১১ই ডিসেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৬শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ফিরে এলো একাত্তরের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’

সাইফুল ইসলাম : ‘আবাল—বৃদ্ধ—বনিতা ছুটছে। বৃদ্ধ পিতামাতাকে বাঁকে, কাঁধে তুলে নিয়ে ছুটছে সন্তান। রুগ্ন সন্তানের হাত ধরে হাঁটছে বাবা—মা। চোখেমুখে ভীতি নিয়ে তরুণী—যুবতী স্ত্রস্ত পদে ছুটছে। সন্তানসম্ভবা নারীও ছুটছে স্বামীর কাঁধে ভর করে। যশোর রোড ধরে ছুটছে সবাই। সবার গন্তব্য পূর্ববঙ্গ কলকাতা।’ একাত্তরের যুদ্ধবিভীষিকায় শরণার্থীদের এই দুর্দশার চিত্র শুক্রবার প্রতীকী পদযাত্রায় তুলে এনেছিলেন পাঁচ শতাধিক সাংস্কৃতিক কর্মী।

একাত্তরের সেপ্টেম্বরের যশোর রোডের ইতিহাসকে ৫২ বছর পর ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ফিরিয়ে এনেছিল যশোর জেলা প্রশাসন। ‘স্মরণে সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড—৭১’ শীর্ষক দু’দিনের অনুষ্ঠানে শুক্রবার যশোর রোডে শরণার্থীদের অবর্ণনীয় দুর্দশা ও যুদ্ধচিত্র ঘটনাপ্রবাহের প্রতীকী মঞ্চায়ন করা হয়। এই আয়োজনের মধ্যে দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’কে মূর্ত করে তোলে যশোর জেলা প্রশাসন।

শুক্রবার বিকেলে ঐতিহাসিক যশোর রোড যেন অন্য এক মূর্তি ধারণ করে। শত শত মানুষের দলবেঁধে হাঁটছে। এ হাঁটা যেন অজানা এক গন্তব্যের দিকে। কারোও গায়ে জামা নেই। কারোও গায়ে ছেঁড়া জাম গেঞ্জি। খালি গায়ে রুগ্ন শরীরে হেঁটে চলছে যশোর রোড ধরে। কেউ বা তার বৃদ্ধ মা বাবাকে কাঁধে তুলে হাঁটছে। আবার কেউবা সন্তানসম্ভবনা স্ত্রীকে নিয়ে নিজেদের শেষ সম্বল নিয়ে অজানা ভবিষ্যৎ দিকে যাচ্ছেন। দলবেঁধে এ যাত্রা ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে যশোর রোড ধরে ভারতের আশ্রয় শিবিরে। পাক আর্মির বর্বরতা থেকে বাঁচতে নিরস্ত্র বাঙালিদের সীমান্তের দিকে এ যেন এক অনন্ত যাত্রা। এভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও যুদ্ধকালীন সময়ে যশোর রোডে শরণার্থীদের অবর্ণনীয় দুর্দশা ও যুদ্ধচিত্র ঘটনাপ্রবাহে মূর্ত হয়ে উঠলো একাত্তরের যুদ্ধস্মৃতি। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’র বিভীষিকা ভেসে উঠল চোখের সামনে।

শুক্রবার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত যশোর রোডের পুলেরহাট বাজার থেকে কৃষ্ণবাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত ‘স্মরণে সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড—৭১’ স্মৃতিচারণের আয়োজন করে জেলা প্রশাসন যশোর। প্রায় ২৫ মিনিটে এক কিলোমিটার এ যাত্রায় যুদ্ধকালীন যশোর রোডের শরণার্থীদের যুদ্ধবিভীষিকা, অবর্ণনীয় দুর্দশা ফুটে উঠে। ৫২ বছর আগের গৌরবোজ্জ্বল প্রতীকী স্মৃতিচারণে একদিকে যেমন অনেকের হৃদয়ে শিহরণ জাগিয়েছে; অন্যদিক আবেগতাড়িতও হয়েছেন অনেকে। আর বর্তমান প্রজন্ম দেখেছে দুদর্শা—যুদ্ধ বিভীষিকার খন্ডচিত্র। সড়কের দুপাশে বিভিন্ন বয়সী মানুষও দেখেছেন এই প্রতীকী পদযাত্রা। সবারই গা শিউরে উঠেছে এই দৃশ্যপটে।
শুক্রবার বিকাল সাড়ে চারটায় শুরু হয় যশোর রোডের এই প্রতীকী পদযাত্রা।

