, অভয়নগর, যশোর।