সমাজের কথা ডেস্ক : ছোটপর্দার অভিনেত্রী হোমায়রা হিমু থাকতেন রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানার দশ নম্বর সেক্টরে। দুই দশকের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ছিল নানা চড়াই-উৎরাই। বিয়ে করলেও সংসারটা ঠিকঠাক করা হয়ে ওঠেনি। একপর্যায়ে স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। হিমুর ঘনিষ্ঠজন, কথিত প্রেমিক বা বয়ফ্রেন্ড ছিলেন মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন ওরফে রুফি (৩৬) নামের এক ব্যক্তি। আত্মহত্যার ছয় মাস আগে থেকে হিমুর বাসায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল রুফির। ওই বাসায় মাঝেমধ্যেই রুফি রাত্রিযাপন করতেন বলেও জানা যায়।
তাদের সম্পর্কের এক পর্যায়ে হিমু তার বয়ফ্রেন্ড রুফির মোবাইল ফোন নম্বর ও ভিগো আইডি ব্লক করে দেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা ও মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। রুফি ভিকটিম হিমুকে আত্মহত্যার প্ররোচনা দেন। পরে রাগে ও অভিমানে গত বছরের ২ নভেম্বর হিমু বাথরুমে ঢুকে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
এ ঘটনায় ২ নভেম্বর রাতেই হিমুকে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে তার মামা নাহিদ আক্তার বাদী হয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা করেন। গতকাল সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) ঢাকার মেট্রোপলিট ম্যাজিস্ট্রেট নুরুল হুদার আদালতে উত্তরা পশ্চিম থানার এসআই সাব্বির হোসেন এ মামলার চার্জশিট দাখিল করেন। চার্জশিটে আসামি করা হয় হিমুর ‘বয়ফ্রেন্ড’ জিয়াউদ্দিন রুফিকে। চার্জশিটেই ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরেছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।
হিমুর বাসায় রাত কাটাতেন রুফি
চার্জশিটে বলা হয়েছে, ভিকটিম হুমায়রা নুসরাত হিমু (৩৮) একজন অভিনয়শিল্পী। তিনি উত্তরা পশ্চিম থানার ১০ নম্বর সেক্টরে একটি ফ্ল্যাটে একা থাকতেন। হিমুর বিয়ে হলেও পরবর্তীসময়ে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। একই ফ্ল্যাটে থাকতেন মেকআপম্যান ও আর্টিস্ট কবির আহম্মেদ মিহির (৪০)। ২০২৩ সালের ২ নভেম্বর বাদীর মামাতো ভাই কামরুল চৌধুরী বাদীকে হিমুর আত্মহত্যা খবরটি জানান। বলেন, হিমুর মরদেহ উত্তরা পশ্চিম আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাখা হয়েছে।
ওই খবরে বাদী দ্রুত ওই হাসপাতালে যান এবং হিমুকে মৃত অবস্থায় দেখতে পান। পরে কবির আহম্মেদ মিহিরকে জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারেন এজাহার নামীয় আসামি জিয়াউদ্দিন ওরফে রুফি ছিলেন হিমুর বয়ফ্রেন্ড এবং ঘটনার ছয় মাস আগে থেকে হিমুর বাসায় তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। এমনকি মাঝেমধ্যে রাত্রিযাপনও করতেন।
ঘটনার একদিন আগে গত বছরের ১ নভেম্বর হিমু আসামি রুফির মোবাইল ফোন নম্বর ও ভিগো আইডি ব্লক করে দেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে মনোমালিন্য হয়। পর দিন ২ নভেম্বর বিকেলে রুফি হিমুর বাসায় গিয়ে কলিংবেল চাপলে মিহির বাসার মেইন দরজা খুলে দেন। রুফি বাসায় ঢুকলে মিহির যথারীতি তার রুমে চলে যান। এর কিছুক্ষণ পরই মিহিরের রুমে গিয়ে রুফি চিৎকার করে বলেন, ‘হিমু আত্মহত্যা করেছে’।
এ কথা শুনে মিহির তখন রুফিকে জিজ্ঞাসা করেন- আপনি তো রুমেই ছিলেন। জবাবে রুফি জানান, তখন তিনি বাথরুমে ছিলেন এবং তখনই হিমু আত্মহত্যা করেছেন। এরপর মিহির হিমুর রুমে গিয়ে তাকে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় রশি দিয়ে ফাঁস লাগানো অবস্থায় দেখতে পান। এসময় রুমে থাকা কাঁচের দুটি গ্লাস ভাঙা অবস্থায় দেখতে পান মিহির।
মৃত্যুর পর হিমুর মোবাইল ফোন নিয়ে যান রুফি
চার্জশিটে তদন্তকারী কর্মকর্তা আরও উল্লেখ করেন, তাৎক্ষণিক মিহির ও আসামি রুফি হিমুকে উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মৃত ঘোষণা করেন। এসময় মরদেহ হাসপাতালে রেখেই হিমুর ব্যবহৃত দুটি মোবাইল ফোন নিয়ে কৌশলে সেখান থেকে বেরিয়ে যান রুফি। তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামি মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন রুফির বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারার অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন।