শহরতলী পুলেরহাট বাজার থেকে শুরু হওয়া প্রতীকী উপস্থাপনাতে পাঁচ শতাধিক সাংস্কৃতিক কর্মী যশোর রোডে শরণার্থীদের অবর্ণনীয় দুর্দশা ও যুদ্ধচিত্র ঘটনাপ্রবাহ প্রতীকী উপস্থাপনাতে ফুটিয়ে তোলে। কাঁধে করে এক বয়স্ক পিতাকে তার ছেলে নিয়ে যাচ্ছিলেন আশ্রয়ণ শিবিরে। যাওয়ার পথে পাকিস্তানি মিলিটারিদের ভয়ে নিজের প্রাণ বাঁচাতে সেই বৃদ্ধ পিতাকে ফেলে রেখে যান গাছের নিচে। পরবর্তীতে একটি শিয়াল সেই বৃদ্ধের অসাড় দেহটির বিভিন্ন অংশ খেয়ে ফেলে। এসময় বৃদ্ধটি মারা যায়। আবার একমাত্র সন্তানের মরদেহ নিয়ে হেঁটে চলার এমনও দৃশ্য ফুটে উঠে। শত শত ক্ষুধার্ত শরণার্থীকে খাবার দিচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দরা। অনেকেই নিজের শেষ সম্বল টোপলা বেঁধে হেঁটে চলার দৃশ্যও দেখা গেছে। কেউ বা নিজের স্ত্রী সস্তানদের হারিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় বেঁচে থাকা অবলা প্রাণী ছাগলটিকে শেষ সম্বল মনে করে তা নিয়েই হেঁটে চলেছেন।

আবার মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ যেভাবে তার ক্যামেরায় এই সব শরণার্থীর অবর্ণনীয় দুর্দশার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন; সেই দৃশ্যও দেখা গেছে। যুদ্ধকালীন সময়ে যশোর রোডের শরণার্থীদের যুদ্ধবিভীষিকা, অবর্ণনীয় দুর্দশা গৌরবোজ্জ্বল প্রতীকী স্মৃতিচারণে উপস্থিত এই সড়কের দু’ধারে বাসিন্দাদের হৃদয়ে শিহরণ জাগিয়েছে। আবার অনেকেই আবেগতাড়িত হয়ে অশ্রম্নসিক্ত হতেও দেখা গেছে।

এই প্রতীকী পদযাত্রা উপস্থাপনাতে অংশ নিয়েছিলেন অনুসূয়া নামে এক সাংস্কৃতিক কর্মী । তিনি বলেন, আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। বাবা মায়ের মুখে শুনেছি। অভিনয়ে যুদ্ধকালীন সময়ে শরণার্থীদের যে দুর্দশা কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। সে এক অসাধারণ সময়ের সাক্ষী হয়ে গেলাম। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ—দুর্দশার খবর বিশ্ববাসীর কাছে পোঁছে দিয়েছিলেন মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ। মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের চরিত্রায়ন করেছেন যশোরের সাংস্কৃতিক কর্মী শফিকুল আলম পারভেজ।

তিনি বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীন যশোর রোডের শরণার্থীদের যুদ্ধবিভীষিকা, অবর্ণনীয় দুর্দশা ও যুদ্ধচিত্র নিয়ে মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ রচনা করেছিলেন কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। এটি শুধু একটি কবিতাই নয়, বাঙালির আত্মত্যাগের একটি মূল্যবান উপাখ্যানও। তার সেই চরিত্রটি সেভাব করতে পারিনি। তবে তার সেই চরিত্র করতে গিয়ে আমি যেন একাত্তরেই ফিরে গিয়েছিলাম।

