নিজস্ব প্রতিবেদক : প্রতিবছরের ন্যায় এবারও বর্ণিল আয়োজনে বাংলা নববর্ষকে বরণের প্রস্তুতি নিয়ে উদীচী যশোর। সারা দেশের সাথে তাল মিলিয়ে বর্ষবরণে বিগত ৪৭ বছর ধরে পৌর উদ্যানে বর্ণিল ও বৈচিত্র্যময় উপস্থাপনায় যশোরবাসীকে সৃষ্টিশীল আনন্দে মাতোয়ারা করছে যশোরে এ উৎসবের পথিকৃৎ উদীচী, যশোর। বর্ষবরণ উৎসবের ৪৮তম বছরে ব্যতিক্রমী নানা আয়োজনে এবারও তার ব্যত্যয় ঘটবে না বলে আয়োজকদের আশা।
বর্ষবরণ অনুষ্ঠান গতবছরের মতো এবারও পবিত্র রমজান মাসে হওয়ায় বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বরাবরের মত পৌর উদ্যানে সকাল ৭টা ১ মিনিটে উদীচী যশোরের আয়োজনে হবে প্রায় আড়াই ঘণ্টার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। উদীচী হত্যাকা-ের ২ যুগ পেরিয়ে গেলেও বিচার না হওয়ায় এবারের নববর্ষ উৎসব স্লোগান করা হয়েছে- ‘বৈশাখের এই তীব্র দহনকাল- ছিন্ন করুক বিচারহীনতার জাল’।
এ স্লোগানের সাথে মিল রেখে আমন্ত্রণ পত্রে ব্যবহার করা হয়েছে বিক্ষোভ মিছিলের প্লাকার্ড-পোস্টার। বাঁশের চাটাইয়ের উপর লালকাগজে সাদা রঙে লেখা হয়েছে আমন্ত্রণপত্র। উদীচী হত্যাকা-ের বিচার কার্যকর করার আহ্বান জানিয়ে যশোরবাসীকে আনন্দে মাতিয়ে দেবে যশোরে ‘নববর্ষ উৎসবের পথিকৃৎ’ উদীচী যশোর। এছাড়া শিশু-কিশোরসহ তিনশতাধিক সংগীত, নৃত্য ও অভিনয় শিল্পী বৈচিত্র্যময় নানা আয়োজনে নববর্ষ উৎসবের ৪৮ বছরে পা রাখছে এ সংগঠন। প্রতি বছরের ধারাবাহিকতার দৃষ্টান্ত রাখতে এবারও যশোরবাসীকে উপহার দেবে চমক দেয়া জমকালো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সংগঠনের সব শিল্পীর মৌলিক পোশাক এ অনুষ্ঠান বর্ণিল করে তুলবে। যা বাস্তবায়নে ব্যস্ত সময় পার করছে সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও কলাকুশলীরা।
বাংলা নববর্ষবরণ উৎসবের বর্ণাঢ্য ও বৈচিত্র্যময় নানা অনুষ্ঠানমালা নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, যশোর জেলা সংসদের মিলনায়তনে বুধবার দুপুরে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন উদীচীর উপদেষ্টা প্রবীণ সাংবাদিক রুকুনউদ্দৌলাহ্, সভাপতি ও নববর্ষ উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক তন্দ্রা ভট্টাচার্য্য, সাধারণ সম্পাদক ও নববর্ষ উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব সাজ্জাদুর রহমান খান বিপ্লব।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়- বাঙালি ও বাংলা নববর্ষের অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবারও নতুন করে নতুন বছরের আগমন। পুরাতন দিনের অন্ধকারকে পেছনে ফেলে বৈশাখের পূণ্য প্রভাতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, কন্ঠরোধ করা নিপিড়নমূলক আইন, বিচারহীনতা এবং নারী বিদ্বেষসহ সকল অপশক্তিকে বিনাশ করে রাত ভোর হবার নতুন সূর্যের আলোয় আলোকিতের আহ্বান করা হবে।
ভোরের প্রকৃতির স্নিগ্ধ আমেজ, শ্রোতার স্পর্শকাতর হৃদয় এবং সংগীতকে এক সুরে বাঁধতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভৈরবী রাগের উপর ‘নিশি ভোর হালো জাগিয়া’ গানের মধ্য দিয়ে শুরু হবে বৈশাখের আবাহন পর্ব। এরপর থাকবে সেই চিরায়ত কালজয়ী রবিঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো…’। থাকবে পাঁচ গীতিকবির মধ্যে অন্যতম তিনজন রজনিকান্ত সেন, দিজেন্দ্র লাল রায় এবং অতুল প্রসাদের গান নিয়ে পরের পরিবেশনা। এ ছাড়াও শিশুতোষ পরিবেশনা, বাংলা হারানো দিনের গান জীবনমুখী গান, লোকসংগীত, আধুনিক ও লোকনৃত্য। পর্যায়ক্রমে ভুলুণ্ঠিত গণতন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা ও সামাজিক অসংগতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী গণসংগীত।
সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়- অনুষ্ঠানস্থলের সার্বিক শৃংখলা রক্ষায় গঠিত হয়েছে স্বেচ্ছাসেবক দল। প্রায় ১০০ জন উদীচী কর্মী অনুষ্ঠানস্থলে ছোট ছোট উপদলে ভাগ হয়ে মাঠের সার্বিক শৃংখলা নিশ্চিত করবার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে। সেই সাথে জেলা ও পুলিশ প্রশাসন আইন শৃংখলা বাহিনীর মাধ্যমে মাঠের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবেন।
প্রতি বছরের মতো এবার নববর্ষকে ঘিরে ডা. রবিউল নববর্ষ পদক-১৪৩০ পাচ্ছেন উদীচী যশোর সংসদের সহ-সভাপতি এবং কণ্ঠশিল্পী শেখর দেবনাথ।
উদীচী যশোরের সাধারণ সম্পাদক ও নববর্ষ উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব সাজ্জাদুর রহমান খান বিপ্লব বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে ৪৭ বছর ধরে এই শহরের মানুষকে একইসূত্রে গেঁথে পৌর উদ্যানে বিশাল আয়োজনে সম্পৃক্ত করে আসছে। ১৯৯৯ সালে যশোরে অনুষ্ঠিত উদীচীর জাতীয় সম্মেলনে বোমা হামলা চালিয়েও উদ্যোগকে থামিয়ে রাখা যায়নি। প্রতিবছর হাজারো মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয় উদীচীর প্রভাতী অনুষ্ঠানস্থল পৌর উদ্যান।
উল্লেখ্য, যশোর উদীচী ঢাকার বাইরে প্রথম শাখা সংগঠন যা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৯ সালে। প্রতিষ্ঠার তিন বছর পর ১৯৭২ সাল থেকে উদীচী যশোরের আয়োজনে শুরু হয় বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখ উদযাপন। তৎকালীন কার্যালয় যশোর আমীন হোটেলে ঘরোয়া পরিবেশে এ অনুষ্ঠান হয়। পরের বছর নেতাজী সুভাষ চন্দ্র রোডস্থ ক্যালট্যাক্সের সামনে উন্মুক্তস্থানে হয় বর্ষবরণানুষ্ঠান।
এরপর ১৯৭৪ সালের নববর্ষ আয়োজনের প্রস্তুতির সময় তৎকালীন উপদেষ্টা ডাক্তার কাজী রবিউল হক প্রস্তাবে পৌর উদ্যানে প্রকৃতির মাঝে এ অনুষ্ঠান শুরু হয়। শুরুর সেই অনুষ্ঠান হয়েছিল দুই পুকুরের মাঝে সেতুর উপর। পরের বছর হয় পৌর উদ্যানে অবস্থিত ঝর্ণার পাশে। এখানে কয়েক বছর অনুষ্ঠান হওয়ার পর বর্তমান মঞ্চের উত্তর দিকে তৎকালীন পৌর চেয়ারম্যান খালেদুর রহমান টিটো অনুষ্ঠান করার জন্য মাটির ঢিবি তৈরি করে দেন।
এ ঢিবির উপর শুরু হয় বাংলা বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। পরবর্তীতে ২০০১ সাল থেকে তৎকালীন পৌর মেয়র এসএস কামরুজ্জামান চুন্নু’র তত্ত্বাবধানে করে দেওয়া বর্তমানের স্থায়ী মঞ্চে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। এভাবেই এ উদ্যানে নববর্ষ উৎসব আয়োজনে এবার ৪৭ বছর পূর্ণ হয়েছে।
সাজ্জাদুর রহমান খান নববর্ষ উৎসব সার্বজনীন করার লক্ষ্যে বলেন, বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য তার সংস্কৃতি। আর এ সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশ পেয়েছে পহেলা বৈশাখ উদযাপনে। নববর্ষ বর্তমানে অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। যে উৎসবে সকল জাতি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমান ভাবে অংশ নেয়। আর এ উৎসব আয়োজনে যশোর পথিকৃতের ভূমিকা পালন করছে।
৪৭ বছর আগে পৌর উদ্যানে বর্ষবরণের যে যাত্রা শুরু করেছিল তা আজ শ্রেষ্ঠ অসাম্প্রদায়িক উৎসবে রূপ নিয়েছে। যশোরের এই সার্বজনীন উৎসব আয়োজনের শুরুটা উদীচীর দ্বারা হলেও সমস্ত যশোরের মানুষ যে আবেগ ও উচ্ছ্বাস নিয়ে এ উৎসবকে গ্রহণ করেছে এটা উদীচীর বড় পাওয়া। তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনার এ উৎসবে আরও ব্যাপক গণমানুষের অংশগ্রহণসহ শহরের পাশাপাশি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়–ক প্রত্যাশা করেন এবং সকলকে আগাম বৈশাখী শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।