২০২৩ সালের ২ নভেম্বর রাতে হিমুকে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে তার মামা নাহিদ আক্তার উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় হিমুর বয়ফ্রেন্ড জিয়াউদ্দিন রুফিকে আসামি করা হয়। এরপর ৩ নভেম্বর ঢাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে র্যাব। পরদিন ৪ নভেম্বর তাকে আদালতে হাজির করে মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুর রহমান আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
ওই বছরের গত ২২ নভেম্বর মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য আসামিকে পাঁচদিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। শুনানি শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জাকী আল ফারাবী দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
রুফিকে গ্রেফতারের পর যা জানায় র্যাব
এর আগে ৩ নভেম্বর রুফিকে গ্রেফতারের পর তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে র্যাবের তৎকালীন লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানিয়েছিলেন, ২০১৪ সালে হিমুর খালাতো বোনের সঙ্গে রুফির বিয়ে হয় এবং কিছুদিনের মধ্যে পারিবারিক সমস্যার কারণে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। পারিবারিক আত্মীয়ের সম্পর্কের জেরে রুফির সঙ্গে হিমুর পরিচয়। হিমুর খালাতো বোনের সঙ্গে রুফির বিবাহ বিচ্ছেদ হলেও হিমু ও রুফির মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।
র্যাব তখন আরও জানায়, রুফি আরেকটা বিয়ে করলেও হিমুর সঙ্গে তিনি বিভিন্নভাবে নিয়মিত যোগাযোগ করতেন এবং ঘটনার কয়েক মাস আগেও তাদের মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরি হয়। রুফি বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে হিমুর বাসায় নিয়মিত যাতায়াত করতেন। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া ও বাকবিতণ্ডা হতো।
র্যাব জানায়, গত দু-তিন বছর ধরে হিমু ‘ভিগো লাইভ অ্যাপস’-এ অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে বিপুল টাকা অপচয় করেন। এ নিয়েও রুফির সঙ্গে হিমুর বাকবিতণ্ডা হতো।
যা বলছেন বাদী ও তদন্তকারী কর্মকর্তা
মামলায় বাদী নাহিদ আক্তার অভিযোগ করেন, জিয়াউদ্দিন রুফি হিমুর ‘বয়ফ্রেন্ড’ ছিলেন। ঘটনার ছয় মাস আগে থেকে তিনি নিয়মিত হিমুর বাসায় যাতায়াত এবং মাঝেমধ্যে রাতযাপন করতেন। গত ১ নভেম্বর রাফির মোবাইল ফোন নম্বর ও ভিগো আইডি ব্লক করে দেন হিমু। বিষয়টি নিয়ে উভয়ের মধ্যে ঝামেলা হয়। হিমুর মৃত্যুর পর আসামি জিয়াউদ্দিন রুফিকে গ্রেফতার করা হলেও পরে তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিন পান।
এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উত্তরা পশ্চিম থানার এসআই সাব্বির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ভিকটিম হোমায়রা হিমুকে আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে করা মামলায় তার বয়ফ্রেন্ড জিয়াউদ্দিন ওরফে রুফির বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছি। তদন্তে আসামির বিরুদ্ধে ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় দণ্ডিবিধির ৩০৬ ধারায় এ চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে।
হোমায়রা হিমুর জন্ম ১৯৮৫ সালের ২৩ নভেম্বর লক্ষ্মীপুর জেলায়। অভিনয়ে তার ক্যারিয়ার শুরু ২০০৫ সালে। টিভি নাটকে অভিনয় শুরুর পর নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় হিমুর অভিনয় দর্শকের মধ্যে সাড়া ফেলে। ২০১১ সালে মুক্তি পাওয়া ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ দিয়ে চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় হিমুর। ওই সিনেমাটিতে তরু আপা চরিত্রে দেখা যায় তাকে। তবে দীর্ঘ অভিনয় ক্যারিয়ারে বিভিন্ন সময় পর্দায় তার উপস্থিতি ছিল অনিয়মিত। এ নিয়ে অভিনেত্রীর মধ্যে সঠিক সুযোগ না পাওয়ার একরকম অভিমান বা অনুযোগও ছিল।
জেএ/এমকেআর/এএসএম