এই প্রতীকী পদযাত্রা নির্দেশক থিয়েটার ক্যানভাসের কর্নধার কামরুল হাসান রিপন বলেন, পাঁচ শতাধিক সাংস্কৃতিক কর্মী ও বিভিন্ন শিক্ষার্থীরা সেপ্টেম্বর অন যশোর রোডের গৌরবোজ্জ্বল প্রতীকী স্মৃতিচারণে অংশ নেয়। এই সড়কের শুরু থেকে শেষ স্থান কৃষ্ণবাটি গ্রাম পর্যন্ত তারা নিজ নিজ চরিত্রে ডুবে ছিলেন। ২০২৩ সালের আজকের এই দিনটা যেন সবাই ফিরে গিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের সেই সেপ্টেম্বর মাসে।

যশোর সদর উপজেলা মুক্তিযুদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আফজাল হোসেন দুদুল বলেন, একাত্তরে আমরাও এই সড়ক দিয়ে ওপারে গেছিলাম। সেই দৃশ্য আমাদের চোখে আজও ভেসে উঠে। প্রতীকী যাত্রা আর সুনিপুণ অভিনয়ে সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল।

পদযাত্রা শেষে স্থানীয় কৃষ্ণবাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টচায্যর্। তিনি বলেন, ঐতিহাসিক যশোর রোড। মুক্তিযুদ্ধের একটি অংশ। এই রোড ঘিরে আছে অনেক গল্প—গান। মুক্তিযুদ্ধে লাখো মানুষ জীবন বাঁচাতে এই পথ দিয়েই ভারতে আশ্রয় নেন। অবর্ণনীয় দুর্দশা ও যুদ্ধচিত্র নিয়ে মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ রচনা করেছিলেন কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’।

এই কবিতাটি পড়লে বর্বর পাকিস্তানিদের নির্মম নৃশংস গণহত্যার চিত্র যেনো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। জেলা প্রশাসনের এই আয়োজনে নতুন প্রজন্ম তাদের ইতিহাসকে নতুনভাবে জানতে পারলো। প্রতিবছরই এভাবে আমরা সেই ঐতিহাসিক রোডকে স্মরণ করতে চাই। একই সাথে এই রোডকে সংরক্ষণে আমরা পদক্ষেপ নেবো।

যশোরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবরাউল হাছান মজুমদার বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যশোর রোডের নাম জড়িত রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর সদস্যরা এই যশোর রোড দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আবার এই সড়ক দিয়ে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ ভারতে শরণার্থী হয়ে ছুটতে থাকে। শরণার্থীদের নিয়ে মার্কিন কবি সড়কটি নিয়ে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ নামে একটি কবিতাও লিখেছিলেন, যেটি সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে ও সড়কটিকে স্মরণ করতে এই আয়োজন।

অনুষ্ঠানে আরোও উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকার যশোরের উপপরিচালক রফিকুল হাসান, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম মিলন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সাইফ, মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট রবিউল আলম, মুক্তিযোদ্ধা এইচ এম মাজহারুল ইসলাম মন্টু, মুক্তিযোদ্ধা একরাম উদ—দৌলা, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার, মুক্তিযোদ্ধা মন্টু চাকলাদার, জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য মুক্তিযোদ্ধা মোবাশ্বের বাবু প্রমুখ।

সম্পাদক ও প্রকাশক : শাহীন চাকলাদার  |  ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আমিনুর রহমান মামুন।
১৩৬, গোহাটা রোড, লোহাপট্টি, যশোর।
ফোন : বার্তা বিভাগ : ০১৭১১-১৮২০২১, ০২৪৭৭৭৬৬৪২৭, ০১৭১২-৬১১৭০৭, বিজ্ঞাপন : ০১৭১১-১৮৬৫৪৩
Email[email protected]
পুরাতন খবর
FriSatSunMonTueWedThu
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031 
স্বত্ব © samajerkatha :- ২০২০-২০২২
crossmenu linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram