তহীদ মনি : রোববার দুপুর। যশোর শহরের চৌরাস্তা মসজিদের মোড়। রাস্তার লেইন নির্দেশক সাদা দাগের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন ট্রাফিক পুলিশ। ইজিবাইক, রিকসা, মোটরসাইকেলের সাথে দুএকটি প্রাইভেট মুখোমুখি। চতুর্দিক থেকে গাড়ি আসছে। গাড়ির চাপে যেন চাপা পড়ছেন ট্রাফিক পুলিশ নিজেই। জীবনের মায়ায় মাঝে মাঝে রাস্তা ছেড়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকছেন। যে যেদিকে পারছেন দিচ্ছেন চাপ। যেন চাপাচাপির খেলা।
এ দৃশ্য শুধু চৌরাস্তার মসজিদ মোড়ে নয়, শহরের ব্যস্ততম এলাকা কোর্টমোড় ও দড়াটানাতেও থাকে নিত্য। জেসটাওয়ারের সামনে, দড়াটানা থেকে কুইন্স হাসপাতালের সামনের সড়কে যানবাহনের চাপাচাপি লেগেই থাকে। আর শহরের বড়বাজার এইচএমএম রোড, হাসপাতাল মোড়ে সকাল-দুপুর-সন্ধ্যায় পা রাখা দায় হয়ে যায়।
প্রায় ১৬০ বছরের পুরনো যশোর পৌরসভা। দেশের প্রাচীনতম এ পৌরসভায় আকাশচুম্বি ভবন বাড়ছে, বাড়ছে জনসংখ্যাও। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যানবাহন কিন্তু রাস্তার প্রশস্ততা বাড়েনি সেভাবে। ব্রিটিশ আমলের সরু রাস্তা জনসংখ্যার চাপে এখন গলিপথ হয়ে গেছে। এরপরও এর প্রশস্ততা বাড়ানোর তেমন উদ্যোগ নেই। এজন্য বড় শহরের ছোট রাস্তায় নগরবাসীকে প্রতিনিয়তই নানাবিধ ভোগান্তী পোহাতে হচ্ছে। এতে চলাচলে যেমন বিঘ্ন ঘটছে, তেমনি সময় ক্ষেপণ হচ্ছে, দুর্ঘটনা বাড়ছে এবং শহরে নির্বিঘ্নে চলাচল মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, পৌরসভার কোনো কোনো রাস্তা এখনো ৪ ফুট চওড়াই রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গুটিকয়েক নতুন রাস্তার প্রশস্ততা বাড়লেও সেগুলো স্বল্প দৈর্ঘ্যরে। পুরোনো পৌরসভা হওয়ার পরও এখনো অনেক রাস্তা কাঁচা বা সেমি পাকা । আধুনিক শহর ব্যবস্থার সাথে কোনো মিল নেই- নেই সড়ক ব্যবস্থার আধুনিক অবয়বও।
১৮৬৪ সালে যশোর পৌরসভা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। শুরুতে এর আয়তন কম থাকলেও বছর খানেকের মধ্যে পৌর এলাকার আয়তন দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৪ বর্গ মাইল। বর্তমানে এর আয়তন ১৪ দশমিক ৭২ বর্গ কিলোমিটার এবং প্রস্তাবিত আয়তন ২২ দশমিক ৩২ বর্গ কিলোমিটার।
যশোর পৌরসভার তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এ শহরে ৪ লাখ ৪৭ হাজার ৯১৪ জন মানুষের বসবাস। এত অল্প জায়গায় এত মানুষের বসবাস শহরটিকে ঘিঞ্জি করে তুলছে বলে খোদ পৌরমেয়রও স্বীকার করেছেন।
পৌরসভার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পৌরশহরের পাকা রাস্তা রয়েছে ১৭৬ কিলোমিটার। এছাড়া আরসিসি সড়ক ৩০ দশমিক ২৫ কিলোমিটার, সোলিং ৫১ কিলোমিটার এবং কাঁচা রাস্তা রয়েছে ৩০ দশমিক ৬০ কিলোমিটার। পৌর তথ্যে জানানো হয়েছে, এই রাস্তা সবই পৌরসভার নিজস্ব। তবে পৌরসভার মধ্যে প্রশস্ত কয়েকটি সড়ক রয়েছে সেগুলি সড়ক বিভাগের। দড়াটানা থেকে পালবাড়ি, দড়াটানা থেকে মণিহার হয়ে মুড়লি, দড়াটানা থেকে চাচঁড়া, দড়াটানা থেকে জেলখানা হয়ে নিউমার্কেট এবং পালবাড়ি থেকে বোর্ড অফিস হয়ে মনিহার। এই সড়কগুলি সড়ক বিভাগের হলেও সবচেয়ে কম প্রশস্ততার সড়ক দড়াটানা-মণিহার পর্যন্ত। এ সড়কের থানা মোড়ের অংশ খুবই সরু।
অবশ্য সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন, এসব সড়কের প্রশস্ততা ২৪ মিটার আছে। সম্প্রতি তৈরি হওয়া মণিহার থেকে মুড়লি সড়কটির সব মিলিয়ে প্রশস্ততা ১১০ মিটার। পালবাড়ি থেকে শিক্ষাবোর্ড অফিস হয়ে মণিহার পর্যন্ত সড়কের প্রশস্ততা ২৪ মিটার। শহরের এই সড়কগুলো বড় দেখা যায়।
পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী কামাল হোসেন জানান, তাদের নিজস্ব সড়ক ৬০ মিটার পর্যন্ত প্রশস্ত । উদাহরণ হিসেবে তিনি রেল রোডের (যেটি আশ্রম হয়ে চলে গিয়েছে) কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, পৌরসভার নিজস্ব পাকা সড়কের সর্বনিম্ন প্রশস্ততা ১০ মিটার । এ রকম সড়ক পাওয়ার হাউজ পাড়ায় পাওয়া যাবে।
মেয়র হায়দার গণি খান পলাশ জানান, গত ২ বছরে বস্তি উন্নয়ন প্রকল্পসহ কয়েকটি প্রকল্পে ৬০টির বেশি নতুন রাস্তা আরসিসি ঢালাই দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এ রাস্তার সর্বোচ্চ প্রশস্ততা ৮ ফুট এবং সর্বনিম্ন প্রশস্ততা ৪ ফুট ।
পৌর শহরের পূর্ব বারান্দিপাড়া, পশ্চিম বারান্দিপাড়া, শংকরপুর, আশ্রম রোড, বেজপাড়া, ঘোপবেলতলা এলাকাসহ বেশিরভাগ এলাকার মানুষের অভিযোগ, এত পুরাতন শহরের কোনো রাস্তাই বড় না। বেশির ভাগ রাস্তা সরু এবং এর দুপাশ চলাচলের অনুপযোগী হওয়ায় দুটি রিক্সা, ভ্যান বা ইজিবাইক পাশাপাশি চলাচল করতে পারেনা। এর ওপর অতিরিক্ত বাহনের চাপ থাকায় প্রায় প্রতিটি সড়কে দিনের বেশিরভাগ সময় জট পাকিয়ে যায় রিক্সা-ভ্যান-ইজিবাইক-মোটরসাইকেল-মালগাড়ির। এর সাথে হুটহাট করে ঢুকে পড়ে থ্রিহুইলার, নসিমন-করিমন, মাছ ও পণ্যবাহী পিকআপ, ট্রাক, স্কুলবাস, বিভিন্ন ক্যুরিয়ারের বড় বড় কাভার্ডভ্যানসহ অন্যান্য গাড়ি।
থানা মোড় থেকে সম্মিলনী স্কুলে যাওয়ার পথে রিক্সা চালক সাতক্ষীরার জসিম উদ্দিন জানান, বছর দুয়েক হলো তিনি যশোরে রিক্সা চালাচ্ছেন, ভাড়া ভালো হলেও প্রতিটি গন্তব্যে পৌছাতে অনেক সময় লেগে যায়। এজন্য ফাঁক রাস্তা পেলেই গতি বাড়িয়ে দেয় রিকসাওয়ালারা। তার মতে, বেশিরভাগ রাস্তা চিকন, পাশাপাশি যাওয়া যায় না তার মধ্যে অন্যগাড়ি ঢুকে বা কেউ কেউ ওভারটেক করতে গেলে জ্যাম বেঁধে যায়।
শংকরপুর চাতালের মোড় এলাকায় বসবাসকারী ইঞ্জিন রিক্সা চালক শফিকুর জানান, বেশিরভাগ রাস্তা আঁকাবাকা আর সরু, সারাদিন ভিড় থাকে, জ্যাম থাকে সময়মতো চলাচল করা যায় না। সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরএন রোডের তামান্না বলেন, বেশিরভাগ দিনই আগেই বের হতে হয়, যেতেও দেরি হয়, সারা শহরেই জ্যাম বেঁধে থাকে। পৌর নাগরিক হাফিজুর রহমান বলেন, এত পুরোনো শহর হলেও বেশিরভাগ রাস্তা ছোট। এদিকে ছোট ছোট গাড়ির সংখ্যাও দিনদিন বাড়ছে কিন্তু রাস্তা বড় হচ্ছে না, তাই শহরটি দিন দিন চলাচল ও বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে রাজনীতিবিদ ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, কোনো পরিকল্পনা নেই এ শহরের জন্যে। বলা হচ্ছে মডেল টাউন কিন্তু কোনো পরিকল্পনা নেই, রাস্তা, ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ সর্বত্রই অপরিকল্পনা, অব্যবস্থাপনা, চলাচলের অনুপযোগী শুধু নয় একটা ঘিঞ্জি শহরে পরিণত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে কিন্তু শহরটাকে দেখলে কোনোভাইে সে কথার প্রমাণ করা যায় না। সবচেয়ে পুরোনো শহরের এই অবস্থা দেখতে কষ্টলাগে। যশোরবাসী আর কত পেছনে থাকবে?
শহরের রাস্তাঘাট ছোট ও অপরিকল্পিত স্বীকার করে মেয়র হায়দার গণি খান পলাশ বলেন, বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে শহর বর্ধিত হয়েছে। ইংরেজ আমলে এর শুরু সাহেবদের প্রয়োজনে, স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রয়োজনে নয়। পরবর্তীতে কলেবর বৃদ্ধি হয়েছে তবে একটি শহর তৈরিতে যে ধরণের পরিকল্পনা থাকা উচিত ছিল তার ছাপ রাখা হয়নি। ফলে শহর ও বড় রাস্তা, পরিচ্ছন্ন নগর ব্যবস্থা বলতে যা বোঝায় তা অতীতে পাওয়া যায়নি। বর্তমান সরকার এ শহরের উন্নয়নের চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটা বড় বড় রাস্তা হয়েছে, ড্রেনেজ ব্যবস্থারও উন্নয়ন হচ্ছে।
এ শহরের বেশিরভাগ রাস্তা আকাবাঁকা হয়ে চলে গেছে, এর অন্যতম কারণ রাস্তা তৈরির জন্যে পর্যাপ্ত জায়গাও পাওয়া যায় না। অনেক লোকের বসবাস বিধায় ইচ্ছে করলেও অনেক পরিকল্পনা করা যায় না। তাছাড়া উন্নয়নে বিপুল পরিমাণ ব্যয় থাকে, অর্থাভাবে ছোট রাস্তা বড় করা যাচ্ছে না, কাঁচারাস্তা পাকা করা যাচ্ছে না। তারপরও সরকারের আন্তরিকতায় অনেক উন্নয়ন হচ্ছে আগামীতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে। একসময় কিছুটা হলেও পরিকল্পিত ও বড় করা সম্ভব হবে।