সাইফুল ইসলাম : বই, ফটোকপি, স্টেশনারি ও কম্পিউটার ব্যবসা করার চুক্তিতে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চালু হয় জেলা প্রশাসন মার্কেট ও মুসলিম একাডেমি মার্কেট। ঘোষণা ছিল মার্কেটে কোন ফাস্টফুডের দোকান হবে না। দুই বছরের মাথায় চুক্তি ভুলতে বসেছে ব্যবসায়ীরা। মার্কেটের ৫০টি দোকানের ১৩টিই এখন ফাস্টফুডের। ক্রমান্বয়ে লাইব্রেরি পট্টি বিনোদন কেন্দ্রে রূপ নিয়েছে। দল বেঁধে আসা তরুণ তরুণীরা বই পেছনে ফেলে খাওয়া দাওয়া আর আড্ডায় ব্যস্ত থাকছে। নষ্ট হচ্ছে লাইব্রেরির পরিবেশ। খাবারের দোকান থেকে আগুন লাগার আতঙ্কে আছেন বই ব্যবসায়ীরা।
দড়াটানা ভৈরব নদের উত্তর পাড়ে ছিল যশোর শহরের অধিকাংশ লাইব্রেরি। ২০১৯ সালে জেলা প্রশাসন নদীর জায়গা দখলমুক্ত করলে বই ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি কয়েকটি বেডিং শপ ভাঙ্গা পড়ে। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে বইয়ের দোকান। এতে ক্রেতা বিক্রেতা উভয়ই সমস্যা ভোগ করছিল। সে সময় একটি ঠিকানা চেয়ে পুস্তক ব্যবসায়ী সমিতি আন্দোলন শুরু করে। সমিতির স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে যুক্ত হন কেন্দ্রীয় নেতারা। জেলা প্রশাসনের সাথে দফায় দফায় বৈঠক শেষে মুসলিম একাডেমির দক্ষিণ পাশ ও পূর্বপাশ বই ব্যবসায়ীদের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়।
শহরের বাঁশপট্টি ও নার্সারিপট্টি হিসেবে পরিচিত ওই সড়কে জনগণের চলাচল ছিল সীমিত। শুধু একই ঠিকানায় থাকার আশায় লাইব্রেরি মালিকরা বরাদ্দকৃত জমিতে ঝুঁকি নিয়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করে ঘর তৈরি করে। কিছু দিনের মধ্যেই বই ব্যবসা জমতে শুরু করে। একই সময়ে ডিভাইডারসহ সড়কটি পুনর্নির্মাণ ও সড়কবাতি দিয়ে দৃষ্টিনন্দন করে পৌরসভা।
সড়কটির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তরুণরা ‘প্যারিশ রোড’ নামে অভিহিত করে। এক সময়ের বাঁশপট্টি হয়ে ওঠে বিনোদন কেন্দ্র। ছেলেমেয়েরা দলে দলে প্যারিশ রোডে ঘুরতে আসতে থাকে। রাস্তার পাশে বসিয়ে দেয় আড্ডা। বিনোদন পিপাসুদের চাহিদা মেটাতে লাইব্রেরিপট্টিতে খাবারের দোকান বসতে শুরু করে। সুধীজনের প্রত্যাশার মুখে সড়কটির নাম বীরমুক্তিযোদ্ধা আলী হোসেন মনির নামে নামকরণ করে।
জমি বরাদ্দের পূর্বে ২০১৯ সালের ২৯ আগস্ট জেলা প্রশাসন ও মুসলিম একাডেমির সাথে চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করে লাইব্রেরি মালিকরা। চুক্তির প্রধান শর্ত ছিল বই, ফটোকপি, স্টেশনারি ও কম্পিউটার ছাড়া অন্য কোন ব্যবসা করা যাবে না। দোকান হস্তান্তর করা যাবে না। কোনভাবে খাবারের দোকান হবে না। শুধু টি স্টল হিসেবে একটি মাত্র দোকান বরাদ্দ হয়। কিন্তু মাত্র দুই বছরের মাথায় এসব শর্ত গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে।
ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ গোপনে পজিশন বিক্রি করে দিয়েছে। আবার কেউ অধিক ভাড়ার লোভে ভাড়া দিয়েছে। ব্যবসায়ীদের ছেড়ে দেয়া এসব দোকানেই চলছে ফাস্টফুড ব্যবসা। তবে এ বিষয়ে প্রতিবাদ তো দূরের কথা বন্দোবস্ত বাতিলের ফলে ব্যবসায়ীরা মুখ খুলতেও নারাজ। ব্যবসার পরিবেশ নষ্ট হলেও বই ব্যবসায়ীরা মুখবুজে সহ্য করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বই বিক্রেতা জানান, এ রোডের পাশে ফাস্টফুডের দোকানের সামনে গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা নেয়। যারা ফাস্টফুডের দোকানে আসে তারা বইয়ের দোকানের সামনে গাড়ি পার্কিং করে। এতে করে তাদের দোকানের সামনের পথ বন্ধ হয়ে যায়। তিনি আরও জানান, উঠতি বয়সী অনেক ছেলে-মেয়ে রাস্তার পাশে বসে চিৎকার চেঁচামেচি করে, গান করে ,জোরে বাইক চালানোসহ নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে।
অন্য একজন বই বিক্রেতা জানান, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এ লাইব্রেরি মার্কেট চালুর সময় কোনো ফাস্টফুডের দোকান ছিলো না, এরপর মুসলিম একাডেমির জায়গায় কয়েকটি ফাস্টফুডের দোকান হলে বই বিমুখ উঠতি বয়সী ছেলে- মেয়েদের আসা-যাওয়া বৃদ্ধি পায়। এসব ছেলে-মেয়েদের অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের নেশা করতেও দেখা যায়। এই কারণে এই রোডের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। শিক্ষার্থী বা সাধারণ মানুষ বই পড়তে বা কিনতে আসতে অস্বস্তি বোধ করে।
আরও একজন বই বিক্রেতা জানান, এ রোডে প্রধান সমস্যা হলো গাড়ি পার্কিং এর ব্যবস্থা না থাকা। তাছাড়া খাবারের দোকানে গ্যাসের সিলিন্ডারের কারণে কোনো সময় আগুন ধরলে তাদের বই সব পুড়ে যাবে। আর বইয়ের দোকানে আগুন ধরলে ভয়াবহ ক্ষতি হবে। কারণ প্রতিটি বইয়ের দোকানে আট থেকে দশ লাখ টাকার উপরে বই থাকে আর খাবারের দোকানে তো এক লাখ টাকারও মালামাল থাকে না। তিনি আরও জানান, ডিসি স্যার যখন ডিড দিয়েছিলেন, তখন ডিডে লেখা ছিলো এখানে বই, কম্পিউটার ও ফটোকপির দোকান ছাড়া আর কোনো দোকান হবে না। কিন্তু পরে আর সেই চুক্তি মানা হয়নি।
বই বিক্রেতারা মনে করেন প্যারিস রোডে বইয়ের দোকানের পাশাপাশি সব ধরনের দোকান থাক, কিন্তুÍ সবাই শৃঙ্খলা মেনে চলুক। যাতে কারো ব্যবসা নষ্ট না হয়। বইয়ের দোকানদাররা প্রথম মনে করেছিল এখানে হোটেল হলে তাদের ব্যবসা আরও ভালো হবে, কিন্ত পরে হয়ে গেছে এর উল্টো।
হাসান এ্যান্ড কোং এর একজন কর্মচারী জানিয়েছেন মাঝে মাঝে তাদের সমস্যা হয়। এখানে যারা বিশৃংখল কাজের সাথে জড়িত তাদের পারিবারিক শিক্ষার অভাব। তিনি আরও জানান, এখানে সব রকমের ব্যবসা থাকার কারণে লোকজনের আসা-যাওয়া বৃদ্ধি পেয়েছে। আরও জানান, শহরে মানুষের বিনোদনের জায়গা না থাকায় এই রোডে এসে আড্ডা দেয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি যশোর জেলা শাখার সভাপতি মাসুদুর রহমান বলেন, ডিসি অফিস থেকে প্রথম যখন ডিড করা হয়েছিল তখন ডিডে উলে¬খ ছিলো বই, ফটোকপি, স্টেশনারি ও কম্পিউটারের দোকান ছাড়া অন্য কোন ব্যবসা করা যাবে না, দোকান ভাড়া দেওয়া যাবে না, কোনো রকম ফাস্টফুডের দোকান দেওয়া যাবে না।
ডিড বদল হয়নি কিন্তু কিছুকিছু বই বিক্রেতা ব্যবসা পরিবর্তন করায় ভাড়া দিয়েছে। দু একজন ব্যবসায়ী অসুস্থ, কারো স্বামী মারা গেছে। তারা দোকান ভাড়া দিতে বাধ্য হয়েছে। আমরা মানবিক কারণে কিছু বলিনি। এখন দেখা যাচ্ছে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। বিশেষ করে আগুনের ভয় তাদের পেয়ে বসেছে।
তিনি জানান, সমিতির পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। শিগগির এটা দেয়া হবে।